ঢাকা, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

চলতি পথে

রাজনীতির ভাষা বদল কীসের ইঙ্গিত

শুভ কিবরিয়া
৩ জুন ২০২৩, শনিবার
mzamin

বাংলাদেশের জন্য আমেরিকার ‘বিশেষ ভিসা নীতি’ ঘোষিত হওয়ার পর বোঝা গেল সর্বনাশটা কোথায় ঘটলো। এই ভিসা নীতি নিয়ে কথা হয়েছে বিস্তর। এবং ক্রমশ সরকারের ওপর মহলের প্রতিক্রিয়ার ভাষাও বদলে যেতে শুরু করেছে। এর প্রথম বাস্তব প্রভাব দেখা গেল গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলে। ফলাফল পাল্টানোর সমূহ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সেখানে কেউ রিস্ক নিলো না, ফলাফল প্রকৃতই যেদিকে যাচ্ছিল সেটাই বজায় থাকলো। এরপর জল অনেক ঘোলা হয়েছে। শাসকদের ভাষাও তাতে বদলে গেছে। সেই ভাষা বদলের কিছু নমুনা হাজির করছি। সেটা আমাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে পারে কিনা সেই বাঁক বদল বোঝার জন্য কাজে দেবে। 
‘ডিসিদের প্রতি অসন্তোষ হাইকোর্টের 
এ দেশেই থাকতে হবে, লুট করে আমেরিকা নিলে সব রেখে দেবে।’[যুগান্তর, ২৯.০৫.২৩] এই শিরোনামের নিউজে বলা হচ্ছে বারবার সময় দেয়ার পরও বরিশালের সন্ধ্যা নদী দখলমুক্ত করে প্রতিবেদন না দেয়ায় জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন দেশ এটাই, এখানেই থাকতে হবে।

বিজ্ঞাপন
কেউ যদি লুট করে আমেরিকা নিয়ে যায়, কোনো লাভ হবে না, সব রেখে দেবে। তাই পরিবেশটা ঠিক রাখতে হবে।

বরিশালে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন উপলক্ষে মাঠ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বলেছেন, ‘পক্ষপাতিত্বের কোনো সুযোগ নেই। আমরা খুব স্ট্রং ভাষায় বলেছি, আপনাদের নিরপেক্ষ থেকে কাজ করতে হবে। এটি মনে করলে চলবে না যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানেই সরকারি বাহিনী বা সরকারি দলের বাহিনী। তারা  সরকারিভাবে রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।’ বলা বাহুল্য সিইসি’র এই নতুন ভাষ্য আমেরিকার নয়া ভিসা নীতি ষোষিত হওয়ার পরই জোরেশোরে এসেছে মিডিয়ায়।

বঙ্গভবনে নতুন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন পুলিশের আইজিপি। সেই সাক্ষাতের খবর বঙ্গভবনের দাপ্তরিক বয়ানে মিডিয়ায় এসেছে এই ভাবে যে, ‘পুলিশকে আরও জনবান্ধব হওয়ার নির্দেশ রাষ্ট্রপতির।’  

সবচাইতে অবাক করেছেন ওবায়দুল কাদের। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের দলীয় কার্যালয়ের সামনে রাখা আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে সম্প্রতি বলেছেন, ‘মানুষ বেশি খুশি হয়েছে সুষ্ঠু নির্বাচনে।’ তিনি বলেছেন, ‘গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বিজয়ী হলে দেশের মানুষ যতটা খুশি হতেন, তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচন হওয়ায়।’ যদিও এই নির্বাচনে দেশের প্রধানতম রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নেয় নাই, তবু ওবায়দুল কাদেরের এই মন্তব্য বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে।

আদালত, প্রেসিডেন্ট, সিইসি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের এই বয়ান মার্কিন নয়া ভিসা নীতি ঘোষিত হওয়ার আগের বয়ানের সঙ্গে মৌলিক পার্থক্য বহন করে। এই বয়ানের যে টোন, যে নমনীয়-সাবধানী ইঙ্গিত, যে সতর্কতা, যে রক্ষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি তাতে একথা বলা যায় আমেরিকার পদক্ষেপ বাংলাদেশের সকল মহলকে নাড়া দিয়েছে বেশ।

