নির্বাচিত কলাম
বেহুদা প্যাঁচাল
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জামাল তত্ত্ব গাজীপুরে সাংবাদিকের চোখ বাঁধা এবং তেজপাতা কাহিনী
শামীমুল হক
২৫ মে ২০২৩, বৃহস্পতিবার
সংবিধানে কিন্তু আছে যদি কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকে তার কারণে নির্বাচন পিছিয়ে দিতে পারে। তারপর সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো প্রকার জাতীয় ঐকমত্য নেই। তারা হিংসা ও হানাহানির পথ বেছে নিয়েছে। অন্যদিকে করোনা মহামারি আমাদের অর্থনীতির চাকা উল্টো দিকে নিয়ে গেছে। এর ফলে আমি বলেছিলাম যে, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইলেকশনকে পিছিয়ে দেয়া যায়। এ ছাড়া এই সরকার সংবিধান সংশোধন করে আইন পাস করে তার মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে পারে। কমপক্ষে দুই বছর তো নিতেই পারে। কারণ দুই বছর সমস্ত কিছু প্যারালাইজড ছিল। মানুষকে নিয়ে আমরা শুধু হাসপাতালেই দৌড়িয়েছি। এই বিষয়গুলো বিবেচনা করার জন্য বলেছিলাম দুই বছর হলেও নির্বাচন পিছিয়ে দিতে পারে।
পাঁচ বছর তো সবাই ঐকমত্য হলে করতে পারে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যার মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়, সেই নির্বাচন যদি ঐকমত্যের ভিত্তিতে না হয়, সরকার ও বিরোধী দল যদি ঐকমত্যে না আসে সেখানে কিন্তু সংঘাত-হানাহানির সম্ভাবনা থেকেই যায়বিজ্ঞাপন
আচ্ছা বলুন তো দেখি কোন জিনিসটি সুন্দর করে রান্নাবান্না করার পর না খেয়ে আমরা ফেলে দেই। আর কেনইবা তা ফেলে দিতে হয়? অথচ এ জিনিসটি না হলে রান্নাই অপূর্ণ থেকে যায়। অর্থাৎ এ পণ্যটি অপরিহার্য। কিন্তু রান্নার পর তা ফেলনার বস্তুতে পরিণত হয়। তাই না ফেলা ছাড়া উপায় নেই। তাহলে পণ্যটি কি? এক কথায় উত্তর দিলে তা হলো- তেজপাতা। হ্যাঁ, তেজপাতাকে সুন্দর করে ধুয়ে তা বিশেষ বিশেষ রান্নায় ব্যবহার করা হয়। তেজপাতা না দিলে ওই খাবারের ঘ্রাণই হয় না। তাই রান্নার আগে এর কদর থাকে সবার কাছে অন্যরকম। কিন্তু রান্নার পর তেজপাতাকে সবাই ফেলে দেয়। আসলে এই তেজপাতার কাজই হলো রান্না পর্যন্ত। কাজ শেষে তা ফেলনা বস্তু হয়ে যায়। আমাদের সমাজেও এমন অনেকে তেজপাতা হিসেবে ব্যবহৃত হন। বিশেষ করে রাজনীতিতে এর উদাহরণ ভূরিভূরি। শুধু কি রাজনীতিতে? না! সবক্ষেত্রে, সব জায়গায় কিছু মানুষ তেজপাতা হিসেবে ব্যবহৃত হন। কাজ শেষে তাদের ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়।

আজ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। ভোট গ্রহণ। এ নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের আজমত উল্লা খান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। এই জায়েদা আলোচনায় এলেন কীভাবে? কারণ তিনি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা। আর জাহাঙ্গীর গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিন বছর যেতে না যেতেই তাকে খসে পড়তে হয়। চেয়ারহীন হতে হয়। এ ক্ষোভ থেকেই জাহাঙ্গীর আলমও মনোনয়নপত্র নিয়েছিলেন। জমাও দিয়েছিলেন। কিন্তু তার মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এ নিয়ে তিনি আদালত পর্যন্ত যান। কিন্তু বৈধ করে আনতে পারেননি। এমনটা হতে পারে ভেবেই হয়তো জাহাঙ্গীর তার মা জায়েদা খাতুনের নামে মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন। তা জমাও দেন। ছেলে জাহাঙ্গীরের মনোনয়নপত্র বাতিল হলেও মা জায়েদা খাতুন টিকে যান। টিকলে কি হবে? প্রচার প্রচারণা চালাতে গিয়ে তিনি বাধার মুখে পড়ছেন। তার প্রচারণার গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এমন অভিযোগ তিনি সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন। এখানে আন্দাজ করা যায়, জায়েদা খাতুন ডামি প্রার্থী। অপ্রকাশ্যে