নির্বাচিত কলাম
সরল সম্ভাষণ
বাঙালির ব্যবসায়িক জ্ঞানবৃদ্ধি ও জাঁতাকলে পিষ্ট অসহায় মানুষ
টুটুল রহমান
২৪ মে ২০২৩, বুধবার
দ্রব্যমূল্যের কথা উঠলে ব্যবসায়ীরা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত দেন। কিন্তু আমদানিনির্ভর নয় এমন পণ্যের দাম কেন বাড়বে এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের কাছে কোনো জবাব নেই। এ কারণেই হয়তো অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ বলেছিলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সমস্ত ব্যয়ভার আমরা বহন করছি। পত্র-পত্রিকা পড়লেই, গুগলে সার্চ করলে আজ সব তথ্যই বেরিয়ে আসে। পাশের দেশগুলোতে নিত্যপণ্যের দাম কেমন সেটাও জানা যায়। সুতরাং যুদ্ধের দোহাই দিয়ে, গ্যাস-বিদ্যুতের দোহাই দিয়ে পণ্যের দাম বাড়ানোর এখন আর খুব একটা ‘মার্কেট’ পায় না। সাধারণ মানুষ এখন বুঝতে পারে বাজারে চলছে অনিয়ন্ত্রিত লুটপাট। তারা এই লুটপাটের নিরসন চায়। চায় স্বস্তিতে জীবনধারণ করতে।
বাঙালির ব্যবসায়িক জ্ঞান নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলি রস করেছিলেন একবার। কলকাতার কোনো এক বাজার।
বিক্রেতা রাগত হয়ে বললেন, ওটা বিক্রির জন্য নয়? বিফল মনোরথে ক্রেতা ফিরে এলেন, দোকানি আবার চোখ মুদলেন।
গল্পে বাঙালি ব্যবসায়ীর অলসতা বুঝাতে চেয়েছেন মুজতবা আলি। ঘুম নষ্ট করে হাতটা বাড়িয়ে সাবানটা ক্রেতার হাতে তুলে দেয়ার কাজটা করতেও সে রাজি নয়। ব্যবসা চুলোয় যাক।
না এই ব্যবসায়ীকে আর আপনি বাংলার জমিনে কোথাও খুঁজে পাবেন না। বাঙালি ব্যবসায়ীরা এখন অনেক স্মার্ট। তারা ঘুমায় না। রাতদিন পরিশ্রম করে। কিন্তু সেটা ভিন্ন পরিশ্রম। চুরিবিদ্যা অর্জনের পরিশ্রম।
তারা সন্তানদের বিবিএ-এমবিএ পড়িয়ে আনেন বিদেশ থেকে। বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে আসেন তারা। বিজনেস আইকন, বিজনেস লিডার, সেরা উদ্যোক্তা, রাষ্ট্রীয় সম্মাননা, পদক, সিআইপি, ভিআইপি, সেরা করদাতা- কতো ধরনের পুরস্কার যে তাদের শোকেসে দেখতে পাওয়া যায় তার ইয়ত্তা নেই। তারা শিখে কি করে ইউরিয়া সার ব্যবহার করে মুড়িটাকে ধবধবে সাদা বানাতে হয়। চুলার ছাই প্যাকেটজাত করে কি করে সুপারশপে রাখা যায়।
অপক্ক ফল কি করে পাকাতে হয়। পাকা ফল কি করে ফরমালিন মাখিয়ে তাজা রাখা যায়। নকল ওষুধে কি করে বাজার সয়লাব করে দেয়া যায়।

এই ব্যবসায়িক জ্ঞান বলতে গেলে এখন বাঙালি ব্যবসায়ীদের টনটনে। আরও জ্ঞান আছে। উৎসবে, মৌসুমে কোন জিনিসের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মুনাফা পকেটস্থ করা। ন্যায়-নৈতিকতা ভুলে গিয়ে মানুষকে কষ্ট দেয়ার সমস্ত বিদ্যা অর্জন করে ফেলেছে আমাদের ব্যবসায়ীরা। আবার এগুলো বলতে যান দেখবেন বড় ব্যবসায়ীরা দুষছে ছোট ব্যবসায়ীকে। আর ছোট ব্যবসায়ী বড় ব্যবসায়ীকে, খুচরা পাইকারকে, পাইকার খুচরাকে। বিরাট এক সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে সাধারণ ক্রেতরারা নাস্তা-নাবুদ হয়ে যাচ্ছে। নীরবে চোখের পানি ফেলছে। অভিশাপ দিচ্ছে। হাহাকার করছে। সংশ্লিষ্টরা শুনেও না শোনার ভান ধরে আছে। মাঝে-মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিছু হুঙ্কার দিচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় হুঙ্কার দিচ্ছে। কিন্তু সেই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তাদের হুঙ্কারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাদের কাজ করে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের পকেট ঝেড়ে দিচ্ছে।
