ঢাকা, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সময় অসময়

পরকীয়া এক অর্থে তুষের আগুন, পোড়াচ্ছে স্বপ্ন এবং সংসার...

রেজানুর রহমান
৩১ মে ২০২৩, বুধবার
mzamin

একথা সত্য, সংসারে বিশ্বাসই হলো আসল। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা না থাকলে সেই সংসার টেকানো যায় না। পাশাপাশি অভিযোগ জিইয়ে রেখেও সংসার টেকানো যায় না। সে ক্ষেত্রে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে বিচ্ছেদ ঘটানোই ভালো। স্বামী অথবা স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও আপনি অন্যের সঙ্গে শরীর বিষয়ক সম্পর্ক গড়ে তুলবেন। এটা এক ধরনের প্রতারণা। তুষের আগুন। শরীরের সুখ খুঁজতে গিয়ে হয়তো একদিন দেখবেন পায়ের তলায় আর মাটিই খুঁজে পাবেন না। তুষের আগুন দেখা যায় না। এই আগুন ভেতরে ভেতরে সবকিছু পুড়িয়ে ফেলে।

বিজ্ঞাপন
তেমনই পরকীয়াও এক ধরনের তুষের আগুন। যার সঙ্গে সংসার করছেন কোনো কারণে তাকে আপনার ভালো না লাগতেই পারে। অন্যকে ভালো লাগছে। তবুও বর্তমান সঙ্গীর সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করুন। সম্ভব না হলে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিন। জীবন আপনার। কাজেই জীবনের লক্ষ্য আনন্দ-বেদনার পথ নির্ধারণ করার দায়িত্বও আপনার।

অপরাধীকে নয়। অপরাধকে ঘৃণা করো। তাহলেই অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে। এই কথাটি আমরা সহজেই বলে ফেলি। কার্যত এটি কথার কথা। অনেকে বাহবা নেয়ার জন্য প্রকাশ্যে বলি। কিন্তু কাজের বেলায় মোটেও গুরুত্ব দেই না। পরকীয়া অতি পরিচিত একটি শব্দ। ভীতিকরও বটে। এই শব্দটি সংসার ভাঙে, ভবিষ্যৎ নষ্ট করে, পারিবারিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে চরম প্রতিবন্ধক ‘পরকীয়া’ শব্দটি। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে পরকীয়ার দৌরাত্ম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। একই ছাদের নিচে বসবাস করা দুই নারী-পুরুষ একই বিছানায় বিপরীত মুখে শুয়ে পরকীয়া করছেন। একটা সময় এটি ছিল শহরের চিত্র। এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও নর-নারীর সম্পর্কে ‘পরকীয়া’ শব্দটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মোবাইল ফোনের সহজলভ্য ব্যবহার পরকীয়ার মূল শক্তি। আয়-রোজগারের উদ্দেশ্যে স্বামী অথবা স্ত্রী বিদেশে গেছে। দেশে অবস্থানরত স্ত্রী এবং স্বামী পরকীয়ায় লিপ্ত। এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে। আবার দেশেও কোনা কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতের মিল শুরু হলে, যৌন অতৃপ্তির কারণ দেখা দিলে, অথবা অর্থনৈতিক দৈন্যতায় পরকীয়ায় কাতর হচ্ছেন অনেকে। ফলে হঠাৎ করেই সুখের সংসার ভেঙে যাচ্ছে। পারিবারিক মূল্যবোধ নষ্ট হচ্ছে। তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় খুনের ঘটনাও ঘটছে। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমনই একটি খুনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম। প্রেমের বিয়ে। মেয়ে কলেজছাত্রী। ছেলে ছাত্ররাজনীতিসহ নানান সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। তাদের প্রেমের সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে মেয়ে পক্ষ অখুশি হয়। রাজনীতি করা ছেলে তাদের পছন্দ নয়। এই যখন অবস্থা তখন ছেলে-মেয়ে পরিবারকে না জানিয়েই বিয়ে করে ফেলে। মেয়ে থাকে মেয়ের বাড়িতে। ছেলে থাকে ছেলের বাড়িতে। দু’জনই স্বপ্ন দেখে একদিন নিশ্চয়ই পরিস্থিতি শান্ত হবে। তাদের বিয়েটা সবাই মেনে নিবে। এভাবেই দিন যায়, মাস যায়। বছর যায়। ছেলেটি হঠাৎ আবিস্কার করে তার স্ত্রী যেন আগের মতো আচরণ করছে না। একদিন স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে তার মোবাইল ফোন দেখতে চায়। স্ত্রী মোবাইল ফোন দিতে চায় না। স্বামী জোর করে স্ত্রীর মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে বাসায় চলে যায়। সন্দেহের ডালপালা বিস্তার করে এখান থেকে। স্ত্রীর মোবাইল ফোনে তার খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে অশ্লীল, আপত্তিকর সম্পর্কের ভিডিও আর কথোপকথন স্বামীকে যারপর নাই ক্ষুব্ধ করে তোলে। স্ত্রী তার ফোন ফেরত চায়। স্বামী তাকে পরের দিন একটি পার্কে আসতে বলে। স্ত্রী মোবাইল ফোন নেয়ার জন্য পার্কে আসে। স্বামী তাকে খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের ফোনালাপ ও ভিডিও দৃশ্য দেখিয়ে ছুরির আঘাতে দেহ ক্ষত বিক্ষত করে। স্ত্রী ঘটনাস্থলেই মারা যায়। 

