নির্বাচিত কলাম
জিয়াঃ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ
ড. মারুফ মল্লিক
৩০ মে ২০২৩, মঙ্গলবার
সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানে ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৮১ সালের ৩০শে মে তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। সেনাবাহিনীর একদল সদস্য রাতের অন্ধকারে জিয়াউর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ইতিহাসে জিয়াউর রহমানকে নানাভাবে চিত্রায়িত করা যায়। মুক্তিযোদ্ধা, শাসক ও অর্থনৈতিক সংস্কারক। দেশে কৃষিকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বদলে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতা উত্তরকালে মূলত জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই শক্ত ভিত্তি খুঁজে পায় বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নতুন পথের দিশা খুঁজে পায় বাংলাদেশ।
জিয়ার গৃহীত বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মসূচির কারণে বাংলাদেশ ক্রমেই তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে আশ্চর্যজনক সাফল্যে পরিপূর্ণ ঝুড়িতে পূর্ণ হয়। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজ থেক শিক্ষিত নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির সৃষ্টি হতে থাকে।
অর্থনীতির গতিশীলতা নানাভাবে সাংস্কৃতিক জীবনকে প্রভাবিত করে। জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অন্যতম সাংস্কৃতিক অবদান হচ্ছে সাড়ম্বরে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করা। অনেকেই বলতে পারেন, পহেলা বৈশাখ হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির অংশ। অবশ্যই পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিফলন। কিন্তু বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ গত শতকের ৮০’র দশকে মধ্যবিত্তের বিশেষ করে শহরকেন্দ্রীক জনগোষ্ঠীর যে অর্থনৈতিক ভিত গড়ে দিয়েছিল তার সাংস্কৃতিক উদ্যাপন হচ্ছে পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ জুড়ে এখন যে উৎসাহ, উদ্দীপনা ও উন্মাদনার সৃষ্টি হয় সমাজের সর্বস্তরে তা খুব বেশিদিনের পুরনো না। আগে দেশের অনেক মানুষ ঈদে বা পূজাতেও নতুন জামা কিনতে পারতো না। এখন পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যেই পোশাক বাজারে যে পরিমাণ আর্থিক লেনদেন তা অবশ্যই নতুন সংস্কৃতি নির্মাণ ও আর্থিক সক্ষমতার উদাহরণ। এমনকি পহেলা বৈশাখ তারিখটিও খুব বেশি পুরনো না। পহেলা বৈশাখ নিয়ে নানা ধরনের মতামত আছে। সম্রাট আকবর নতুন বাংলাবর্ষের সূচনা করেছিলেন। এখন যে দিনটিতে পহেলা বৈশাখ পালিত হয় এর আগে পরে ঋতু অনুসারে অন্য পার্বন বা উৎসব পালিত হতো। কিন্তু ঘটা করে ১লা বৈশাখ পালনের রেওয়াজ ছিল না। এক সময় পহেলা বৈশাখে শুভ হালখাতা পালন করতো বণিক সম্প্রদায়ের লোকজন। কিন্ত পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে বর্ণিল, বিশাল উদ্যাপন পুরোপুরি বাংলাদেশের সৃষ্টি। বর্ণাঢ্য, বর্ণিল এক উৎসবে পরিণত হয়েছে পহেলা বৈশাখ। বাংলাদেশ নিজের মতো করে এই উৎসব পালনের প্রক্রিয়া নির্মাণ করেছে।

বাংলাদেশ সামাজিক রূপান্তরের অন্যতম উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। অর্থনীতি, সংস্কৃতি সবদিকেই বাংলাদেশের নিজস্ব পরিচয় গড়ে উঠছে। দেশের নারীদের তৈরি পোশাক এখন সারাবিশ্বেই সমাদৃত হচ্ছে। অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায়, কৃষি উৎপাদন, ইলিশের উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন যে কারও জন্য উদাহরণ। প্রবাসী শ্রমিকরা আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের অন্যতম ভরসার নাম। এসবই নতুন নিজস্ব পরিচয় নির্মাণের প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক লড়াইয়ে যে নতুন পরিচয় গঠিত হয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে সাফল্য স্বতন্ত্রভাবে তা বিশ্বের সামনে তুলে ধরে। ১৯৪৭ এর পূর্বে বা এরপর পূর্ব বাংলার জনসাধারণের যে পচিয়ের সংকট ছিল সেখান থেকে তাঁরা বের হয়ে এসেছে। এই অঞ্চলের অধিবাসীদের নতুন পরিচয় হচ্ছে এরা সবাই বাংলাদেশি। অন্তভুঁক্তিমূলক, বহুত্ববাদী বাংলাদেশকে ঘিরেই এর যাবতীয় সবকিছু আবর্তিত হচ্ছে।