মূল প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম। এখানেই হলো সমস্যা। যে যাই বলুক জাহাঙ্গীর এলাকায় জনপ্রিয়। এটা অস্বীকার করার কোনো জো নেই। এ ছাড়া গাজীপুর আওয়ামী লীগে গ্রুপিং রয়েছে। সব মিলিয়ে আজকের নির্বাচন নিয়ে উত্তাপ ছড়িয়েছে গাজীপুর সিটির সর্বত্র। অবশ্য নির্বাচন কমিশন বলছে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর হবে। প্রতিটি কেন্দ্রে সিসিটিভি থাকবে। ঢাকায় বসে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আওয়ালের নেতৃত্বে সকল কমিশনার ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তা, সাংবাদিকরা ভোটগ্রহণ উপভোগ করবেন। কোনো অনিয়ম হলে এখান থেকেই ব্যবস্থা নেবেন। এমন ব্যবস্থা গাইবান্ধা-৫ আসনেও নেয়া হয়েছিল। সারা দেশ চমকে গিয়েছিল। এ নিয়ে তদন্তও হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি হয়েছে কেউ জানে না। দেশবাসী জানে, সেখানে আবার নির্বাচন হয়েছে। আগে যার লোকজনের অনিয়মের কারণে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছিল, তিনিই জয়ী হয়েছেন। নির্বাচন কমিশন গাজীপুরের ক্ষেত্রেও কঠোর বার্তা দিয়ে রেখেছেন। কমিশনার মোহাম্মদ আলমগীর তো বলেছেনই কঠোর অ্যাকশনের কথা। আপাতত তার কথায় বিশ্বাস রেখে অপেক্ষায় থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আজকের ঘটনা প্রবাহই বলে দেবে কমিশনার আলমগীরের কথা কতোটুকু বাস্তবসম্মত ছিল। তবে এটা সত্য যত সহজে বলা যায়, তা করিয়ে দেখানো অনেক কঠিন। কুমিল্লার নির্বাচন উদাহরণ হিসেবে রয়েছে। এ ছাড়া যেখানে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-মুক্ত করা হয়েছে। সেখানে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কেন ইভিএম-যুক্ত করা হলো? এর পেছনে কোনো রহস্য রয়েছে কি? কান পাতলেই নির্বাচন কমিশন মানুষের অভিব্যক্তি শুনতে পাবে। কিন্তু এ কান পাতার সময়ই হয়তো নেই কমিশনারদের। তাই তো জায়েদা খাতুন যখন অভিযোগ আনেন তার গাড়িতে হামলার। তখন নির্বাচন কমিশনার আলমগীর ঢাকায় বসে জবাব দেন কই কোনো পত্রিকায় তো গাড়ি ভাঙার একটি ছবিও দেখিনি।
ওদিকে আজকের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাংবাদিকদের হাত ও পা বেঁধে মাঠে নামতে দেয়া হয়েছে। ভোট পর্যবেক্ষণে বেশ কিছু নিয়ম যুক্ত করেছে নির্বাচন কমিশন। যা সাংবাদিকদের মানতে হবে। নির্বাচন কমিশনের দেয়া পর্যবেক্ষক পাস কার্ডে এসব শর্ত লিখে দেয়া হয়েছে। শর্তের মধ্যে আছে, কোনোভাবেই ভোটপ্রদান গোপন কক্ষে প্রবেশ করতে বা ছবি তুলতে পারবেন না তারা। একসঙ্গে দুই জনের বেশি সাংবাদিক ভোটকক্ষে প্রবেশ করতে এবং ১০ মিনিটের বেশি সময় অবস্থান করতে পারবেন না। ভোটকক্ষ থেকে কোনো মাধ্যমেই সরাসরি-সংবাদ সম্প্রচার করা যাবে না। ভোটকক্ষে নির্বাচনী কর্মকর্তা, নির্বাচনী এজেন্ট বা ভোটারদের সাক্ষাৎকার নিতে পারবেন না। কোনো নির্বাচনী সামগ্রী স্পর্শ করতে পারবেন না এবং ভোটগ্রহণ কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে এমন কোনো কাজ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে করতে পারবেন না। কোনো দলের বা প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা বা কাজ করতে পারবেন না। এসব শর্ত দেখে আম পাবলিক বলছেন, তাহলে সাংবাদিকদের অনুমতি দেওয়ার দরকার কি ছিল? ওরা কি ওখানে গিয়ে বোবার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখবে। এজেন্ট, ভোটার, নির্বাচন কর্মকর্তা এদের সাক্ষাৎকার না নিলে ভোট কেমন হচ্ছে তা বুঝবে কিভাবে? অবশ্য এসব শর্ত শিথিল করার কথা আগে জানিয়েছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। সিইসি কি কথা রেখেছেন? প্রশ্ন জাগে এখানকার কোন শর্তটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের সহায়ক?
