নির্বাচিত কলাম
আন্তর্জাতিক
সামরিক আদালতে বিচার হলে ইমরানের কি ফাঁসি হবে?
মোহাম্মদ আবুল হোসেন
৫ জুন ২০২৩, সোমবার
আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে ১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠান সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ। কিন্তু নির্বাসন থেকে তিনি পাকিস্তানে ফেরেন। ইসলামাবাদে পৌঁছার পর বিমানবন্দর বন্ধ করে দেয়া হয়। কিছুক্ষণ পরেই তার নির্বাসনের ১০ বছরের মধ্যে শেষ তিন বছর আটক থাকতে হয় সৌদি আরবের জেদ্দায়। মেয়ে মরিয়ম নওয়াজসহ তাকে জাতীয় জবাবদিহিতা বিষয়ক ব্যুরো (এনএবি) দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে ১০ বছরের জেল দেয়। হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায়ের জন্য অপেক্ষায় থাকার কারণে তার শাস্তি স্থগিত করে আদালত। দু’মাস পরে বেরিয়ে আসেন নওয়াজ। ২০১৮ সালে তাকে আবার জেল দেয়া হয়।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী থেকে ইমরান খান। পাকিস্তানের জটিল, কুটিল রাজনীতির শিকার সাবেক বেশির ভাগ প্রধানমন্ত্রী। বেশির ভাগই দেশটির প্রচণ্ড দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সেনাবাহিনীর রোষের শিকার হয়েছেন।

দেশটিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের জেলে বন্দি রাখার দীর্ঘ এক ইতিহাস আছে। জন্মের পর থেকেই এই কুখ্যাত ঘটনা সেখানে ঘটে চলেছে। ১৯৫০ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে কোম্পানিবাগে মুসলিম সিটি লীগের এক জনসভায় বক্তব্য রাখছিলেন দেশটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান। সেখানে তাকে হত্যা করা হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকে ২০০৭ সালে একটি জনসভায় গুলি করে হত্যা করা হয়। এর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত বা বিচার এখনো হয়নি। অবিভক্ত পাকিস্তানের ৫ম প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত) ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। জেনারেল আইয়ুব খান সরকারের ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু তা অনুমোদন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী। ফলে ইলেকটিভ বডিস ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডারের (এবডো) মাধ্যমে তাকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৬০ সালের জুলাই মাসে এবডো নির্দেশ লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬২ সালে করাচির কেন্দ্রীয় কারাগারে নিঃসঙ্গ জেল দেয়া হয়। বিচারহীনভাব তাকে এই জেল দেয়া হয় ১৯৫২ সিকিউরিটি অব পাকিস্তান অ্যাক্টের অধীনে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে।
১৯৭৩ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭৭ সালের জুলাই পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো। ১৯৭৪ সালে বিরোধী এক রাজনীতিককে হত্যা ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরে। লাহোর হাইকোর্ট তাকে মুক্ত করে দেয়। বিচারপতি খাজা মোহাম্মদ আহমদ সামদানি তার রায়ে বলেন, তাকে গ্রেপ্তারের কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু এর তিনদিন পরেই মার্শাল ল’ রেগুলেশন ১২-এর অধীনে তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। এই রেগুলেশনে আইন প্রয়োগকারী এজেন্সিগুলোকে কেউ নিরাপত্তা, আইন ও শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে যদি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন তাহলে তাকে আটকের ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। অথবা ওই ব্যক্তিকে সামরিক আইনের অধীনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। এই আইনকে দেশে প্রচলিত কোনো আদালতের আইন দিয়ে চ্যালেঞ্জ করার বিধান ছিল না। ফলে জুলফিকার আলি ভুট্টোকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ১৯৭৯ সালের ৪ঠা এপ্রিল।
সেই জুলফিকার আলি ভুট্টোর মেয়ে বেনজির ভুট্টো। দু’মেয়াদে ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। প্রথম মেয়াদ ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৯০ সালের আগস্ট পর্যন্ত। দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৯৩ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৯৬ সালের নভেম্বর মেয়াদে। স্বৈরাচার জিয়াউল হকের (১৯৭৭-১৯৮৮) অধীনে বেনজির ভুট্টো ছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা। নিহত ভাই মুর্তজা ভুট্টোর দাফন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ১৯৮৫ সালের আগস্টে পাকিস্তানে ফেরেন। কিন্তু ৯০ দিন বা তিন মাসের জন্য তাকে করা হয় গৃহবন্দি। স্বাধীনতা দিবসে করাচিতে একটি র্যালিতে অংশ নেন। সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে বক্তব্য রাখার কারণে তাকে ১৯৮৬ সালের আগস্টে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৯৮ সালের মে মাসে লাহোর হাইকোর্টের এহতেসাব বেঞ্চ বেনজির ভুট্টোর বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। ১৯৯৮ সালের জুনে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি বেনজির ভুট্টোর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। পরের মাসে তার বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে এহতেসাব বেঞ্চ। ১৯৯৯ সালের এপ্রিলে তাকে আবার ৫ বছরের জেল দেয়া হয়। একই বেঞ্চ তাকে সরকারি কোনো পদে অযোগ্য ঘোষণা করে। অভিযোগ তোলা হয়, কাস্টমসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সুইস একটি কোম্পানিকে ভাড়া করার সময় তিনি ঘুষ নিয়েছেন। একের পর এক আঘাতে যখন এই মামলার রায় সামনে তখন তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যান এবং পরে হাইকোর্ট রায় উল্টে দেয়। ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে এহতেসাব বেঞ্চ আরও একবার বেনজিরের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। কারণ, তিনি সম্পদ সংক্রান্ত একটি রেফারেন্স মামলায় আদালতে উপস্থিত হননি। জেনারেল পারভেজ মোশাররফের (প্রয়াত) কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে বিশাল এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিলেন বেনজির। তাকে থামাতে ২০০৭ সালের নভেম্বরে পিপিপি সিনেটর লতিফ খোসার বাড়িতে পাঞ্জাবে এক সপ্তাহ গৃহবন্দি করে রাখা হয়। কিন্তু মাত্র ১৫ বছর বয়সী এক আত্মঘাতী বিলাল নামের হামলাকারী রাওয়ালপিন্ডিতে ২০০৭ সালের ২৭শে ডিসেম্বর হত্যা করে বেনজিরকে।
আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে ১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠান সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ। কিন্তু নির্বাসন থেকে তিনি পাকিস্তানে ফেরেন। ইসলামাবাদে পৌঁছার পর বিমানবন্দর বন্ধ করে দেয়া হয়। কিছুক্ষণ পরেই তার নির্বাসনের ১০ বছরের মধ্যে শেষ তিন বছর আটক থাকতে হয় সৌদি আরবের জেদ্দায়। মেয়ে মরিয়ম নওয়াজসহ তাকে জাতীয় জবাবদিহিতা বিষয়ক ব্যুরো (এনএবি) দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে ১০ বছরের জেল দেয়। হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায়ের জন্য অপেক্ষায় থাকার কারণে তার শাস্তি স্থগিত করে আদালত। দু’মাস পরে বেরিয়ে আসেন নওয়াজ। ২০১৮ সালে তাকে আবার জেল দেয়া হয়। সৌদি আরবে স্টিল মিলে তার পরিবারের মালিকানা স্বত্ব থাকার কারণে সাত বছরের জেল দেয়া হয়। চিকিৎসার জন্য তিনি ২০১৯ সালের নভেম্বরে দেশ ছাড়ার অনুমতি পান। তারপর আর পাকিস্তানে ফেরেননি।
সাবেক আরেক প্রধানমন্ত্রী শাহিদ খাকান আব্বাসিকে (২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের মে পর্যন্ত) দুর্নীতির অভিযোগে এনএবি’র ১২ সদস্যের টিম গ্রেপ্তার করে। অভিযোগ আনে ২০১৩ সালে তিনি এলএনজির কয়েক শত কোটি রুপির একটি চুক্তিতে দুর্নীতি করেছিলেন পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ক মন্ত্রী থাকাকালে। ২০২০ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি তাকে জামিনের পর আদিয়ালা জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
এখন প্রশ্ন হলো এদের কার ভাগ্য বরণ করতে চলেছেন ইমরান খান! নাকি তিনি ভাঙনের মুখ থেকে ফিরে আবার পাকিস্তানে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেন!
পাঠকের মতামত
ফাঁসি যে হবে, এতে কোন সন্দেহ নাই। পাকিস্তান সেনাবাহিনী হচ্ছে বিশ্বের সবচে বেকুব এবং গাদ্দার আর্মি। ওদের জন্য পাকিস্তান ভেঙেছিল, এটা পাকিস্তানীরা বুঝে, কিন্তু বলতে পারে না। ইমরান খান ঠাস্ করে বলে ফেলেছে, এটা তার সবচে বড় অপরাধ। লিখে রাখুন আগামি ২০ বৎসরের ভেতর পাকিস্তান, এই সেনা বাহিনীর কারণে, আবার ভাঙবে।
সামরিক আদালতে ফাঁসির আদেশ হলে অবাক হবো না।
বাংলাদেশেও একই ঘটনা ঘটানোর পায়তারা করতেছে আমেরিকা আর তার এদেশের কিছু ধান্ধাবাজ বদমায়েশ কুলাংগার জাতীয় কিছু লোক। এদেশে এই সব মানুষের কোন অবদান নাই। এদের কাজ হল দেশ বিদেশ ঘুরে দেশ বিরোধী অপপ্রচার চালানো। এর নেত্রিত্তে এখন তথাকথিত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মানুষ। এই দেশে এই মানুষ টার কি অবদান তা কেউ বলতে পারে না।
ইমরান খান এর এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের কোনো দেশের প্রতিক্রিয়া এখনও পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি। কারণ হিসেবে দেখা যায় রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কিছুদিন আগে রাশিয়া সফর করে প্রেসিডেন্ট পুতিন এর সাথে সাক্ষাত করার বিষয়টি আমেরিকাসহ পশ্চিমারা ভালো চোখে নেয়নি। তাই পাকিস্তানের এই পরিস্থিতিতেও আমেরিকাসহ পশ্চিমারা কোনো বিবৃতি দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছে না। তাছাড়া পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রভাব সরকার পরিচালনায় বড় ভূমিকা আছে। বিষয়টা ইমরান খান এর বুঝা দরকার ছিল। কারণ সেনাবাহিনীর বিপক্ষে অবস্থান নিলে কি অবস্থা হতে পারে তা এখন পরীক্ষিত সত্য। যাইহোক ইমরান খান এই প্রতিকূল অবস্থাকে ওভারকাম করে সফলতা অর্জন করলে সাধারণ খুবই খুশি হবে। আল্লাহ তুমি ইমরান খান এর উপর রহমত বর্ষন করুন।
মন্তব্য করুন
নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন
নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত
বেহুদা প্যাঁচাল/ অর্থমন্ত্রীর এত বুদ্ধি!
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ বাংলাদেশের অর্থ পাচার, ভারতের আনন্দবাজার, ইউরোপের কালো তালিকা
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ নির্বাচন ঘিরে একই প্রশ্ন, আমেরিকা কি ম্যানেজ হয়ে যাবে?
আন্তর্জাতিক/ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এবং পশ্চিমাদের অবস্থান
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি, সরকারের নীরবতা, অ্যাকশনে অন্যরাও?

জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]