প্রায়োগিক পন্থা ও বিভিন্ন কর্মসূচির আলোকে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ হিসেবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে বিবেচনা করা যায়। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্র গঠনের প্রবণতা এই জাতীয়তাবাদে পরিষ্কারভাবে লক্ষ্য করা যায়। রাষ্ট্রগঠনের প্রক্রিয়ার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে। আর এই জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক হিসেবে অবধারিতভাবেই জিয়াউর রহমানের নাম চলে আসে।
দেশের ইতিহাসে আলোচিত শাসকের নাম জিয়াউর রহমান। রাজনীতির এক অনিশ্চিত ও অস্থির মুহূর্তে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হন। তখন অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেছিলেন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আদৌ টিকবে কিনা। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারবেন কিনা। পরিস্থিতি কঠিন হলেও জিয়াউর রহমান দক্ষতার সঙ্গেই সব সামলে উঠেন। অথচ ১৯৭৬ সালে নিউজিল্যান্ড ইন্টারন্যশনাল রিভিউতে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ঐতিহাসিক গওহর আলী মন্তব্য করেছিলেন, জিয়া সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিলেও শেষ পর্যন্ত কুলিয়ে উঠতে পারবেন না। ওই প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন, সামরিক বাহিনী মূলত ৪ ভাগে বিভক্ত ছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসারী ও রক্ষীবাহিনী থেকে আসা অংশ, জিয়ার অনুসারী, পাকিস্তান প্রত্যাগত অংশ ও জাসদপন্থি দল।
এ রকম নানা ধারণা, প্রশ্ন, সমালোচনা, প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র- সবকিছু সামলে নিয়েই প্রায় ৫ বছর দেশ শাসন করেছেন জিয়াউর রহমান। তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ দেশের রাজনীতিতে নিজস্ব একটি ধারা তৈরি করতে পেরেছিল। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণা মানুষ গ্রহণ করেছিল। ১৯০৫ সালে এই অঞ্চলের মানুষের রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা জিয়াউর রহমানের হাত ধরে পরিপূর্ণতা লাভ করে। তবে এই অঞ্চলে গড়ে উঠা মুসলিম জাতীয়তাবাদ বা বঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদ নিজস্ব সংকীর্ণ অবস্থানের কারণে ব্যর্থ হয়েছিল। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ আগের দুই জাতীয়তাবাদকে প্রতিস্থাপন করেছিল বহুত্ববাদীতা দিয়ে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এই ভূখণ্ডের মানুষের নিজস্ব পরিচয় গঠিত হয়।
এখানেই জিয়াউর রহমান বা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কৃতিত্ব। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ তথা জিয়াউর রহমানকে নানাভাবে চিত্রায়িত করা হয়। শত সমালোচনা ও নিন্দামন্দের পরও জিয়াউর রহমান ও তার হাতে গড়া দল বিএনপির প্রতি বড় একটি অংশের সমর্থন আছে। এর কারণ কী? এই প্রশ্নের অনেকগুলো উত্তর হতে পারে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে দেশের অর্থনীতির ভিত গড়ে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। যে পোশাক শিল্প ও রেমিট্যান্সের উপর দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে তার শুরু হয়েছিল জিয়াউর রহমানের আমলেই। ইতিহাসের আতশী কাঁচের নিচে ফেলে যদি জিয়াউর রহমানকে বিশ্লেষণ করা হয় তবে নেতিবাচক আচরণগুলোর পাশাপাশি তার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের বিষয়গুলোও বেরিয়ে