জ্ঞান আরও আছে। ব্যাংক ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার ফন্দি-ফিকির তারা শিখেছে। ভুয়া এলসি খুলে বিদেশে অর্থ পাঠানোর কৌশল তারা রপ্ত করেছে। বাজেটের আগে কোন সুরে, কার কাছে গিয়ে কেঁদে কেটে ট্যাক্স কমাতে হবে বাঙালি ব্যবসায়ীর সেই জ্ঞান দেখে এখন বিস্মিত হই।
আরও অবাক লাগে মোটা চাল ছেঁটে চিকন করে মুনাফা করার জ্ঞানও বাঙালি পেয়ে গেছে। এমনকি মিডিয়ার মধ্যেই ঢুকে পড়ে নিত্যনতুন পত্রিকা বাজারে এনে হাজার হাজার সাংবাদিকদের বেকার করে দিয়ে কমসংখ্যক লোকবল দিয়ে দলের মুখপত্রের মতো পত্রিকা-টিভি চালাচ্ছেন। ব্যবসায়ীদের মুনাফা লুটে নেয়ার স্বর্ণখনিতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ।
আমরা বিস্মিত হই এরাই বলেন, ব্যাংক খাত সংকটের মধ্যে আছে। কোনো ব্যবসা নাই। অথচ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কোটি টাকার ইভেন্ট করেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে শীত-বর্ষায়, খরায়-বন্যায় কোটি কোটি টাকার চেক হস্তান্তর করেন। আগে সংসদের এমপি বানাতেন, মন্ত্রী বানাতেন এখন নিজেরাই নমিনেশন কিনে মন্ত্রী-এমপি হয়ে যাচ্ছেন অনায়সে। ব্যস্ তাহলেই খুলে যায় সব দরোজা। অর্থনীতির একটা সূত্র আছে। পণ্য সরবরাহ বেশি থাকলে জিনিসপত্রের দাম কম হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের ব্যবসায়ীরা তাদের জ্ঞান দিয়ে এই সূত্রকেও উল্টে ফেলেছেন।
ব্যবসায়ীরা এখন জ্ঞান-গরিমা ক্ষমতায় এতই শক্তিশালী হয়ে পড়েছেন যে, কোনো কোনো মন্ত্রী একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি শিল্পমন্ত্রীর একটি বক্তব্য থেকে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। এই সিন্ডিকেটকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। পিয়াজের দাম কমাবেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক ও বাণিজ্যমন্ত্রী আমদানির হাঁক হেঁকেও কোনো সুফল পাচ্ছেন না। উল্টো মনে হচ্ছে গুদামে পিয়াজ পচিয়ে ব্যবসায়ীরা শোধ নেবে। কারণ মুনাফা যা করার তা এই কয়েক দিনের মধ্যেই করা হয়ে গেছে। এখন আর তারা কিছুতেই ভয় পান না।
ক’দিন আগেও বয়লারের বাজারের চিত্র ছিল ভয়াবহ। সংশ্লিষ্টরাই সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন কতো কোটি টাকা করপোরেট ব্যবসায়ীরা নিজেদের পকেটে ভরেছে। তারপর ডিম নিয়ে চললো কারসাজি। এখনো ডিমের বাজার অস্থির। ১৫০ টাকা ডজন। সাধারণ মানুষের পাত থেকে এখন মাছ-মাংস ও ডিম, দুধ গায়েব হয়ে যাচ্ছে।
অথচ খুব ভালো করে খেয়াল করলে মনে পড়বে, আমাদের চিনি কলগুলোর উৎপাদন উদ্বৃত্ত হিসেবে পড়েছিল। সঠিক বাজার তৈরির অভাবে দিনের পর দিন কলকারখানাগুলো লোকসান দিয়েছে। অবশেষে ব্যবসায়ীদের চাপেই সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভাবা যায় না আজ আমরা ১৬০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি চিনি খাচ্ছি। কৃষিপ্রধান দেশে পিয়াজ ৮০ টাকা, কাঁচা মরিচ ১৬০ টাকা দরে কিনেও আমরা নির্বিকার। ৫০-৬০ টাকার নিচে আজ বাজারে কোনো সবজি মিলে না। ৭০ টাকার নিচে চাল পাওয়া যায় না। তেল ২০০ টাকা লিটার। ২৬০ টাকার কেজির নিচে কোনো মাছ নেই। অন্যদিকে কোরবানির ঈদ আসার আগেই মসলার বাজারে শুরু হয়েছে সেই পুরনো খেলা। গ্যাসের দাম বেড়েছে, দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বাসভাড়া নিয়ে তো ঘটে গেছে লঙ্কাকাণ্ড।
