নির্বাচিত কলাম
কাওরান বাজারের চিঠি
আলোচনায় দু’টি ভোজ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা বাড়ছে, না কমছে?
সাজেদুল হক
২৫ মার্চ ২০২৩, শনিবার
প্রয়াত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার তার বইয়ে বর্ণনা করেছেন গত সংসদ নির্বাচনের তারিখ কীভাবে নির্ধারণ হয়েছিল। এই নিবন্ধের লেখকের ধারণা আগামী সংসদ নির্বাচন ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হবে। সে হিসাবে এখনই ভোটের রমরমা আলোচনা শুরু হওয়ার কথা। তবে কূটনৈতিকপাড়া ছাড়া কোথাও ভোটের তেমন কোনো আলোচনা নেই। সম্প্রতি মার্কিন বার্ষিক রিপোর্টে বাংলাদেশের ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে মূল্যায়ন রয়েছে। সেখানে পর্যবেক্ষকদের বরাতে বলা হয়েছে, ওই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলো আগামী নির্বাচন নিয়ে বেশ কয়েক মাস ধরেই কথা বলে আসছে। সেখানে যে বিষয়টির ওপর জোর দেয়া হচ্ছে, সেটি হচ্ছে অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।
দর্শনের ছাত্র ছিলাম না। তবে দর্শন শাস্ত্র বরাবরই টানতো। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ক্লাসে রোবায়েত ফেরদৌস স্যার মাঝে-মধ্যেই দর্শনের নানা বিষয়ে আলোকপাত করতেন। হিরাক্লিটাসের একটি কথা তখনই মনে গেঁথে যায়। ‘মানুষ এক নদীতে দুইবার নামতে পারে না।’ নদী এবং মানুষের পরিবর্তনশীলতা বুঝাতেই তিনি এটা বলেছেন। পরে অবশ্য অন্য একজন দার্শনিক বলেছেন, ‘মানুষ এক নদীতে একবারও নামতে পারে না।’ শিরোনাম দেখে এতোটুকু পড়ার পর কোনো কোনো পাঠক বিভ্রান্ত হতে পারেন। ভোজ আর রাজনীতি নিয়ে লিখতে বসে দর্শন কপচানো কেন? আসলে রাজনীতি, নদী ও মানুষের মধ্যে দূরত্ব খুব বেশি নয়। সবই নিয়ত পরিবর্তনশীল। আজ যা অসম্ভব মনে হয়, আগামীকালই তা সম্ভব হতে পারে। রাজনীতির গতি পাল্টে যেতে পারে যেকোনো মুহূর্তেই। আবার একই গতিতে চলতে পারে বছরের পর বছর। এতসব অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়েও কিছুদিন আগে লন্ডনের দ্য ইকোনমিস্টের এক রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘আগামী বছরের শুরুতেই বাংলাদেশে আয়োজিত হচ্ছে সাধারণ নির্বাচন। এর ফলাফল কি হবে তা নিয়ে বড় কোনো সন্দেহ নেই।’ পত্রিকাটি যে ক্ষমতাসীনদের বিজয়ের নিশ্চয়তার কথাই বলেছে আশা করি তা বুঝিয়ে না বললেও চলে। কেন এই মন্তব্য সে আলোচনায় খানিক পরে আসছি। রাজনীতিতে এখন তুমুল আলোচনা চলছে দুটি ভোজ নিয়ে। এমনিতে দেশের কোথাও নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই। চায়ের দোকানে, গণপরিবহনে কান পাতলে ভোটের আলোচনা শোনা যায় না। তবে গুলশান বনানীর কূটনৈতিক পাড়ায় ভোট নিয়ে আলোচনা চলছে রমরমা। রাজনৈতিক দলের নেতারা ছুটছেন। ভিনদেশিরা নিজেদের মধ্যেও করছেন আলোচনা। গত বুধবার ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বাসায় মধ্যাহ্নভোজে যান আওয়ামী লীগ নেতারা। সেখানে আগামী নির্বাচন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। পরে দুই পক্ষই আলোচ্য বিষয় নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়। ওবায়দুল কাদের ওই দিনই পরে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আজকে আমেরিকান অ্যাম্বাসেডরকে আমরা বলে এসেছি, ইট ইজ নট পসিবল টু রিটার্ন টু সো-কল্ড কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট অ্যাগেইন।’ আরেকটি ভোজ নিয়েও কথা বলেছেন তিনি। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আমরা আবার বিএনপি’র মতো মিডিয়া-টিডিয়া নিয়ে যাই না। তারা ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসিতে গিয়েছিল, সেখানে বোধ হয় মিডিয়ার বুম ছিল না। পরে তারা সবাইকে ডেকে নিয়ে যা কথা হয়েছে, সেটাও বলেছে; যে কথা হয়নি, সেটাও বলেছে। অবস্থাটা এমন দেখলাম যে মনে হয় যেন ভারত জয় করে এসেছে। আমরা সেটা না। আমরা নীরবে গিয়ে নিঃশব্দে চলে এসেছি।’ (সূত্র: প্রথম আলো)

ওবায়দুল কাদের যে ভোজের কথা বলেছেন তা অনুষ্ঠিত হয় গত ১৬ই মার্চ। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার আমন্ত্রণে নৈশভোজে যোগ দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির পাঁচ নেতা। সে বৈঠক নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া না গেলেও নির্বাচনসহ সার্বিক বিষয়ে যে আলোচনা হয়েছে তা ধারণা করাই যায়। সার্বিক পরিস্থিতিতে বলা যায়, এ দুটি বৈঠকই তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দু’টি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের কাছে আগামী নির্বাচন ঘিরে নিজেদের অবস্থান দৃশ্যত স্পষ্ট করেছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যেটা বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আর ফেরা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, বিএনপি’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কী কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলটির পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব নয়।
