নির্বাচিত কলাম
বেহুদা প্যাঁচাল
নোম্যান্স ল্যান্ডে বিএনপি নেতারা
শামীমুল হক
১৯ এপ্রিল ২০২৩, বুধবার
দেশে নির্বাচনে ভোট দিতে মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। নানা কারণে মানুষ ভোট দিতে যায় না। সাম্প্রতিক বেশক’টি উপনির্বাচন, পৌর নির্বাচন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে নির্বাচনের প্রতি মানুষের অনীহার দৃশ্য। কিন্তু কেন এই অনীহা? নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে কোনো গবেষণা চালিয়েছে বলে এখনো শোনা যায়নি। নির্বাচন কমিশন যদি অনীহার কারণ খুঁজে এর সমাধান করতে পারেন তাহলে হয়তো আগামী নির্বাচনগুলোতে ভোটাররা ভোট দিতে যেতে পারেন
জাতীয় নির্বাচনের পর দেশবাসীর কাছে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে সিটি করপোরেশন নির্বাচন। ইতিমধ্যে সিটি নির্বাচনের ডামাডোল বেজে উঠেছে। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করেছে। আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থিতাও ঘোষণা করেছে। তবে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ ব্যাপারে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তারা সিটি নির্বাচনে যাবে না। অর্থাৎ অংশ নেবে না। অবশ্য বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মাঠের আন্দোলনে সক্রিয়। তারা একের পর এক আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করছে। তা পালনও করছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যা শোনা যাচ্ছে অনেক বিএনপি ঘরানার নেতারা নির্বাচন করতে প্রস্তুতি নিয়েছেন। কেউবা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরই মধ্যে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নির্বাচন করবেন কিনা তা নিয়ে রহস্য রেখেছেন তিনি নিজেই। তিনি সরাসরি নাও করছেন না আবার হ্যাঁও করছেন না। যেটা বলছেন, তা হলো- এ ব্যাপারে সময় এলেই জানতে পারবে সবাই।

এ ছাড়া অন্যান্য সিটি নির্বাচনেরও এমন একাধিক নেতা রয়েছেন নির্বাচনী মাঠে। তাহলে হলোটা কি? বিএনপি তাদের নেতাদের আটকে রাখার ক্ষমতা রাখে না। এই ক্ষমতা না রাখাটাই হলো বিএনপি’র জন্য কাল। অনেকে অবশ্য বলছেন, বিএনপি’র নেতৃত্বই চান যারা নির্বাচন করার করুক। দেখা যাক না কি হয়? তাদের বিএনপি বহিষ্কার করবে না- এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। আর বহিষ্কার করলেই কি? যারা নির্বাচন করবে তারা বহিষ্কারের ধারও ধারেন না হয়তো। এই ধার না ধারার কারণেই তারা দলের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করবে। নির্বাচন কমিশন এপ্রিল মাস থেকে তিন ধাপে দেশের ৫টি সিটি করপোরেশনের তফসিল ঘোষণা করেছেন। এপ্রিল মাসের ২১ তারিখ থেকে জুনের ১২ তারিখ সময়ের মধ্যে এ নির্বাচন সম্পন্ন করা হবে। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমকে সরিয়ে ব্যালটে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন কাজী হাবিবুল আওয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। কিন্তু একই কমিশন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করতে চায় বর্তমান কমিশন। প্রশ্ন উঠেছে, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে এসে সিটি নির্বাচনে কেন ইভিএমের উপরই ভরসা করতে হলো নির্বাচন কমিশনকে। সিটি করপোরেশন নির্বাচন আইন অনুযায়ী, কোনো সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের মেয়াদ ধরা হয় প্রথম সভা থেকে পরবর্তী ৫ বছর। কোনো সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ১৮০ দিনের মধ্যে ভোটগ্রহণ করতে হয়। এই সিটি করপোরেশনগুলো হচ্ছে ‘গাজীপুর, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও খুলনা। ওদিকে আসন্ন ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভা শেষে ব্রিফিংয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মনোনয়ন বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যারা মনোনয়ন পেয়েছেন তারা হলেন-রাজশাহীতে বর্তমান মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, খুলনায় তালুকদার আব্দুল খালেক, বরিশালে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ, গাজীপুরে এডভোকেট আজমত উল্লাহ খান ও সিলেটে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘যারা মনোনয়ন চেয়েছে তাদের প্রার্থিতা কতোটা গ্রহণযোগ্য হবে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সেটা বিবেচনা করেই আমরা একজনকে বেছে নিয়েছি। একাধিক প্রার্থী ছিল। কিন্তু মনোনয়ন তো দিতে হবে একজনকে। অবশ্য ৫ সিটিতে ৪১ জন দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। ব্যাপক যাচাই বাছাই শেষে এ মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়। গত ৩রা এপ্রিল নির্বাচন কমিশন সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। তফসিল অনুযায়ী ২৫শে মে গাজীপুর, ১২ই জুন খুলনা ও বরিশাল এবং ২১শে জুন রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে, সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাছাই দেখে বোঝা যায়, দলটি এ নিয়ে ব্যাপক চিন্তাভাবনা করছে। খুলনা ও রাজশাহী ছাড়া বাকি তিনটি সিটিতেই নতুন প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে অনেক আগে থেকেই বলা হচ্ছিল আগামী জাতীয় নির্বাচনে ক্লিন ইমেজের প্রার্থী দেয়া হবে। কোনো ধরনের বিতর্কিতদের প্রার্থী দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারিও দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু এর আগেই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এর প্রমাণ পাওয়া গেল।