এসব নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। শিল্পমন্ত্রী কেবল উপলব্ধি করেছেন, অকপটে বলেছেন। স্বীকার করেছেন ব্যর্থতা। তিনি বলেছেন, অর্থনীতি ও বাজার-এ দুই জায়গায়ই তৈরি হয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীর শক্তিশালী সিন্ডিকেট। যার কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঝরে পড়ছে এবং পণ্যের মূল্য বেড়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। মানুষ বাজার করতে গিয়ে এখন কাঁদছে। এই সিন্ডিকেটে ধরতে না পারলে এবং ভাঙতে না পারলে আমাদের মতো মন্ত্রীদের দায়িত্বে থাকা উচিত না। শুধু তাই নয়, আমলারা যা বলেন, মন্ত্রীদের সেটাই করতে হয়। মন্ত্রী দুর্বল আর সচিব সবল হলে সেখানে মন্ত্রীর কোনো ভূমিকা থাকে না।
মন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর যতদূর জানি তিনি নিজ দলের মানুষের রোষানলে পড়েছেন। কোনো মন্ত্রী ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করেননি। কিন্তু সিন্ডিকেট ভাঙ্গারও উদ্যোগ চোখে পড়ছে না? মানুষের কান্নাও থামছে না।
একটা ছোট্ট উদাহরণ দিতে চাই। ২০১০ সালে বান্দরবানের আদা ও হলুদ চাষিদের স্বল্পসুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তখনকার গভর্নর ড. আতিউর রহমান। ফলে পরের বছর ওই অঞ্চলে আদা ও হলুদের বাম্পার ফলন হয়েছিল। কিন্তু সংরক্ষণের অভাব, যাতায়াতব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ার কারণে আদা ও হলুদের ভালো দাম পাননি চাষিরা। ফলে তারা ঋণ খেলাপিতে পরিণত হন। তখনকার কৃষিমন্ত্রী এই উদ্বৃত্ত আদা ও হলুদের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেননি। এখন সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক ভালো কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার কারণে এখনো অনেক পণ্য পচে যায়। ফড়িয়া মিলাররা সরকারের আগেই ধান কিনে নিয়ে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। সরকার সেখানে পৌঁছায় অনেক দেরিতে। কারণ ব্যবসায়ীরা সুপার সনিক কম্পিউটারে পরিণত হয়েছে। আর সরকার পড়ে আছেন মান্ধাতা আমলের কম্পিউটার হয়ে। কৃষিমন্ত্রী নিজেও একজন কৃষিবিদ হয়ে কৃষকের কান্না বুঝতে পারছেন না। মধ্যস্বত্বভোগীরা কীভাবে মোটাতাজা হচ্ছেন সেটা বুঝতে পারলেও ব্যবস্থা নিতে পারছেন না।
দ্রব্যমূল্যের কথা উঠলে ব্যবসায়ীরা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত দেন। কিন্তু আমদানিনির্ভর নয় এমন পণ্যের দাম কেন বাড়বে এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের কাছে কোনো জবাব নেই। এ কারণেই হয়তো অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ বলেছিলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সমস্ত ব্যয়ভার আমরা বহন করছি। পত্র-পত্রিকা পড়লেই, গুগলে সার্চ করলে আজ সব তথ্যই বেরিয়ে আসে। পাশের দেশগুলোতে নিত্যপণ্যের দাম কেমন সেটাও জানা যায়। সুতরাং যুদ্ধের দোহাই দিয়ে, গ্যাস-বিদ্যুতের দোহাই দিয়ে পণ্যের দাম বাড়ানোর এখন আর খুব একটা ‘মার্কেট’ পায় না। সাধারণ মানুষ এখন বুঝতে পারে বাজারে চলছে অনিয়ন্ত্রিত লুটপাট। তারা এই লুটপাটের নিরসন চায়। চায় স্বস্তিতে জীবনধারণ করতে।
