নির্বাচিত কলাম
সরল সম্ভাষণ
অদৃশ্য সিন্ডিকেট, দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া ও গরিব জনগণ
টুটুল রহমান
৩১ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার
সেই পুরনো শব্দ। পুরনো আলোচনা। অদৃশ্য বাজার সিন্ডিকেট। রমজান এলে এই আলোচনা জোরালো হয়। তাদের ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। শুধু পণ্যের দাম বাড়ে। সাধারণ মানুষের পকেট থেকে বেরিয়ে যায় কোটি কোটি টাকা। প্রতি বছরই কোনো না কোনো পণ্যের উপর ভর করে এই সিন্ডিকেট। কখনো চিনি, কখনো তেল, কখনো ছোলা, কখনো খেজুর। এবার তারা ভর করেছিল ব্রয়লার মুরগির উপর।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, বাজার সিন্ডিকেটের চাবুকে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া ছুটছে এতে সাধারণ মানুষ কি দুর্ভোগে পড়েছে? কিছুদিন আগে তো পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা বেহেস্তে আছি। সে বেহেস্তের চিত্র আমরা পেতে পারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপের তথ্যে। গত বুধবার সংস্থাটি তাদের জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের ৭৪ শতাংশ নিম্নআয়ের পরিবার ধার করে চলছে। এ ছাড়া ৩৫ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। গত ৬ মাসে এসব পরিবারের ব্যয় বেড়েছে ১৩ শতাংশ, কিন্তু তাদের আয় বাড়েনি। সংস্থাটি আরও বলছে, জরিপে অংশ নেয়া ৯০ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে অর্থনৈতিক চাপে তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। জরিপে অংশ নেয়া ৯৬ শতাংশ পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়েছে। মাছ খাওয়া কমিয়েছে ৮৮ শতাংশ পরিবার। এই পরিস্থিতির জন্য বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, দেশে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও বাজার অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। সানেম বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপে খাবারের খরচ মেটাতে মানুষ এখন ব্যাপক কাটছাঁট করে চলছে। জরিপে অংশ নেয়া ৯০ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশ পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়েছে। যেমন ৬ মাস আগেও যেসব পরিবারে মাসে ৪ বার মুরগি খেত, এখন তারা ২ বার মুরগি খায়। মাছ খাওয়া কমিয়েছে ৮৮ শতাংশ পরিবার। এ ছাড়া ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম ও ৮১ শতাংশ পরিবার ভোজ্য তেল খাওয়া কমিয়েছে। ১০০০ জনের জরিপে ধরে নিলাম হয়তো সঠিক চিত্র আসেনি। কিন্তু আশপাশের মানুষের সঙ্গে কথা বললে যে এই চিত্র পাওয়া যাবে তার একটা ছোট উদাহরণ দিতে চাই। সরকারি এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন এক ভদ্রলোক। ৩০০ টাকায় তরমুজ কিনে বাড়ি ফিরছিলেন। কথা হলো তার সঙ্গে। জানালেন, মাংসের দাম বাড়ার পর থেকে মাংসের বাজারে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। ভরসা ছিল ব্রয়লার। সেটার দামে গ্যাঁড়াকলে পড়ে তাও বর্জন করতে হয়েছে তাকে। একজন সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে চলতেও তার কষ্ট হচ্ছে অকপটে জানালেন। সানেম যে তথ্য দিচ্ছে তার মিল পাওয়া যায় তার কথায়। এ ছাড়াও সানেম বলছে, শহরে ১৩ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে গ্রামে ১২ শতাংশ। কিন্তু বেতন বাড়ার খবর তো পাওয়া যায়নি। উল্টো একটি বেসরকারি অফিসে চাকরি করা ভদ্রলোক জানালেন, প্রতিষ্ঠানটি ১০ শতাংশ বেতন কমানোর চিন্তা-ভাবনা করছে যাতে কর্মী ছাঁটাই করতে না হয়। অনেকের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি রোজায় ফল খাওয়া কমিয়েছেন অথবা একেবারে খাচ্ছেন না। কারণ ৩০০ টাকা কেজি আপেল কেনার সামর্থ্য অনেকেই হারিয়েছেন। হাজার টাকা নিচে ভালো কোনো খেঁজুর নাই। সংবাদপত্রের তথ্যে এসেছে ৯০ টাকার খেঁজুর দেশে এসে তিনগুণ দামে বিক্রি হয়। পণ্য সংকট না থাকলেও নানা অজুহাতে এদেশে পণ্যের দাম বাড়ে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যখন বাঁধলো তখন ওই যে