এই ঘটনা খুবই দুঃখজনক। স্বামী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও অন্যের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়াবেন এটা মেনে নেয়া যায় না। তাই বলে তাকে খুন করার ঘটনাও কি সমর্থনযোগ্য? স্ত্রী পরকীয়ায় লিপ্ত। কাজেই আপনি তার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে পারেন। একইভাবে স্বামী পরকীয়ায় আসক্ত স্ত্রীরও অধিকার রয়েছে তাকে ত্যাগ করার। কিন্তু জীবন হরণ করার অধিকার কি তাদের আছে? অথচ উপরের হত্যাকাণ্ডটিকে সমর্থন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক মানুষ বক্তব্য দিয়েছেন। কী সাংঘাতিক ব্যাপার। প্রকাশ্যে খুনের ঘটনাকে সমর্থন করেছেন অনেকে। পরকীয়ার শাস্তি কি মৃত্যদণ্ড? কয়েকজনের মন্তব্য তুলে ধরতে চাই। একজন লিখেছেন, ঠিকই আছে, পরকীয়ার সঙ্গে জড়িত বলে মারছে। ভাই তোমাকে ধন্যবাদ। অন্যজন লিখেছেন, বাঘের বাচ্চা। সঠিক কাজ করেছেন ভাইয়া। আরেকজন লিখেছেন, সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করেছে। ছেলেটির মুক্তি চাই। অন্য আরেকজন লিখেছেন, এমন মেয়ে বেঁচে থাকলে অনেক পুরুষের জীবন নষ্ট করে দিতো। সঠিক কাজ করেছেন ভাইয়া। আরেকজন লিখেছেন, আমি হত্যাকে সাপোর্ট করি না। তবে এই ঘটনা শুনে আমার মনে হচ্ছে মেয়েটির সঠিক বিচার হয়েছে। এই ছেলেকে আমি সাপোর্ট করলাম। তাকে ছেড়ে দেয়া হোক। এরকম অসংখ্য কমেন্টস পড়লাম। একটাই প্রশ্ন মাথায় এলো- অপরাধীকে ঘৃণা নয় অপরাধকে ঘৃণা কর। এটা কী তাহলে আসলেই কথার কথা। মেয়েটি নিঃসন্দেহে অপাধ করেছে। তাই বলে তাকে হত্যা করতে হবে? এই প্রবণতার ভবিষ্যৎ কী? কেউ অপরাধ করলে তার জন্য আইন আছে। অথচ আইনের তোয়াক্কা না করে আমরা নিজেরাই যদি বিচারক হয়ে যাই তাহলে তো আশঙ্কার বিষয়। পরকীয়ার এই ঘটনার ব্যাপারে একজন লিখেছেন, মেয়েরা পরকীয়া করলেই দোষ। আর ছেলেরা পরকীয়া করলে দোষ নাই। হায়রে সমাজ, হায়রে বিচার। অন্য একজন লিখেছেন, পরকীয়া আমাদের পরিবারগুলোর জন্য অনেক বড় হুমকি। পরকীয়া শত শত ফ্যামিলির ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিচ্ছে। ডিভোর্সের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। আল্লাহ সবাইকে হেদায়েত করুক... 

