নির্বাচিত কলাম
সরল সম্ভাষণ
প্রস্তাবিত বাজেট, করজালে বিপর্যস্ত হবে মানুষ
টুটুল রহমান
৪ জুন ২০২৩, রবিবারধনীদের বড় ধরনের ছাড় দেয়া হয়েছে। তাদের জন্য সারচার্জমুক্ত সম্পদ মূল্যের সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমান বাজেটে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পদ সারচার্জমুক্ত ছিল। প্রস্তাবিত বাজেটে এ সীমা ১ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। সর্বজনীন পেনশন প্রথা চালুসহ সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার উপকারভোগীর সংখ্যা ও ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদেশি ও বিলাসবহুল অনেক নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে। বিদেশ থেকে স্বর্ণ আমদানিতে ৪ হাজার টাকা শুল্ক প্রস্তাব করা হয়েছে। ভ্রমণে দিতে হবে বাড়তি কর।
শঙ্কার কথা হচ্ছে, আহরিত টাকার বেশির ভাগ খরচ হয়ে যাবে ঋণের সুদ পরিশোধে। সরকারি বেতন ভাতায়। সাধারণ মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন দিন। সর্বশেষ বলা যায়, আগামী বছরজুড়ে মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়াকে সামাল দিতে অর্থমন্ত্রীর ঘাম ছুটে যাবে। মানুষের জন্য স্বস্তিদায়ক কোনো খবর বয়ে আনতে পারেনি প্রস্তাবিত বাজেট
বাজেটে কী হয়, কেমন বাজেট হয়েছে, বাস্তবায়িত হবে কিনা, মানুষ কী পেলো এসব এখন মোটামুটি সবাই জানেন। মতামত দিতে পারেন। সুতরাং মানুষের চোখে ধুলো দেয়ার দিন প্রায় উঠেই গেছে। ১লা জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে জাতীয় সংসদে। তারপর থেকেই বাজেট নিয়ে আলেচনা হচ্ছে, সমালোচনা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ, বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা বাজেট নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন। তারা বের করে আনতে চান জন-মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি। আগামী অর্থবছরে মানুষের জীবনযাত্রার গুণগত পরিবর্তন আসবে কিনা, অর্থনীতিতে ধেয়ে আসা সংকট মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি কি? সেইসঙ্গে দ্রব্যমূল্যে যে ঊর্ধ্বগতি, জীবনযাত্রার ব্যয় সামলাতে গিয়ে মানুষের যে অবর্ণনীয় কষ্ট হচ্ছে তা লাঘব হবে কিনা। বাজেটের তথ্য-উপাত্তের দিকে তাকিয়ে বলা যায়, বিশাল ঘাটতির এই বাজেটে সরকার ব্যাংক ঋণ ও প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তাতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে, বেসরকারি বিনিয়োগে চাপ বাড়বে, সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা আরও চাপবে। অর্থাৎ ঠিক এই মুহূর্তে দ্রব্যমূল্য কমানোর যে সুখবর মানুষ শুনতে চেয়েছিল সেটা বাজেটে নেই। প্রস্তাবিত বাজেটে জীবনযাত্রার ব্যয়ে কোনো সুখবর নেই, করজালে বিপর্যস্ত হবে মানুষ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিয়ে চমক দেখিয়েছিলেন প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। সেটা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারে প্রথম মেয়াদ। তার আগে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম দিয়েছিলেন ৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকার বাজেট।
বাস্তবায়ন নিয়ে শংকা, নেতিবাচক মন্তব্য থাকা সত্ত্বেও গত ১৪টি অর্থবছরে বাজেটের আকার বাড়িয়ে আওয়ামী লীগ চমক দেখিয়েছে। এবার গত বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় বাজেটের আকার বেড়েছে ১৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অথচ রাজস্ব আদায় হয়েছে গত এপ্রিল পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬১ শতাংশ। সুতরাং বিরাট চ্যালেঞ্জ নিয়ে সরকার এবার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে। যা জিডিপি’র ১৫ শতাংশ।
অর্থসংস্থানের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে, সরকার ৫ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এরমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড অর্থাৎ এনবিআরের মাধ্যমে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা প্রত্যক্ষ কর এবং অন্যান্য উৎস হতে ৭০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে।
জীবনযাত্রার গুণগত পরিবর্তন আসবে কিনা, অর্থনীতিতে ধেয়ে আসা সংকট মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি কি? সেইসঙ্গে দ্রব্যমূল্যে যে ঊর্ধ্বগতি, জীবনযাত্রার ব্যয় সামলাতে গিয়ে মানুষের যে অবর্ণনীয় কষ্ট হচ্ছে তা লাঘব হবে কিনা। বাজেটের তথ্য-উপাত্তের দিকে তাকিয়ে বলা যায়, বিশাল ঘাটতির এই বাজেটে সরকার ব্যাংক ঋণ ও প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তাতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে, বেসরকারি বিনিয়োগে চাপ বাড়বে, সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা আরও চাপবে। অর্থাৎ ঠিক এই মুহূর্তে দ্রব্যমূল্য কমানোর যে সুখবর মানুষ শুনতে চেয়েছিল সেটা বাজেটে নেই। প্রস্তাবিত বাজেটে জীবনযাত্রার ব্যয়ে কোনো সুখবর নেই, করজালে বিপর্যস্ত হবে মানুষ
বাজেটে ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা যা জিডিপি’র ৫.২ শতাংশ। ঘাটতি পূরণ (অর্থসংস্থান) করা হবে দুইভাবে-বৈদেশিক ঋণ ও অভ্যন্তরীণ ঋণ নিয়ে। বৈদেশিক ঋণ নেয়া হবে নিট ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, আর সঞ্চয়পত্র বিক্রিসহ ব্যাংক বহির্র্ভূত ঋণ নেয়া হবে ২৩ হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ কর আদায়ে টিএনআইধারীর সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া শূন্য কর বিষয়টি তুলে দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ টিএনআই থাকলে আপনি আগে শূন্য রিটার্ন দাখিল করতে পারতেন কিন্তু এবার থেকে আপনাকে ন্যূনতম কর ২০০০ টাকা পরিশোধ করতে হবে। এতে করজালে বিপর্যস্ত হবে সাধারণ মানুষের জীবন।
কারণ মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় অর্থমন্ত্রী ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়েছেন। অর্থাৎ ন্যূনতম করের সীমা হবে সাড়ে ৩ লাখ টাকা। করযোগ্য আয় না থাকলেও সরকারি সেবা নিতে হলে ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দিতেই হবে।
বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। গত এপ্রিলে এসে দেখা গেল প্রয়োজন আরও বেশি। ফলে ব্যাংক ঋণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে ব্যাংক ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা যা বর্তমান অর্থবছরের ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার তুলনায় ২৬ হাজার কোটি বা ২৪ শতাংশ বেশি। এরফলে ঘাটতি পূরণ হয়তো হবে কিন্তু মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে বহুগুণ।
বরাদ্দের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা যা গত বাজেটে ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। পুরনো নিয়মে ৫ শতাংশের আটকা রইলো স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ।
সরকারের শেষ সময়ের বাজেট এটি। সামনে ভোট। এ সময়ে সাধারণত জনতুষ্টিমূলক অনেক প্রকল্প নিয়ে থাকে সরকার। সরকার এমন এমন কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হাতে নেন যাতে মানুষের হাতে টাকা যাওয়ার রাস্তা তৈরি হয়। খুশি রাখা হয় ব্যবসায়ীদের। দেয়া হয় নানা করছাড়।
কিন্তু এবারের বাজেটে এ ধরনের উদ্যোগ খুব কম। এমন একটি বাজেট দেয়া হয়েছে যেখানে কম-বেশি সরকার ওপরেই চাপ বাড়বে। আমদানি পণ্যে ব্যাপকভাবে সম্পূরক শুল্ক আরোপ, ২ হাজার টাকা ন্যূনতম কর দেয়ার বিধান, জমি-ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ব্যয়ের অসহনীয় বৃদ্ধি, দ্বিতীয়ত গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে কর আরোপের মতো অজনপ্রিয় প্রস্তাব রাখা হয়েছে এবারের বাজেটে। অর্থনীতির চরম সংকট মোকাবিলায় এই উদ্যোগগুলো খুব একটা কাজেও আসবে না।
অন্যদিকে ধনীদের বড় ধরনের ছাড় দেয়া হয়েছে। তাদের জন্য সারচার্জমুক্ত সম্পদ মূল্যের সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমান বাজেটে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পদ সারচার্জমুক্ত ছিল। প্রস্তাবিত বাজেটে এ সীমা ১ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। সর্বজনীন পেনশন প্রথা চালুসহ সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার উপকারভোগীর সংখ্যা ও ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদেশি ও বিলাসবহুল অনেক নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে। বিদেশ থেকে স্বর্ণ আমদানিতে ৪ হাজার টাকা শুল্ক প্রস্তাব করা হয়েছে। ভ্রমণে দিতে হবে বাড়তি কর।
শঙ্কার কথা হচ্ছে, আহরিত টাকার বেশির ভাগ খরচ হয়ে যাবে ঋণের সুদ পরিশোধে। সরকারি বেতন ভাতায়। সাধারণ মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন দিন।
সর্বশেষ বলা যায়, আগামী বছরজুড়ে মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়াকে সামাল দিতে অর্থমন্ত্রীর ঘাম ছুটে যাবে। মানুষের জন্য স্বস্তিদায়ক কোনো খবর বয়ে আনতে পারেনি প্রস্তাবিত বাজেট।