নির্বাচিত কলাম
সময় অসময়
চলচ্চিত্রের মানুষগুলোকে একই মালায় গাঁথতে চেয়েছিলেন মিয়াভাই
রেজানুর রহমান
১৭ মে ২০২৩, বুধবার
শুধুই কি একজন বরেণ্য অভিনেতা হিসেবেই আলো ফেলেছেন নায়ক ফারুক? না, তা নয়। আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গনের একজন অভিভাবকও ছিলেন। সত্য কথা বলতে মোটেও দ্বিধা করতেন না। চ্যানেল আইতে বহুবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার সান্নিধ্য পেয়েছি। একবার চ্যানেল আইতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেশবরেণ্য শিশুসাহিত্যিক ফরিদুর রেজা সাগরের অফিস কক্ষে তার সঙ্গে দেখা। বললেন, রেজানুর তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। পরবর্তীতে একদিন এফডিসিতে তার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হলো। একধরনের আক্ষেপ ছিল মনে। আমাদের চলচ্চিত্র কাক্সিক্ষত পথে এগুচ্ছে না। দলাদলি স্পষ্ট।
কেউ কারও ভালো চায় না। এমনই আক্ষেপের কথা বলেছিলেন সেদিন। আরও বলেছিলেন, যেকোনো কাজে ভালোবাসাই হলো আসল। অথচ চলচ্চিত্রে প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসারই অভাব প্রকট।বিজ্ঞাপন
আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সিনেমা বোধকরি দশবার দেখেছি। দশবার দেখার কারণ ফারুক আর ববিতার অভিনয়। শুধু ফারুক, ববিতার কথাই বা বলি কেন? আনোয়ার হোসেন, আনোয়ারা, রওশন জামিলসহ অন্যরাও ছিলেন অনবদ্য। যেন সিনেমা নয়, বাস্তব কাহিনী। সিনেমার পর্দায় বাস্তবজীবনের কাহিনী দেখতে পাচ্ছি। গোলাপী এখন ট্রেনে যখন মুক্তি পায় তখন এই দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিভিশনের এত প্রতাপ, প্রভাব ছিল না। সিনেমা, একমাত্র সিনেমাই ছিল পারিবারিক বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। পারিবারিকভাবে দলবেঁধে সবাই হলে সিনেমা দেখতে যেতেন। হলে নতুন সিনেমা মুক্তি পেলে প্রথম সপ্তাহে টিকিট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। একদল মানুষ সিনেমার টিকিট ‘ব্ল্যাক’ করতো। অর্থাৎ হলের কাউন্টারে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির সঙ্গে যোগসাজশে কিছু টিকিট আগেই কিনে নিতো। পরে সেই টিকিট চড়া দামে বিক্রি করতো। এদেরকে ব্ল্যাকার বলা হতো। সিনেমার টিকিট ‘ব্ল্যাক’ করে অনেকের বাড়ি-গাড়ি করারও নজির রয়েছে। এর থেকে বোঝা যায় সেই সময় সিনেমার কতোটা কদর ছিল।
আমজাদ হোসেনের সিনেমা বলে কথা। তাও আবার ফারুক, ববিতা, আনোয়ার হোসেন, আনোয়ারাসহ দেশ সেরা অভিনয় শিল্পীরা অভিনয় করেছেন। প্রথম সপ্তাহে কোনো মতেই টিকিট জোগাড় করতে পারলাম না। বেকার জীবন। অর্থের অভাব। বাজারের টাকা মেরে ১ টাকা, ২ টাকা জমাই। কিন্তু তাতেও টিকিটের টাকা জোগাড় হচ্ছিলো না। সৈয়দপুরে বিজলী নামে একটা সিনেমা হলে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ চলছিল। আমরা কয়েকজন বন্ধু গেটম্যানের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেললাম। তখনকার দিনে প্রতিটি সিনেমা হলে ম্যাটিনি, ইভিনিং এবং নাইট শো অর্থাৎ বিকাল, সন্ধ্যা ও রাতে পর পর ৩টি করে শো হতো। নতুন সিনেমার ক্ষেত্রে শুক্রবার মর্নিং শো’য়ের আয়োজন থাকতো। বহুল আলোচিত সিনেমার ক্ষেত্রে প্রতিদিন নিয়মিত ৩টি শোয়ের বাইরে বেলা ১২টায় স্পেশাল শো’য়ের ব্যবস্থাও থাকতো।