একথা ঠিক পরকীয়ার কারণে প্রায় প্রতিদিন দেশের অনেক পরিবার নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ডিভোর্সের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। পরকীয়ার কারণে হত্যাকাণ্ডের মতো উদ্বেগজনক ঘটনাও ঘটছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কূ-প্রভাবকে এজন্য দায়ী করা হচ্ছে। অতীতকালে মনের ভাব আদান প্রদানের জন্য চিঠি এবং ল্যান্ড টেলিফোনই ছিল একমাত্র ভরসা। আর এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে মুহূর্তের মধ্যে একজন অন্যজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। ফলে সামান্য মন খারাপের ঘটনাও ফেসবুকে স্থান পায়। ‘আমার মন ভালো নেই’। এই একটি মেসেজই জাদুর কাঠি হয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে মন খারাপের জন্য সমবেদনা জানালো মানুষের লম্বা লাইন পড়ে যায়। অনেকে এমনভাবে সমবেদনা ও সহানুভূতি জানাতে শুরু করেন যে, মনে হবে তার চেয়ে আপন আর কেউ নেই। কতো কথা। সবই মিষ্টি ছড়ানো। আমি আছি আপনার সঙ্গে। তারপর আপনি থেকে তুমি... এক সময় শুরু হয় সম্পর্কের অনৈতিক চর্চা। তখন কাছের মানুষকে আর কাছের মনে হয় না। তাকে ভিলেন মনে হয়। থাকবো না আর তোমার সঙ্গে। সামান্য কথায় ডিভোর্স... এ যেন অনেক স্বাভাবিক ঘটনা। 

একথা ঠিক, যুগ পাল্টেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে পরিবার, সংসার ও সামাজের দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টে গেছে। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় পারস্পরিক নির্ভরতা কমে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল স্বামীর আয় রোজগারের ওপর স্ত্রীকে নির্ভরশীল থাকতে হতো। ফলে স্বামী অপরাধ করলেও স্ত্রী তা মুখ বুজে সহ্য করতেন। বর্তমান সময়ে চাকরি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে একটা সমতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে পারস্পরিক নির্ভরতা অনেকটাই গুরুত্ব হারাচ্ছে। ঠুনকো কারণে সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হচ্ছে। আমি কি তোমার খাই না পড়ি? কখনো কখনো নারীর এই একটি সংলাপই সংসার ভাঙনের খারাপ প্রবণতাকে উসকে দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পুরুষ তার পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় স্ত্রীর প্রতি অন্যায় আচরণ করছে। ফলে অতি সহজেই সংসার ভেঙে যাচ্ছে। 

একথা সত্য, সংসারে বিশ্বাসই হলো আসল। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা না থাকলে সেই সংসার টেকানো যায় না। পাশাপাশি অভিযোগ জিইয়ে রেখেও সংসার টেকানো যায় না। সে ক্ষেত্রে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে বিচ্ছেদ ঘটানোই ভালো। স্বামী অথবা স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও আপনি অন্যের সঙ্গে শরীর বিষয়ক সম্পর্ক গড়ে তুলবেন। এটা এক ধরনের প্রতারণা। তুষের আগুন। শরীরের সুখ খুঁজতে গিয়ে হয়তো একদিন দেখবেন পায়ের তলায় আর মাটিই খুঁজে পাবেন না। তুষের আগুন দেখা যায় না। এই আগুন ভেতরে ভেতরে সবকিছু পুড়িয়ে ফেলে। তেমনই পরকীয়াও এক ধরনের তুষের আগুন। যার সঙ্গে সংসার করছেন কোনো কারণে তাকে আপনার ভালো না লাগতেই পারে। অন্যকে ভালো লাগছে। তবুও বর্তমান সঙ্গীর সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করুন। সম্ভব না হলে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিন। জীবন আপনার। কাজেই জীবনের লক্ষ্য আনন্দ-বেদনার পথ নির্ধারণ করার দায়িত্বও আপনার। ‘পরকীয়া’ হলো সম্পর্কের লুকোচুরি খেলা। কিন্তু জীবন তো লুকোচুরি খেলার অংশ নয়। জীবন সুন্দর। তবে জীবনকে গড়ে নিতে হয়। শুভ কামনা সবার জন্য।   

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।  

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status