তেল, চিনি, আটা ঊর্ধ্বমুখী হলো তা আর নামলো না। দেশে জ্বালানি সংকট মিটে যায়, ডিজেল আসে ভারত থেকে, কাতার জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখায় কিন্তু পণ্যের দাম আর কিছুতেই কমে না। অজুহাত দিয়ে দাম বাড়ানোর খেলায় যারা মত্ত আছেন তাদের কি সত্যিই আমরা চিনি না? চিনি তো বটে। কিন্তু শোষক শ্রেণি তাদের ব্যাপারে নির্বিকার থাকলে গরিব জনগণের আর কিছু করার নেই। সাধারণ মানুষ কাদের দ্বারা শাসিত হচ্ছে, ক্ষমতার ভিত্তি মূলই বা কি সেটা বোঝার জন্য সরকারের ক্ষমতা প্রয়োগ, কাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব সেই প্রবণতার দিকে তাকালে বিষয়টা অনেকটাই খোলাসা হয়ে যায়। তথ্যপ্রযুক্তির মালিকদের সর্বত্র পৌঁছানোর বুর্জোয়া মনোভাবের কারণে এটা এখন ধনী-গরিবের হাতের খুব কাছে। আর এ কারণে সরকারের মনোবৃত্তি, মনোভাব বোঝার জন্য গ্রামের একজন সাধারণ মানুষও আর রাষ্ট্রের গেলানো তথ্যের উপর নির্ভর করে না।
সে আপনা- আপনিই জানতে পারছে শাসন কর্তার মনোভাব ও পদক্ষেপ। এ দীর্ঘ ভূমিকা দিলাম এ কারণে যে, কি গ্রাম কি শহর সর্বত্রই এখন আলোচনা বড় বড় ব্যবসায়ীরা এখন সরকারের বন্ধু, সরকারকে পরিচালিত করে এমনকি সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়। এমন কি তারা এখন এটাও বিশ্বাস করে যে, সরকার এই সিন্ডিকেটকে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ভাঙতে পারবে না। আওয়ামী লীগ নিজেদের গণমানুষের দল হিসেবে দাবি করে আসছে প্রতিষ্ঠার পর থেকে। বিশেষ করে এই দলের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এ কথা তো অস্বীকার করার জো নেই। বুর্জোয়া মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্ব করা দল হলেও মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণায় তারা মানুষকে শুনিয়েছিল সাম্যের বাণী, দেখিয়েছিল শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। সেই উঠতি ধনী বর্তমানে বাজার সিন্ডিকেট ব্যবসীয়রাই সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ কথার দলিল হিসেবে বলা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী যে কালোবাজারি, মজুতদারিদের ধরা হচ্ছিলো তারা সবাই প্রায় আওয়ামী লীগের লোক ছিলেন, সেটা ইতিহাস সাক্ষীই কেবল নয়, পাওয়া যাবে বঙ্গবন্ধুর নানা বক্তৃতায়, আক্ষেপে। তিনি বলেছিলেন, যেদিকে তাকাই সব আমার লোক। এমন কি মেজর জলিল যে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন, সেখানে তিনি বারবার আওয়ামী লীগের ব্যবসায়ীদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে এই ব্যবসায়ীদের ‘খপ্পরে’ বারবার পড়েন। গত কয়েক বছরে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন, নেতৃত্ব নির্বাচনের পদ্ধতি বিশ্লেষণ করুন দেখবেন ব্যবসায়ীরা দলবাজিতে যেকোনো সময়ের চেয়ে এগিয়ে আছে। এমন কি মার্কামারা দলীয় লোকেরাই ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। খেয়াল করুন ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্সের মালিকদের অবস্থা। তারা রাতারাতি কি করে ভোল পাল্টেছেন। এই দলবাজি যদি পজিটিভ কিছু বয়ে আনতো তাহলে সমস্যা ছিল না। এই দলীয় নেতৃত্ব ব্যবসায়ীদের কী করে নানা সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেয়া যায়, বাজেটে কী করে কর কমানো যায়, কী করে শুল্ক সুবিধার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করা যায় এগুলোতে এই নেতৃত্ব অনেক কাজ দিয়েছে। তারা সফল হয়েছেন। তারা রাষ্ট্রীয় নানা সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার মুনাফা পকেটে তুলেছেন বলে; কিন্তু মানুষের কি কোনো লাভ হয়েছে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিতে চাই, কয়েক বছর আগে যখন আনিসুল হক এফবিসিসিএইয়ের সভাপতি ছিলেন তখন রিপোর্টার হিসেবে তার বাজার মনিটরিংয়ের রিপোর্ট কাভার করতে যেতে হতো। রমজানে তিনি প্রায়ই মনিটরিংয়ের জন্য যেকোনো বাজারে আকস্মিক ভাবে ঢুকে পড়তেন। ব্যবসায়ীদের মূল্য তালিকা ঝোলানোর নির্দেশ দিতেন। এটা অনেকটা কাজ দিয়েছিল। গত কয়েক বছর এফবিসিসিআই এ ধরনের কোনো