গোলাপী এখন ট্রেনে প্রতি শো’তেই হাউসফুল যাচ্ছিলো। ব্ল্যাকে টিকিট কেনার সামর্থ্য নাই। গেটম্যানের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার সুযোগে প্রথম দিন বোধকরি মাত্র ৫ মিনিট গোলাপী এখন ট্রেনে দেখার সুযোগ হলো। বর্তমান সময়ে সিনেমা হলে অনেকটা ডেকে এনে দর্শককে বসানো হয়। অথচ তখনকার দিনে বিনা টিকিটে কেউ হলে ঢুকেছে কিনা তা দেখার জন্য ‘চেকিং’ চলতো। এই চেকিং’র কারণে প্রথম দিন ৫ মিনিট যেতে না যেতেই গেটম্যান আমাদেরকে হল থেকে বের করে দেন। কারণ, হলে চেকিং শুরু হয়েছে। এভাবে ৫/৭ দিনে গোলাপী এখন ট্রেনের পুরোটা দেখার পর বন্ধুরা চাঁদা তুলে টিকিট কিনে একদিন পুরো সিনেমাটা দেখার সুযোগ পাই।

সত্যি বলতে কি ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ দেখার পর থেকেই আমি মূলত নাটক, সিনেমা নির্মাণের স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। সিনেমা এত বাস্তব হয় কী করে? অভিনেতা অভিনেত্রীরাই বা এত বাস্তব অভিনয় করেন কীভাবে? গোলাপী এখন ট্রেনেতে নায়ক ফারুকের একটি দৃশ্য আছে। তাকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে। বিষের ক্রিয়ায় মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছেন ফারুক। প্রায় দেড় মিনিটের শর্ট। আমারে কী খাওয়াইলিরে মা... বলে সংলাপ দিলেন কয়েকবার। হলভর্তি দর্শক নিশ্চুপ। কাঁদছেন অনেকে। কী করে মানুষকে এভাবে কাঁদাতে পারেন একজন অভিনেতা?
ফারুক ও ববিতা অভিনীত ‘নয়ন মনি’ সিনেমাটিও আমি কয়েকবার দেখেছি। গ্রামীণ চরিত্রে ফারুকের কোনো তুলনা হয় না। শহীদুল্লাহ কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে আব্দুল্লাহ আল মামুনের অনবদ্য নির্মাণ ‘সারেং বৌ’তে ফারুককে দেখলাম একজন শক্তিমান অভিনেতা হিসেবে। মনে হলো সারেং-এর চরিত্রটি ফারুক ছাড়া আর কাউকে মানাবে না। মিতার ‘লাঠিয়াল’ সিনেমায় খালি গায়ে প্রতিবাদী যুবকের চরিত্রে ফারুককে দেখে কেবলই মনে হয়েছে ফারুকের তুলনা শুধুমাত্র ফারুককে দিয়েই করা সম্ভব। শক্তিমান অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সংলাপ বলে যাচ্ছিলেন। একবারও মনে হয়নি সিনেমায় অভিনয় দেখছি। মনে হচ্ছিলো চোখের সামনে বাস্তবে ঘটনাটা ঘটছে। ১৯৭১ সালে এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ সিনেমার মাধ্যমে রুপালি পর্দায় ফারুকের অভিনয় জীবনের সূত্রপাত্র হয়। তবে মূল আলোচনায় আসেন স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে। যুদ্ধফেরত টগবগে যুবক। ফারুকের সঙ্গে কবরীর জুটি গড়ে খান আতাউর রহমান নির্মাণ করলেন বহুল আলোচিত সিনেমা ‘সুজন সখী’। গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত পারিবারিক গল্পের সিনেমা সুজন সখী দারুণভাবে হিট হয়। তারপর আমজাদ হাসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সিনেমায় ববিতার সঙ্গে জুটি গড়েন ফারুক। দুর্দান্ত আলোচনায় ছিল গোলাপী এখন ট্রেনে। মূলত গ্রামের তরুণের চরিত্রেই ফারুককে বেশি দেখা গেছে। চলচ্চিত্র সমালোচকদের মতে, ফারুক গ্রামীণ মানুষের স্বভাব, প্রতিবাদের ভাষা দারুণভাবে প্রকাশ করতে পারতেন।