কিন্তু বিএনপি কোনো নির্বাচনেই যাবে না। এটা তাদের ঘোষণা। এখন পর্যন্ত বিএনপি এ মতেই আছে। কিন্তু আলামত যা দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে পাঁচ সিটিতেই বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়বেন। তারা দলের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে লড়বেন এমনটা কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- বিএনপি আসলে কি চাইছে? তারা কি চাইছে তাদের দলীয় নেতা স্বতন্ত্র হয়ে লড়াই করুক। দেখা যাক না কি হয়? এমনটা হলে বলতে হয় সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে দোটানায় রয়েছে বিএনপি। যদিও এসবই আন্দাজের কথা। আর এই আন্দাজের কথা কেউ না ধরাই ভালো। অবশ্য সময় হলেই সব খোলাসা হবে সামনে। খুলনায় বেশ কিছুদিন আলোচনায় ছিলেন বিএনপি’র সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম মঞ্জু। স্থানীয় লোকজন বলছেন মঞ্জু নোম্যান্স ল্যান্ডে রয়েছেন। আর মঞ্জু অবশ্য বলছেন, দলের সিদ্ধান্ত পেলেই তিনি নির্বাচনে যাবেন। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে তিনি কিছুই করবেন না। আবার রাজশাহীতে শোনা যাচ্ছে সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের নাম। বিএনপি নেতারা তাকে নিয়ে কানাঘুষা করছেন। কিন্তু বুলবুল এখনো মুখ খুলেননি। তার এক কথা- দলের বাইরে তিনি যাবেন না। বরিশালে মুজিবর রহমান সরোয়ারকে নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা আশাবাদী। বরিশালে চাউর হয়েছে সরোয়ার স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করতে পারেন। কিন্তু মুজিবর রহমান সরোয়ার এ ব্যাপারে নীরব। আর গাজীপুরে বিএনপি’র তেমন কোনো নেতা নেই যে লড়বেন। তবে গাজীপুরের সরকার পরিবার থেকে শাহানুর রনি মাঠে রয়েছেন আগে থেকেই। তিনি স্বতন্ত্র হয়ে নির্বাচন করবেন কিনা তাও অস্পষ্ট। ওদিকে জাতীয় পার্টি ঘোষণা দিয়েছে সিটি নির্বাচনে লড়ার। বরিশালে ইসলামী আন্দোলন বেশ সক্রিয়। তারা চাইছে বিরোধী দল বিএনপি’র ভোট ব্যাংক কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে। তবে, দেশে নির্বাচনে ভোট দিতে মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। নানা কারণে মানুষ ভোট দিতে যায় না। সাম্প্রতিক বেশক’টি উপনির্বাচন, পৌর নির্বাচন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে নির্বাচনের প্রতি মানুষের অনীহার দৃশ্য। কিন্তু কেন এই অনীহা? নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে কোনো গবেষণা চালিয়েছে বলে এখনো শোনা যায়নি। নির্বাচন কমিশন যদি অনীহার কারণ খুঁজে এর সমাধান করতে পারেন তাহলে হয়তো আগামী নির্বাচনগুলোতে ভোটাররা ভোট দিতে যেতে পারেন। বিষয়টি কমিশন ভাবতে পারেন। কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন শুরু থেকেই চাইছেন আগামী নির্বাচন যেন সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়। এ জন্য চেষ্টাও করছেন। কিন্তু মাঝেমধ্যে কথাবার্তা এলোমেলো বলে সব গুলিয়ে ফেলেন। যেমন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে বেশির ভাগ দল না মতামত দিলেও তারা শেষ পর্যন্ত দেড়শ’ আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণের ঘোষণা দেয়। এ নিয়ে বেশ কিছুদিন দেশে আলোচনা সমালোচনা হয়। কিন্তু সম্প্রতি ঘোষণা দেয় তিনশ’ আসনেই হবে ব্যালটে ভোট। এ ঘোষণাই যদি অনেক চিন্তাভাবনা করে দেয়া হতো তাহলে কমিশনে দুই ধরনের মতামত দিতে হতো না। দেশে এত আলোচনাও হতো না। বর্তমানে আবার একই আলোচনা চলছে, জাতীয় নির্বাচন যদি ব্যালটে হবে তাহলে সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেন ব্যালটে নয়। এক্ষেত্রে ইভিএমের প্রয়োজন পড়লো কেন? যে ইভিএমের সঙ্গে ভোটাররা পরিচিত নন। দ্বিতীয় কথা ইভিএম ভোট দিয়ে ভোটাররা তৃপ্ত হতে পারছেন না। আসলেই কি তাদের ভোট দেয়া হয়েছে? এমন নানা প্রশ্ন নিয়ে তারা কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফেরেন। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের পর ভোট গণনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এমনকি অনেকে অভিযোগ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাচ্চুকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব প্রশ্ন উঠে কেবল ইভিএমে ভোটাররা ভোট দিয়ে সন্তুষ্টি পান না বলে। সিটি করপোরেশনে ইভিএমও একই প্রশ্ন দাঁড় করাবে। এ ছাড়া ব্যালটে সব ভোট কাস্টিং বেশি হয়। কিন্তু ইভিএমে হয় একেবারেই কম। সে যাই হোক সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি দলগতভাবে অংশ না নিলেও খবর রয়েছে তাদের অনেক নেতা নোম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থান করছেন। তাদের কীভাবে বিএনপি মোকাবিলা করে তাই এখন দেখার বিষয়।