আসবে। নানা অভিযোগ থাকার পরও মূলত এসব সংস্কারমূলক কর্মসূচি দিয়েই জিয়াউর রহমান সম্ভবত উৎরে গিয়েছেন। আর এসবের মূলে ছিল বহুত্ববাদী বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের দার্শনিক ধারণা। জিয়াউর রহমান সফলভাবে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদকে বাংলাদেশি জাতীয়বাদের মোড়কে প্রয়োগ করেছিলেন। রাষ্ট্র গঠনের পরও জাতীয়তাবাদ গঠন সম্ভব এবং এর সফল প্রয়োগ করা যায় এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। যেকোনো রাজনীতিবিদ, শাসক, রাজনৈতিক ধারণা ও তত্ত্ব আলোচনা থাকবেই। বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে এসব চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও জিয়াউর রহমানকে নিয়েও আলোচনা, সমালোচনা ছিল আছে এবং থাকবে। তবে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ হিসাবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বাস্তবায়ন করতে জিয়াউর রহমান সফল হয়েছিলেন এবং ইতিহাসে ভাস্বর হয়ে থাকবেন। এক্ষেত্রে কিউবার বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোর একটি বক্তব্য স্মার্তব্য। তিনি বলেছেেিলন ‘আমার নিন্দা করুন তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে।’
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠকের মতামত
মাওলানা ভাসানী সাহেব একবার বলেছেন বহুদিন পর একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক মানুষ কে দেখলাম যে তার নিকট আত্মীয় স্বজন কে ও কাছে ভিড়তে দেয় নাই।সৎ থেকে দেশ পরিচালনার জন্য পরিশ্রম করছেন। গ্রামিন উন্নয়নে খাল কেটে চেস ব্যাবস্থায় কৃষি বিপ্লবের চেষ্টা করেছেন যার জন্য হাজার হাজার মাইল পথ পায়ে হেঁটেছেন। এই মানুষটির সকল নেক আমল আল্লাহ কবুল করুন। মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম কে জান্নাত দান করুন।
দেশ স্বাধীনের পরে বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক ভিত্তি, বহুদলীয় গনতন্ত্র সেটা শহীদ জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই এসেছে। মহান আল্লাহ পাক উনাকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। আমিন।
জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র সফল রাস্ট্রনায়ক। এদেশের উন্নয়নের সপ্নদ্রষ্টা। এত অল্প সময়ে এতকিছু করেছিলেন যেটা কল্পনার বাইরে। মনেপরে বাঙ্গালীকে ছাতু খাওয়ার বদলে ভাতের ব্যবস্থা করেছিলেন। রেশন শপগুলো একে একে বন্ধ হয়েছিল। অর্থাত রাস্ট্রীয় দুঃসাশনের অবসান হয়েছিল খুব দ্রুত।
শহীদ জিয়া একজন বীর, একজন মেজিক্যাল রাষ্ট্রনায়ক। বাংলাদেশের মানুষ জিয়াকে স্মরণ করবেই। আমাদের এখন একজন জিয়ার খুব দরকার!
"যে পোশাক শিল্প ও রেমিট্যান্সের উপর দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে তার শুরু হয়েছিল জিয়াউর রহমানের আমলেই।" ঐতিহাসিক সত্য। কেবল এ'দউটই খাতে নয় কৃষিতেও নূতন যুগের সূচনা করেছিলেন। জিয়া মাত্র ৫ বছর সময় পেয়েছিলেন। এই সময়েই আধুনিক বাংলাদেশের ভিত্তি রচিত হয়েছিল। এরপর গত ৪০ বছর যাবত জিয়ার গড়ে তোলা অর্থনীতির সম্প্রসারণ হয়েছে। রাজস্ব ও আর্থিক খাতে নূতন কিছু সংযোজন যেমন ভ্যাট খালেদা জিয়ার হাতে সংযোজিত হয়। এর মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা বাংলাদেশের শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর মেগাপ্রজেক্ট অর্থনীতি উন্মোচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনামলে তার প্রয়োগ শুরু হলেও খেয়ালী পরিকল্পনা, মেগা দূর্ণীতি ও কৌশলগত ভুল আজ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সংকটের মুখে ফেলেছে।
জিয়া দুইটা কঠিন সময়ে দেশের হাল ধরেছিলেন। রাজনীতিবিদেরা যখন স্বাধীনতার ঘোষনা দিতে পারছিলোনা। তখন তিনি সেটা করেছিলেন। আবার রাজনীতিবিদের অপসাশনে যখন দেশে চরম দূর্ভীক্ষাবস্থা তখন আবার এই জিয়াই দেশের হাল ধরেছিলেন।