মানিকগঞ্জের ঘিওরে নায়ক ফারুকের জন্ম। তবে বেড়ে উঠেছেন পুরনো ঢাকায়। বাংলাদেশে অভিনেতাদের মধ্যে সম্ভবত ফারুকই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ও ক্লাসিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত সিনেমাগুলোর মধ্যে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুজন সখী’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘আরশীনগর’, ‘এখনও অনেক রাত’, ‘আলোর মিছিল’, ‘লাঠিয়াল’, ‘তৃষ্ণা’, ‘সারেং বৌ’, ‘সখী তুমি কার’, ‘মিয়াভাই’, ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘কথা দিলাম’, ‘এতিম’, ‘সূর্য সংগ্রাম’, ‘সূর্য গ্রহণ’, ‘নাগরদোলা’, ‘লাল কাজল’, ‘জীবন সংসার’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
শুধুই কি একজন বরেণ্য অভিনেতা হিসেবেই আলো ফেলেছেন নায়ক ফারুক? না, তা নয়। আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গনের একজন অভিভাবকও ছিলেন। সত্য কথা বলতে মোটেও দ্বিধা করতেন না। চ্যানেল আইতে বহুবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার সান্নিধ্য পেয়েছি। একবার চ্যানেল আইতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেশবরেণ্য শিশুসাহিত্যিক ফরিদুর রেজা সাগরের অফিস কক্ষে তার সঙ্গে দেখা। বললেন, রেজানুর তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। পরবর্তীতে একদিন এফডিসিতে তার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হলো। একধরনের আক্ষেপ ছিল মনে। আমাদের চলচ্চিত্র কাক্সিক্ষত পথে এগুচ্ছে না। দলাদলি স্পষ্ট। কেউ কারও ভালো চায় না। এমনই আক্ষেপের কথা বলেছিলেন সেদিন। আরও বলেছিলেন, যেকোনো কাজে ভালোবাসাই হলো আসল। অথচ চলচ্চিত্রে প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসারই অভাব প্রকট। সেদিন জীবনের অনেক গল্পও শুনিয়েছেন। বলেছেন, তার জীবনে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা। ‘হয়তো আমি উচ্ছন্যে যেতাম। বঙ্গবন্ধুই আমাকে মানুষ করেছেন। কথাগুলো বলেছিলেন অনেক কৃতজ্ঞতা মিশিয়ে। সেদিন সিনেমার বৃহৎ পরিবার নিয়েও অনেক কথা বলেছেন। শিল্পীদের মধ্যে দলাদলি থাকা ঠিক নয়। ঈর্ষা নয়, ভালোবাসার শক্তিতে সবাইকে এক থাকতে বলেছিলেন।’
ববিতার সঙ্গে ৫০টিরও বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন ফারুক। ববিতা বলেছেন, যতদূর মনে পড়ে এফডিসিতে প্রথম দেখা হয়েছিল ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে। আলোর মিছিল সিনেমার স্যুটিং ছিল সেদিন। তারপর তো একে একে অনেক ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করেছি। ফারুক ভাই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে আবার সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন। গ্রামীণ পটভূমির চলচ্চিত্রে অসাধারণভাবে মিশে যেতে পারতেন। মানুষ হিসেবে ফারুক ভাইকে বাইরের কেউ কেউ বদরাগী, বদ-মেজাজি ভাবতেন। কিন্তু তিনি মোটেও তেমন ছিলেন না। নরম মনের মানুষ ছিলেন আমাদের ফারুক ভাই।
নায়ক ফারুক সবার প্রিয় মিয়াভাই আমাদের চলচ্চিত্রের মানুষগুলোকে একসঙ্গে, একই মালায় গাঁথতে চেয়েছিলেন। এর কারণ চলচ্চিত্রকে সত্যিকার অর্থে ভালোবেসেছিলেন তিনি। আসুন, ভালোবেসে ভালো চলচ্চিত্রের পাশে দাঁড়াই। তাহলেই নায়ক ফারুককে যথার্থ সম্মান জানানো হবে। জয় হোক বাংলা চলচ্চিত্রের।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।