সংলাপ নাকচ
মাঝে আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র সংলাপ নিয়ে হঠাৎ করেই বেশ আলোচনা শুরু হয়। তবে সর্বশেষ সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে দৃশ্যত সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার আবার সংলাপ আলোচনায় নিয়ে আসে নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের তরফে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে চিঠি দিয়ে আলোচনার আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে এ প্রস্তাব নাকচ করতে বিএনপি সময় নেয়নি। দ্রুতই মির্জা আলমগীর জানান, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুর ফয়সালা ছাড়া বিএনপি কোনো ধরনের সংলাপে যাবে না। এর আগে মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারেও বিএনপি মহাসচিব সংলাপ প্রশ্নে দলের অবস্থান স্পষ্ট করেন। তিনি বলেন, আমরা তো প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সংলাপে যোগ দিয়েছিলাম। কী লাভ হয়েছে? একটা দাবিও তিনি মানেননি। তার মানে কি আপনারা সংলাপে যাচ্ছেন না? অর্থহীন এই সংলাপে যাওয়ার কি প্রয়োজন আছে বলুন। তাই সংলাপের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। বাংলাদেশে অতীতে সংলাপ একেবারে কম হয়নি। তবে সফলতার ইতিহাস নেই বললেই চলে। সবচেয়ে বিখ্যাত সংলাপটি হয়েছিল আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া এবং আব্দুল জলিলের মধ্যে। প্রথম দিনের সংলাপ শেষে মান্নান ভূঁইয়ার কথা এখনো কানে বাজে, ‘সকল বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।’ গত নির্বাচনের আগেও সংলাপ হয়েছে। এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তারানকোর সংলাপও সফলতার মুখ দেখেনি।
ভোটের ফল নিয়ে ইকোনমিস্টের পূর্বাভাস
কিছুদিন হয়ে গেছে। তবে লন্ডনভিত্তিক দ্য ইকোনমিস্টের রিপোর্টটি এখনো আলোচনার দাবি রাখে। রিপোর্টটি মূলত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। তবে সেখানে বাংলাদেশের আগামী রাজনীতির একটি সম্ভাব্য চিত্র আঁকা হয়েছে। এটাতো আগেই বলেছি, ইকোনমিস্টের মূল্যায়ন হচ্ছে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের ফল নিয়ে তেমন কোনো সন্দেহ নেই। এর বেশি কিছু কারণ পত্রিকাটি উল্লেখ করেছে। বিরোধীদের প্রায় ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া হয়েছে। তবে পত্রিকাটি এটাও উল্লেখ করেছে, চাপে থাকলেও এখনো টিকে থাকা বিরোধী দল-বিএনপি’র নেতারা রাজপথে সক্রিয় আছেন। বিএনপি সম্প্রতি ঢাকায় ব্যাপক বিক্ষোভ আয়োজনে সফল হচ্ছে। এতে করে সামনের দিনগুলোতে সহিংসতা এবং রাজনৈতিক বিভাজন আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা বাড়ছে না কমছে?
প্রয়াত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার তার বইয়ে বর্ণনা করেছেন গত সংসদ নির্বাচনের তারিখ কীভাবে নির্ধারণ হয়েছিল। এই নিবন্ধের লেখকের ধারণা আগামী সংসদ নির্বাচন ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হবে। সে হিসেবে এখনই ভোটের রমরমা আলোচনা শুরু হওয়ার কথা। তবে কূটনৈতিকপাড়া ছাড়া কোথাও ভোটের তেমন কোনো আলোচনা নেই। সম্প্রতি মার্কিন বার্ষিক রিপোর্টে বাংলাদেশের ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে মূল্যায়ন রয়েছে। সেখানে পর্যবেক্ষকদের বরাতে বলা হয়েছে, ওই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলো আগামী নির্বাচন নিয়ে বেশ কয়েক মাস ধরেই কথা বলে আসছে। সেখানে যে বিষয়টির ওপর জোর দেয়া হচ্ছে, সেটি হচ্ছে অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এটাও বলা হয়েছে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেই তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা কি বাড়ছে নাকি কমছে? বিএনপি’র পক্ষ থেকে এরইমধ্যে দেশে-বিদেশে এই অবস্থান স্পষ্ট করা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া দলটি নির্বাচনে অংশ নিবে না। অন্যদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে অবাধ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিয়ে বলা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর ফিরবে না।
দুই পক্ষই অনড়। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে। সামনের মাসগুলো কৌতূহলোদ্দীপক। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিষ্কার কোনো দৃশ্যপট এখনো দেখা যায় না।
লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, মানবজমিন।