সর্বশেষ বলতে চাই, সরকারি তদারকি বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। সবার আগে দেশ, দেশের মানুষ এই কথা ভাবতে হবে। ভাবতে হবে উৎসবে বিভিন্ন দেশ নিত্যপণ্যে ছাড় দেয় যাতে সাধারণ মানুষের কষ্ট না হয়। আর আমাদের এই দেশে ব্যবসায়ীরা যেকোনো অজুহাতে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু করে। আজ ব্যবসায়ীদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। নানা ঘাটে টাকা ছিটিয়ে তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন। দেশের টাকা লুটে নিয়ে বিদেশে বাড়ি করছেন। আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করছেন। আর সাধারণ মানুষ অনিশ্চিত জীবন নিয়ে, বুকের মধ্যে কান্না চাপা দিয়ে শুধু অভিশাপ দিচ্ছেন। তাদের কোনো মুক্তি মিলছে না। মুক্তির পথও দেখাচ্ছে না কেউ। ব্যবসায়ীদের জ্ঞানের জাঁতাকলে তারা কেবল পিষ্ট হচ্ছেন।
লেখক: সম্পাদক, অপরূপ বাংলা
পাঠকের মতামত
আপনার এই অমূল্য লেখা পড়ে আমার চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছে। আপনার বিকাশ নাম্বার থাকলে আমি কিছু উপহার পাঠাতাম। যাহোক ব্যবসার ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্ম শুধু মুনাফা কে বড় করে দেখতে উদ্বুদ্ধ করে না। এক্ষেত্রে আখলাক চরিত্র অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। সেই শিক্ষাটা আমাদের ব্যবসায়ীদের পাঠ্যভুক্ত করতে হবে।
মন্ত্রীর সত্য ভাষণ- বাজারে চোখের পানি -------------------------------------------------------------- "মানুষ বাজার করতে গিয়ে এখন কাঁদছে: শিল্প প্রতিমন্ত্রী" (যুগান্তর প্রতিবেদন ১১ মে ২০২৩) যুগান্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ১১ মে বৃহস্পতিবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সম্মেলন কক্ষে এক কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে শিল্প প্রতিমন্ত্রী বক্তব্য দিচ্ছিলেন। "শিল্প প্রতিমন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেন, আমি অনেককে দেখেছি বাজার করতে গিয়ে কাঁদছেন। কারণ, বাজারে পণ্যের যে দাম, তার পকেটে সেই টাকা নেই। এটার একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট। আমাদের চিনির অভাব নেই, আমাদের চালডাল, তরিতরকারির অভাব নেই।" তাঁর মতে বাজারে জিনিসপত্রের অভাব নেই। তবুও আকাশছোঁয়া দাম। এর কারণ সিন্ডিকেট। এর কয়েকদিন পর দৈনিক যুগান্তর তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে এবং খবরের শিরোনাম লিখে, "একান্ত সাক্ষাৎকারে শিল্প প্রতিমন্ত্রী- মন্ত্রীদের ভেতর একটা সিন্ডিকেট আছে।" ( যুগান্তর ১৬ মে ২০২৩) আওয়ামী সরকার ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর শেয়ার বাজারে কেলেঙ্কারি ঘটে। লাখ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সর্বশান্ত হয়ে গেছে। কেউ কেউ মনের ক্ষোভে আত্মহত্যা করেছেন। শেয়ার কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গে শিল্প প্রতিমন্ত্রী বলেন, "শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িতরা এখন মন্ত্রী, দুঃখ হয় সবাই টাকার পিছে ঘুরছে * সব