কার্যক্রম করেছে বলে আমার জানা নেই। শুধু রমজান কেন বছরজুড়েই এই যে নিত্যপণ্যের বাজারে এত বিশৃঙ্খলা তা বন্ধে বা কমিয়ে আসতে বৃহৎ এই ব্যবসায়ী সংগঠনের কোনো দায়িত্বশীলতা চোখে পড়ে না। কারণ তো একটাই তারা ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়কে বড় করে তুলেছেন। মুনাফাকে বড় করে দেখছেন। জনগণের আকুতির প্রতি তাদের কোনো সাড়া নেই, দায়বদ্ধতা তো নেইই। ক’দিন আগে খবর পড়লাম মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রমজান উপলক্ষে ছাড় দেয়ার ঘোষণা আসছে। তারা রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে কার চেয়ে বেশি ছাড় দেবে। আর আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা মুখিয়ে আছেন রমজানকে পুঁজি করে কীভাবে মুনাফা করবেন তার জন্য। ইতিমধ্যে তার আঁচ মানুষের গায়ে লাগতে শুরু করেছে। ছোট বড় সব ব্যবসায়ীই মুনাফার স্বপ্নে রমজানের পবিত্রতাকে আমলে নিচ্ছেন না। কোনো কালে নেয়ওনি। ক্ষমতার রাজনীতিতে এই ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট ভাঙ্গা সরকারের পক্ষে সহজ নয়। বঙ্গবন্ধুর মতো সিংহ পুরুষ, স্বাধীনচেতা মানুষটিও যেখানে হোঁচট খেয়েছিলেন। দেশে এখন অনেকগুলো বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ তৈরি হয়েছে। তারা ‘ছাই’ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুই এখন উৎপাদন ও বিক্রি করে। এদের অনেকেই আগে জমিজমার ব্যবসা করতো। সেসব অনেকটা গুটিয়ে আসছে। মানুষের বিশ্বাসের জায়গা নষ্ট হওয়ায় আবাসন ব্যবসা এখন আবারো ফিরছে ব্যক্তিগত বা যৌথ ব্যবসায় হিসেবে। মানে নিজেরাই জমি কিনে ডেভেলপ করছে। গত কয়েক বছর ধরেই তাদের চোখ পড়েছে নিত্যপণ্যের দিকে। গরিবের হাতে তৈরি যে মুড়ি তাতেও তাদের নজর পড়েছে। মেশিনে চকচকে করে প্যাকেট করে সেটা বিক্রির প্রতিযোগিতায় নেমেছে তারা। স্বাভাবিক ভাবে প্রতিযোগিতা বাড়লে জিনিসপত্রের দাম কম হওয়ার কথা ছিল কিন্তু বাংলাদেশে হচ্ছে তার উল্টো। নানা অজুহাতে এরা শুধু জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়েই চলেছে। দ্রব্যমূল্যের এই পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানতে পারছে না কেউ।
বিশেষ করে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের অজুহাতে তারা যে পণ্যমূল্যকে কোথায় নিয়ে ঠেকাবে সেটা কেউ আন্দাজ করতে পারছে না। অথচ প্রধানমন্ত্রী জ্বালানি তেলের কোনো অভাব রাখছেন না, যথাসম্ভব বিদ্যুৎ দিচ্ছেন নিরবচ্ছিন্ন। এমন কী ভারত থেকে পাইপের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আসাও শুরু হয়েছে। তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হচ্ছে মানসিকতায়-মানবিকতায়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষতা, নানা আঙ্গিকে ব্যবসায়ীরা পুরস্কার পাওয়ার ফলে তারা এতটাই লাগামহীন হয়ে পড়েছেন যে তারা একেকটা ফ্রাংকেস্টাইনের পরিণত হয়েছেন। এখন এর প্রভুকেই এরা গিলে ফেলতে চাইছে। প্রভুকে গিলে সমস্যা নাই। কিন্তু এরা তো জনগণকেই গিলে ফেলছে। সংসার চালাতে মানুষের যে ত্রাহি অবস্থা সেই আকুতি, সেই মিনতি তো জানাতেও পারছে না তারা। তারা হা পিত্তেস করছে আর উপরওয়ালার কাছে বিচার দিয়ে গুমরে গুমরে কাঁদছে। তাদের অভিশাপ অনবরত বাতাসকে ভারি করে তুলছে। দীর্ঘশ্বাসে কেঁপে উঠছে পুরো পৃথিবী। সরকারকে এই গরিব জনগণের দীর্ঘশ্বাসের মূল্য দিতে হবে। কারণ তারা দায়বদ্ধ। তাদের কাছে থেকে ভোট নিয়েছেন। ব্যবসায়ীরা মুনাফার জন্য সব সরকারের বন্ধু সাজে। কিন্তু জনগণ ভালো সরকারের বন্ধু-সজন হয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দেয়। এই গরিব জনগণ টাকা পাচার করতে জানে না, ব্যাংক থেকে নানা কায়দায় ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করে না। কানাডা আমেরিকায় বাড়ি কিনে না। তারা খেটে খায়। গরিব মানুষের এই নাভিশ্বাস সময়ে তাদের দিকে নজর দিতে হবে। কোন পদ্ধতিতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যায়, ভুর্তকি কাজে লাগানো যায়, ভালো ব্যবসায়ী নেতৃত্ব তৈরি করা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে।