ভারত
‘হঠাৎ বিকট শব্দে ট্রেন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো’
সোমনাথ রায়
(১ বছর আগে) ৩ জুন ২০২৩, শনিবার, ১০:৫০ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:০৯ পূর্বাহ্ন

শুক্রবার ভালো দিন। সন্তোষী মাতার দিন। তাই মার ইচ্ছাতে এই দিনের করমন্ডল এক্সপ্রেসের টিকিট কেটেছিলাম। তখন কী জানতাম এই যাত্রার পরিণতি এইরকম ভয়াবহ হবে! আমি হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের বাসিন্দা। কাজ করি কোয়েম্বাটুর এর একটি মার্বেল ফ্যাক্টরিতে। হিসাবরক্ষকের চাকরি। শনিবার চেন্নাই পৌঁছে রাতেই ট্রেন ধরে কোয়েম্বাটুর পৌঁছে রোববারটা বিশ্রাম নিয়ে সোমবার কাজে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ম্যান প্রপোজেস গড ডিস পোজেস বলে একটা কথা আছে না? এত কথা আপনার সঙ্গে টেলিফোনে বলতে পারছি এতেই আমি বিস্মিত হয়ে যাচ্ছি। আমার তো বেঁচে থাকার কথাই ছিল না! অভিশপ্ত ট্রেনটির এস ফোর কম্পার্টমেন্টে আমার স্লিপার বার্থ রিসার্ভ ছিল। ট্রেন বালাশোর পর্যন্ত ভালোই চললো। বালাশোর স্টেশন এ নেমে জল ভরলাম বোতলে। এরপর মিনিট কুড়ি আমাদের ট্রেন চলেছে কী চলেনি, হঠাৎ বিকট শব্দ, ট্রেন যেন তাসের ঘরের মতো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো। প্রথমে ভেবেছিলাম বোধহয় ভূমিকম্প হচ্ছে। সম্বিত ফিরে পেলাম যখন বুঝলাম ঘাসের জমিতে আমি পড়ে আছি। চারদিকে আর্তনাদ আর কান্নার রোল। আমার আশপাশে কিছু নিস্পন্দ দেহ পড়ে আছে। বাঁ কনুইয়ের কাছ দিয়ে গলগল করে কী যেন বের হচ্ছে। তাকিয়ে দেখি রক্ত। কোনো রকমে রুমালটা ব্যান্ডেজ এর মতো করে বাঁধলাম। নিকষ কালো অন্ধকার। এক হাত দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমি বেঁচে আছি- এই বোধটাই তখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাকিয়ে দেখি বেশ কয়েকটা বগি মাটিতে পড়ে রয়েছে। মানুষের কাটা হাত পা এই প্রথম দেখলাম। গাটা গুলিয়ে উঠলো। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে কিছু একটায় হোঁচট খেলাম- দেখি একটা শব দেহ পড়ে আছে। পকেটে হাত দিয়ে মোবাইলটা বের করলাম, মাকে টেলিফোন করে শুধু বললাম- আমি বেঁচে আছি। আতঙ্কের কোনো কারণ নেই। বললাম বটে আতঙ্কের কোনও কারণ নেই, কিন্তু সত্যি কী আতঙ্ক নেই! কিভাবে উদ্ধারকারীরা আমাকে বালাশোর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে এলো, আমার প্রাথমিক চিকিৎসা কী হলো- কিচ্ছু আমার মনে নেই। এই যে এখন বালাশোর স্টেট জেনারেল হাসপাতালের বারান্দায় বসে আপনার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলছি, তখনও স্তূপ স্তূপ মৃতদেহ আসছে সাইরেন বাজিয়ে। আহতদের কারও পা নেই, কারও হাত। আমার মনে পড়ছে শুধু একটি কিশোরের মুখ। বছর বারোর কিশোরটি গরমের ছুটিতে মায়ের সঙ্গে বাবার কর্মস্থল চেন্নাইতে যাচ্ছিলো। ওদের কী হলো! ছেলেটার সঙ্গে ওর বাবার দেখা হবে তো? নাকি লাশ কাটা ঘরে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে পড়ে থাকবে মা আর ছেলের দেহ?