নির্বাচিত কলাম
আন্তর্জাতিক
পাকিস্তানে রাজনীতি ভেঙে পড়ছে, গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা
মোহাম্মদ আবুল হোসেন
২২ মে ২০২৩, সোমবার
এসব কথাকে মাথায় রাখা উচিত পাকিস্তানের। সেখানে যখনই রাজনৈতিক বা সাংবিধানিক সংকট হয়েছে, তার পরিণতিতে সমাধান বের করেছে জনগণ। এ ইস্যুতে এজাজ আহমেদ চৌধুরী লিখেছেন, ১৯৭১ সালের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে ব্যর্থ হন রাজনৈতিক নেতারা। অন্যদিকে নির্দয় সামরিক অভিযান শুরু করেন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান। এর ফল ছিল অসম্মানজনক। রক্তপাতের মধ্যদিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছেদ ঘটে। ইতিহাসের ওই বেদনাদায়ক অধ্যায় থেকে আমাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব কি কোনো শিক্ষা নিতে পেরেছেন? এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতাদের যথেষ্ট সাহস ও ইচ্ছা থাকতে হবে আলোচনার টেবিলে বসার এবং সমস্যা সমাধানের।
রাজনীতি ভেঙে পড়ছে। কেউ কারও কথা শুনছে না। শুধু পাল্টাপাল্টি। দোষারোপ।

সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তাদের রাজনীতিতে কোনো আগ্রহ নেই, তাদের কোনো পক্ষ নেই- এমনটা বলার পর তারা যেভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছে, তা যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক করে। তারা ইমরান খানের রাজনৈতিক বক্তব্যের জবাব দিয়েছে। পাকিস্তানের আইএসপিআর থেকে একাধিক বিবৃতি দেয়া হয়েছে। এর অবশ্য কারণও আছে। ইমরান খান সম্ভবত তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় ভুল করেছেন। সেটা হলো, সরকারের বাইরে তিনি। তবু সরাসরি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি জানেন তার দেশের সেনাবাহিনীর অতীত ইতিহাস। তারপরও শক্তিধর ওই বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, শুধু অভিযোগ নয়- তাকে হত্যাচেষ্টার জন্য সেনা গোয়েন্দা সংস্থার সিনিয়র একজন কর্মকর্তার নামে মামলা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু থানা সেই মামলা নেয়নি। এহেন কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে সেনাবাহিনীকে ক্ষেপিয়ে তুলেছেন ইমরান খান। সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে যোগ দেয়ার কথা বলেছেন অতি সাম্প্রতিক বক্তব্যে। এসব কারণে সেনাবাহিনী থেকে পাল্টা জবাব দেয়া হয়েছে। আলোচনা আছে যে, সংকট ঘনীভূত হলে ক্ষমতা নিয়ে নিতে পারে সেনাবাহিনী। যদি এমন হয়, তাও অস্বাভাবিক নয়। কারণ, দেশটিতে এমন বেশ কয়েকটি ইতিহাস আছে। নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে দিয়ে ক্ষমতা নিয়ে নেয়ার নজির জ্বলজ্বলে।
পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক পতন, নিরাপত্তা হুমকি। সবই দেশটিকে ঠেলে দিচ্ছে এক নৈরাজ্যের দিকে। আবার বাস্তববাদীরা মনে করেন বর্তমান গণঅসন্তোষ থেকে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে। ‘দেশ দৃশ্যত ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। নিজস্ব দ্বন্দ্বের জেরে নিজেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে’-সূত্র ডনের সম্পাদকীয়। আসলে পাকিস্তান কোনদিকে যাচ্ছে। সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে কি আলোর দেখা মিলবে? ডন পত্রিকায় এজাজ আহমেদ চৌধুরী মতামত কলামে ২০শে মে লিখেছেন, দেশ ক্রমশ গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। পাবলিক প্লেসগুলো নিয়মিত প্রতিবাদ, সংঘাত ও দাঙ্গার ভেন্যু হয়ে উঠছে। সামাজিক অস্থিরতা নাগরিক বিশৃঙ্খলা, অবাধ্যতা এবং ধ্বংসাত্মক রূপ নিচ্ছে। যদি এই ধারাকে ঠেকানো না যায়, তাহলে দেশ ভয়াবহ এক গৃহযুদ্ধে নিপতিত হবে।