যাই হোক, গাজীপুর সিটি করপোরেশন সহ পাঁচ সিটি করপোরেশন নিয়ে যখন দেশজুড়ে আলোচনা তখন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়াই সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আ ক ম জামাল উদ্দীন। মানবজমিন ডিজিটালের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারেও তিনি দু’দিন আগে দেয়া এ বক্তব্য খণ্ডন করেছেন। বলেছেন জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন আরও পাঁচ বছর পিছিয়ে দেয়া যায়। তার কথা-অন্তত দুই বছর তো পিছিয়ে দেয়া যায়। ড. জামাল উদ্দীনের কথা দুটি বছর দেশের সমস্ত কিছু প্যারালাইজড ছিল। করোনার কারণে আমাদের অর্থনীতির চাকা পেছনে চলে গেছে। এমন একটা ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এই ধরনের একটা জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা, আমরা মনে করি সেটা আমাদের জাতীয় অগ্রগতি এবং উন্নয়ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সব কিছুর উপর একটা বাড়তি চাপ হিসেবে আবির্ভূত হবে। এ ছাড়া নির্বাচনে সরকারের তো একটা খরচ আছেই। সেটা এক দুই হাজার কোটি টাকা খরচ হবে জাতীয় নির্বাচনে। তাতে যদি আমাদের প্রার্থীদের ক্যাম্পেইন, মনোনয়ন চাওয়া, তারপর আমাদের একটি দলের নেতা আছেন বিদেশে। তারা ঘন ঘন প্লেনে করে নেতার সঙ্গে দেখা করতে যাবে। বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা যাবে। নমিনেশনের জন্য লবিং করবে লন্ডনে গিয়ে। এতে বহু ফরেন কারেন্সি বিদেশে চলে যাবে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। যদি শত শত লোক লন্ডনে ভিজিট করতে থাকে তাহলে সেখানে কিন্তু আমাদের ফরেন কারেন্সির উপর একটা চাপ পড়বে। কিছুদিন আগে আমাদের ডলার ক্রাইসিস ছিল, এখনো ডলারের দাম হু হু করে বাড়ছে। ৮৫ টাকা থেকে ডলার এখন ১১০ টাকা পর্যন্ত হয়ে গেছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন...। আমাদের সংবিধানে কিন্তু আছে যদি কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকে তার কারণে নির্বাচন পিছিয়ে দিতে পারে। তারপর সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো প্রকার জাতীয় ঐকমত্য নেই। তারা হিংসা ও হানাহানির পথ বেছে নিয়েছে। অন্যদিকে করোনা মহামারি আমাদের অর্থনীতির চাকা উল্টো দিকে নিয়ে গেছে। এর ফলে আমি বলেছিলাম যে, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইলেকশনকে পিছিয়ে দেয়া যায়। এ ছাড়া এই সরকার সংবিধান সংশোধন করে আইন পাস করে তার মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে পারে। কমপক্ষে দুই বছর তো নিতেই পারে। কারণ দুই বছর সমস্ত কিছু প্যারালাইজড ছিল। মানুষকে নিয়ে আমরা শুধু হাসপাতালেই দৌড়িয়েছি। এই বিষয়গুলো বিবেচনা করার জন্য বলেছিলাম দুই বছর হলেও নির্বাচন পিছিয়ে দিতে পারে। পাঁচ বছর তো সবাই ঐকমত্য হলে করতে পারে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যার মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়, সেই নির্বাচন যদি ঐকমত্যের ভিত্তিতে না হয়, সরকার ও বিরোধী দল যদি ঐকমত্যে না আসে সেখানে কিন্তু সংঘাত- হানাহানির সম্ভাবনা থেকেই যায়।
প্রফেসর জামাল তত্ত্ব নিয়ে সরকার কিংবা বিরোধী দল এগুবে কিনা সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু করোনা মহামারির জন্য পৃথিবীর কোনো দেশের নির্বাচন পিছিয়ে গেছে- এমনটা এখনো শোনা যায়নি। অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দীন যেসব উদাহরণ টেনেছেন নির্বাচন পেছানোর জন্য তা যুৎসই নয়। বরং তিনি বিরোধী দল বিএনপি’র প্রতি মায়াটা একটু বেশিই দেখিয়েছেন বলে মনে হয়। কারণ নমিনেশনের জন্য লবিং করতে বিএনপি নেতাদের লন্ডন উড়ে যেতে হবে। এতে তাদের টাকা খরচ হবে। ফরেন কারেন্সি দেশ থেকে চলে যাবে। এসব নিয়ে তার ভাবনা অমূলকই ঠেকেছে। তাছাড়া তিনি জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে কথাটি বলেছেন। তিনি কি দেখতে পাচ্ছেন জাতীয় ঐকমত্যের লেশমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেই। যেখানে জাতীয় ঐকমত্য নেই, সেখানে এমন কথা বলা মানে হলো অরণ্যে রোদন। আর যদি তিনি এটাকে ইস্যু বানাতে চান তাহলে অন্য কথা। জনাব, জামাল উদ্দীনের যেকোনো তত্ত্ব নিয়ে হাজির হলেই চলবে না। দেখতে হবে এ তত্ত্ব কতোটুকু যৌক্তিক। কতোটুকু গণতান্ত্রিক।