কথা বলতে গেলে দেখবেন আমার লাশটা রাস্তায় পড়ে আছে।" প্রতিমন্ত্রীর কথায় এবার সন্দেহাতীত ভাবে বোঝা গেলো শেয়ার বাজারে কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিলো কারা। "প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশ এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এরপরও দেশে আজ যে অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে, ব্যবসার নামে আজ যে লুটপাট হচ্ছে, মানুষের পকেট কাটা হচ্ছে- এগুলো সাংবাদিকদের আরও জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা বাজারে দেখি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কেন ঊর্ধ্বগতি? আমাদের কোনো কিছুর অভাব নেই। আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ। চাল, ডাল, তরিতরকারি, মাছ-মাংস থেকে শুরু করে সবকিছুতেই পরিপূর্ণ। এরপরও সিন্ডিকেটের কারণে দেশের এই অবস্থা বিরাজ করছে।’" সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অনেকে বেসরকারি ব্যাংকের মালিক হওয়ার কথাও তিনি বলেছেন। অর্থনীতি ও বাজারে লুটপাটের যথোপযুক্ত চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন। তবে আমার কাছে তাঁর বক্তব্যের চুম্বক অংশ মনে হয়েছে বাজারে গেলে আমাদের চোখের পানি ঝরে। আর, তারজন্য দায়ী গুটিকয়েক মন্ত্রী কাম ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট। প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধি শামসুজ্জামান দিনমজুর জাকির হোসেনের ক্ষোভের কথা 'বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়' প্রকাশ করায় তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। তিনি জাকির হোসেনের বক্তব্যের সাথে যে ছবি জুড়ে দিয়েছেন তা হয়তো ভুল হয়েছে। কিন্তু, দিনমজুর জাকির হোসেনের মতো কোটি কোটি মানুষের মনের ভাষা শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার যখন বুঝতে পেরে তা প্রকাশ করে দিয়েছেন তাতে বিন্দুমাত্র ভুল নেই। একবার প্রয়াত ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছিলেন মানুষের মনের ভেতর তুষের আগুন জ্বলছে। বাজারে সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের কৃত্রিম মূল্য বৃদ্ধির কারসাজির সাথে মন্ত্রীদের সিন্ডিকেট আছে বলে যখন একজন প্রতিমন্ত্রী বক্তব্য দেন তখন আমাদের আশ্রয়ের জায়গাটা আর রইলো কোথায় তা ভেবে কপালে ভাঁজ পড়ে। শিল্প প্রতিমন্ত্রীর মতে বাজারে গিয়ে মানুষ জিনিসপত্র কিনতে পারছেনা। "কারণ, পণ্যের যে দাম, তার পকেটে সেই টাকা নেই।" তাহলে মাথাপিছু আয়ের যে বয়ান এতোদিন শোনানো হয়েছে তার ভিত্তি কি? মানুষের মনের ক্ষোভ এতোটাই উৎকট আকার ধারণ করেছে যে, ভেতরে ভেতরে মানুষ শুধু ফুঁসছে। সামনে নির্বাচন। মানুষের মনের ক্ষোভ বুঝতে পেরে একজন সজ্জন ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ শিল্প প্রতিমন্ত্রীকে দিয়ে মানুষের মনের ক্ষোভ হালকা করার জন্য এসব কথা বলানো হচ্ছে কিনা সন্দেহের যথেষ্ট কারণ হচ্ছে, প্রতিমন্ত্রী মহোদয় ক্ষোভ প্রকাশ করার পরেও সিন্ডিকেট ভাঙবার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। বাজারে গিয়ে মানুষের চোখের পানি যদি ঝরতেই থাকে তাহলে শুধু কথামালা দিয়ে মনের ক্ষোভ হালকা হবেনা, কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।