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের একটা দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি হচ্ছে আচানক সব ঘটনা রাজনীতির প্রচলিত গতিকে সবসময় প্রভাবিত করেছে। এখানে রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিকতার বদলে ‘ব্যক্তি’ প্রধান হয়েছে বহুবার। এই ব্যক্তিবাদী রাজনীতির ফলাফল আমজনতার যতটা না কাজে লেগেছে তার চাইতে বেশি কাজে লেগেছে সুবিধাবাদী চাটুকারদের। চাটুকার, তেলবাজ আর স্বার্থবাদী সুবিধা নেয়া পারঙ্গমদের প্রভাব তাই রাজনীতিবিদদের, বিশেষত ক্ষমতাবানদের চোখে ঠুলি পরাতে পেরেছে। চোখে ঠুলিওয়ালা সেই রাজনীতিবিদরা তাই দূর ভবিষ্যৎ তো বটেই নিকটের পরিণতিকেও বিন্দুমাত্র ঠাওর করতে পারেন নাই। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির খুব একটা বদল হয় নাই এখানে। কি একনায়ক, কি গণতন্ত্রী, কি সামরিক স্বৈরাচার, কি গণতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী শাসক-সবার জমানাতেই একই জিনিস ঘটেছে ভিন্ন ভিন্ন মোড়কে। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমতাবানরা যত ক্ষমতা একীভূত করতে থাকে, ততই মানুষের ক্ষোভ-দুঃখ, গণতান্ত্রিক পথে প্রকাশিত হওয়ার সুযোগগুলো বন্ধ হতে থাকে। স্বাভাবিক পথে রাজনৈতিক নেতা পরিবর্তনের সুযোগ যত সীমিত হয়ে ওঠে মানুষ ততই অদৃষ্টবাদী হতে থাকে। আর ভর করতে থাকে নিজেদের আকাক্সক্ষামতো শাসকের পরিণতি সম্পর্কে কাল্পনিক ও অদৃষ্টবাদী আশায়। সেখানে তখন গুজব খুব বড় হয়ে ওঠে। গুজবের ডালপালা মেলতে থাকে বিস্তর। মানুষ তাতে ভরসাও পায়। এক সময় দেখা যায়, সেই গুজবই পূর্ণ সত্যি হয়ে ওঠে অথবা প্রায় সত্যের রূপধারণ করতে থাকে। এই ঘটনা পরম্পরার ইতিহাস এখানে বহুদিনের। অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে এই ঘটনা পরম্পরা থেকে ইতিহাসের শিক্ষা কেউ নেয় না। বরং ইতিহাসের শিক্ষাকে অস্বীকারের প্রবণতাই শাসকদের মধ্যে বেড়ে ওঠে।

এই প্রেক্ষাপটটা খুবই গুরুত্ববহ। এই প্রেক্ষাপট মাথায় নিয়ে আমেরিকান এইসব অ্যাকশন ও তার প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় নিতে হবে। এটা পরিষ্কার আমেরিকা এবার ঘোষণা দিয়েই বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে মাঠে নেমেছে। আমেরিকান এই প্রচেষ্টা বাংলাদেশে সত্যিকার গণতন্ত্র ফেরাবে না বাংলাদেশকে আমেরিকার স্বার্থ ও সুবিধার প্রতিকারহীন ক্ষেত্রে পরিণত করবে সেটা নির্ভর করছে আমাদের রাজনীতির যোগ্যতার ওপর। কিন্তু শুধু বিশেষ ভিসা নীতির ঘোষণা ও নিরীহ ভিসা স্যাংশনের ঘোষণাতেই আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাষা যেভাবে বদলে যাচ্ছে, সেটাই বিপদের কথা। বাজারে গুজব রটেছে মার্কিন কংগ্রেসম্যানরা আরও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাইছে। এই গুজব যদি সত্যিই হয়ে ওঠে, তাহলে সত্যই বিপদের কথা। এ রকম চাপ ক্ষমতাবানরা মোকাবিলা করার জনশক্তি বহু আগেই হারিয়েছে। তাদের একমাত্র উপায় সেই বিপদের মুখে দেশকে বিপন্ন করে, দেশের স্বার্থকে আরও অসুবিধার মুখে ফেলে, নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করা। এমনিতেই বহু বছরের অপ্রাতিষ্ঠানিকতা আর জনভোটের শক্তিকে অস্বীকার করার প্রবণতার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের জনগণের সক্ষমতার শক্তি বহুমাত্রিকতায় দুর্বল হয়েছে। ফলে, এক নতুন বিপদের মুখে বাংলাদেশ। ক্ষমতায় থাকা রাজনীতির কুশীলবদের একমাত্র লক্ষ্য আমেরিকান সকল চাপ মোকাবিলা করে নিজেদের সুরক্ষা নেয়া। দেশ ও দেশের স্বার্থ সেখানে খুবই গৌণ, সঙ্গত কারণেই। অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিসমূহ, যারা বহুদিন ক্ষমতার বাইরে, তাদের একমাত্র লক্ষ্য যেকোনো মূল্যে ক্ষমতার ধারায় ফিরে আসার চেষ্টা করা। নিজেদের যেকোনো ভাবেই হোক না কেন, ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে প্রবেশ করানো। দেশ ও দেশের স্বার্থ তাদের কাছে নিজেদের স্বার্থের চাইতে প্রবল নয় মোটেই। এর বাইরে যারা আছেন, তাদের একাংশ সুযোগ পেলে অতীতের মতোই বিরাজনীতিকরণের চেষ্টা চালাতে পারে। সেটা মূল সংকটের ভেতর না ঢুকে, সংকট মোকাবিলার অপচেষ্টা মাত্র। ফলে, এই মুহূর্তে কার হাতে দেশ নিরাপদ- সেটা একটা মৌলিক প্রশ্নও বটে। আমাদের ভোটবিহীন রাজনীতি দিনে দিনে এমন সব অংশীজন তৈরি করেছে, সেখানে কোটারি স্বার্থকেই বড় করে দেখা হচ্ছে। দেশের স্বার্থ নয়।

গত দেড় দশকে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের যে উন্নয়নক্রম, যে পরিকল্পনা, যে নীতি দর্শন- শুধু এই খাতকেই বিবেচনায় নিলে বোঝা যায় অগণতান্ত্রিকতা অথবা বিরাষ্ট্রীয়করণ কীভাবে দেশের সক্ষমতাকে বিপন্ন করেছে। মানুষ দিনকে দিন পয়সা বেশি দিচ্ছে কিন্তু সার্ভিস পাচ্ছে না। তার জ্বালানি নিরাপত্তা অন্যের ওপর নির্ভর করছে। জ্বালানি খাতের এই অপরিণামদর্শী উন্নয়নচেষ্টাকে মডেল হিসেবে দেখলে বোঝা যায় লুণ্ঠনতন্ত্র, অন্যায্য বাণিজ্যিকীকরণ কীভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে, দুর্বল-অগণতান্ত্রিক-ভোটবিহীন রাজনীতির দুর্বলতায়। তাই রাজনীতির ভাষা বদলের এইদিনে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। ভীষণভাবেই নজর রাখতে হবে, যাতে আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারি। আমাদের রাজনীতি যেন অন্যের হাতের ক্রীড়নক না হয়ে দেশের সক্ষমতা ও দেশহিতৈষী প্রবণতায় জেগে উঠতে পারে। কোনো অযাচিত সংঘাত, অপরিণামদর্শী আচরণ যেন নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের ঘুড়ির নাটাইকে হাতছাড়া করে না দেয়।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সিনিয়র সাংবাদিক।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status