কেউ যদি ভাবেন সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, সুদান বা রোয়ান্ডায় যা ঘটেছে পাকিস্তানেও তা-ই ঘটবে, তাহলে তিনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। এসব দেশের প্রতিটির কাহিনী আলাদা। কিন্তু অভিন্ন ধারা যা, তাহলো অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি। তাতে ভেঙে পড়ে রাজনৈতিক এবং সামাজিক বন্ধন। ওই দেশগুলোতে স্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আছে। সেখানে ক্ষমতাসীনরা বা বিরোধীরা কোনো পক্ষই সমঝোতা মানতে রাজি নয়। সেখানে বাঁচো এবং বাঁচতে দাও এমন কোনো ইচ্ছা নেই। এক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে তাতে ঘি ঢেলেছে বহিঃশক্তি।
সুদানের কথাই ধরুন। সেখানকার ৪ কোটি ৬০ লাখ মানুষ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সামরিক হস্তক্ষেপের দশকের পর দশক ধরে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। সম্প্রতি সেখানে নিয়মিত সেনাবাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনীর মধ্যে তীব্র যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করছে বিশ্ববাসী। এই পরিস্থিতি ক্রমশ নৈরাজ্যকর অবস্থায় পৌঁছে যায়। লুকায়িত বিদেশি তহবিল সেখানে গৃহযুদ্ধকে আরও বেগবান করে। এর ফলে পরাজিত হচ্ছে সুদানের সাধারণ মানুষ। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। ২০১১ সালে যুদ্ধ শুরুর পর প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ দেশের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করছেন। কিন্তু এক সময়ের সুন্দর, চমৎকার দেশটি ধ্বংস হয়ে গেছে। রোয়ান্ডার গৃহযুদ্ধে হুতি এবং তুতসিরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ব্যর্থ হয়েছে। এটা শেষ হয়েছে এক গণহত্যার মধ্যদিয়ে। এর ফলে ১৯৯৪ সালে ১০০ দিনে হত্যা করা হয়েছে ৮ লাখ মানুষকে।
এসব কথাকে মাথায় রাখা উচিত পাকিস্তানের। সেখানে যখনই রাজনৈতিক বা সাংবিধানিক সংকট হয়েছে, তার পরিণতিতে সমাধান বের করেছে জনগণ। এ ইস্যুতে এজাজ আহমেদ চৌধুরী লিখেছেন, ১৯৭১ সালের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে ব্যর্থ হন রাজনৈতিক নেতারা। অন্যদিকে নির্দয় সামরিক অভিযান শুরু করেন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান। এর ফল ছিল অসম্মানজনক। রক্তপাতের মধ্যদিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছেদ ঘটে। ইতিহাসের ওই বেদনাদায়ক অধ্যায় থেকে আমাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব কি কোনো শিক্ষা নিতে পেরেছেন? এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতাদের যথেষ্ট সাহস ও ইচ্ছা থাকতে হবে আলোচনার টেবিলে বসার এবং সমস্যা সমাধানের। যদি তারা তা করতে না পারেন, তাহলে পরিস্থিতি আগে উল্লেখ করা উদাহরণের মতোই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাতে সবাই পরাজিত হবেন। কেউই বিজয়ী হবেন না।
পাকিস্তানে এই সংকট আসলে কি নিয়ে! প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ চাইছেন জাতীয় পরিষদ নামে পরিচিত পার্লামেন্টের মেয়াদ পাঁচ বছর পূরণ করতে হবে। অন্যদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান চাইছেন অবিলম্বে নির্বাচন। শুধু এতটুকুতেই সমস্যা এত জটিল হতে পারে না। সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট রাজনীতি থেকে দূরে থাকার ইচ্ছা ঘোষণা করেছে শুরুতেই। তাদেরকে রাজনীতিতে টেনে আনা উচিত হবে না। তবে সুপ্রিম কোর্ট যে সিদ্ধান্ত দেয় তার প্রতি সবার শ্রদ্ধা থাকা উচিত। নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করা উচিত হবে না। রাষ্ট্রীয় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে হেয় করার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহারে দায়মুক্তি দেয়া উচিত হবে না। তবে সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে একটি অবাধ ও স্বাধীন নির্বাচন। তাতে সব পক্ষেরই সন্তুষ্ট থাকা উচিত হবে।