নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
কূটনীতিকের টুইট ফাল্গুনী হাওয়া
তারিক চয়ন
২২ মার্চ ২০২৩, বুধবার
ঘটনা ১: গত বছরের নভেম্বর মাসের ২১ তারিখ। ওইদিন ঢাকায় নিযুক্ত জার্মানির উপ-রাষ্ট্রদূত ইয়ান ইয়ানোস্কির একটি টুইট সচেতন মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। হুইলচেয়ারে বসা একটি ছবি পোস্ট করে ওই টুইটে ইয়ান লিখেছিলেন, ‘আমি ঢাকাকে পছন্দ করি, কিন্তু আমার সবসময়ই মনে হতো, কোনো না কোনো সময় রাতের বেলা ঢাকনাবিহীন কোনো একটা ম্যানহোলে পড়ে যাবো, যদিও আমি রাস্তায় চলার সময় সবসময় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করি। আমার জন্য প্রার্থনা করবেন যাতে আমি বাংলাদেশ ঘুরে দেখার জন্য দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারি।’ ওই টুইটে তিনি ‘ঢাকা ইন এ হুইলচেয়ার’ হ্যাশট্যাগও ব্যবহার করেন।
স্বাভাবিকভাবেই জার্মানির শীর্ষ কূটনীতিকের এমন টুইটের কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গিয়েছিল। এর ফলে কেঁচো খুঁড়তে যেন সাপ বেরিয়ে আসে। নানা ধরনের আলোচনায় বেরিয়ে আসে যে, শুধু ইয়ান-ই নন, তার আগে আরও অনেক বিদেশি কূটনীতিক ঢাকায় একই ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেপুটি হেড অব ডেলিগেশন ড. বার্ন্ড স্প্যানিয়ার জানান, তিনিও একই ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। এভাবে আরও অনেক বিদেশি কূটনীতিক নিজেদের একই অভিজ্ঞতা প্রকাশ করলে ইয়ান লিখেন, ‘আমার পতনের প্রতিক্রিয়ায় বহু বিদেশি আমাকে তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা বলেছে। সংখ্যাটি আশ্চর্যজনক।’
যাই হোক, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে অনেক বিদেশি কূটনীতিক ইয়ানের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তার দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। বাদ যাননি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামও।
ওইদিন রাতেই টুইটারে দুটি ছবি প্রকাশ করে মেয়র আতিক সিটি করপোরেশনের কর্মীদের ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে লিখেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে, দুর্ভাগ্যবশত (ম্যানহোলের) লোহার ঢাকনা চুরি হয়ে গেছে, যা আরও অনেক জায়গাতেও হয়েছে।’ পরদিন (২২শে নভেম্বর) দুপুরেই টুইটের প্রতিউত্তরে কয়েকটি ছবি যুক্ত করে জার্মান উপ-রাষ্ট্রদূতকে মেয়র আতিক জানান, “আপনি জেনে খুশি হবেন যে ওগুলো ঢেকে দেয়া হয়েছে।’ মেয়র আতিক কর্তৃক এরূপ ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণে কেউ কেউ তাকে স্বাগত জানালেও বেশির ভাগই তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন। একজন মন্তব্য করেন, পুরো দেশের অবস্থাই এমন, আমরা সবাই ভুগছি। আরেকজন প্রশ্ন করেন, আপনি কি বিদেশিদের জন্যই করবেন, নিজের দেশের মানুষের জন্য করবেন না? অন্যজন আক্ষেপের সুরে লিখেন, ‘আপনার করদাতারা একই ঘটনার সম্মুখীন হলে যদি আপনি (একই রকমভাবে) ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন!’
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বিদেশি কূটনীতিকরা রাজধানীতে কোন বিপর্যয় বা বিপদের সম্মুখীন হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এরূপ ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণের ঘটনা নতুন নয়। গুলশানের অভিজাত এলাকায় বসবাসকারী বিদেশি কূটনীতিকদের বাসভবনের আশপাশ থেকে দিনের পর দিন (এমনকি মধ্যরাতেও) নির্মাণকাজের বিরক্তিকর শব্দে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটার পর ডিপ্লোম্যাটিক পুলিশের কাছে অভিযোগ করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ার কথা কানে এসেছে। যদিও সাধারণ নাগরিকদের অভিযোগের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষের এত গড়িমসি কিংবা বিলম্ব কেন সে প্রশ্নের উত্তর সবারই জানা।
ঘটনা ২: স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেছিল নেদারল্যান্ডস। দুটি দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্যদূরীকরণের পাশাপাশি সুশাসন, মানবাধিকার, দুর্নীতি রোধ, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি নানা জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন ধরে সহায়তা করে আসছে দেশটি। এসবের ধারাবাহিকতায় গত ২৫শে জানুয়ারি ভিন্নধর্মী এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ঢাকাস্থ নেদারল্যান্ডস দূতাবাস। দুই দেশের মাঝের সম্পৃক্ততা এবং দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে প্রতিফলিত করে এমন সব বিষয়গুলোকে নিয়ে দূতাবাসের দেয়ালে এর আগের কয়েকদিন ধরে আঁকা ম্যুরালগুলো (দেয়াল চিত্র) সেদিন বিকালে আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে উন্মোচন করেন ঢাকায় নিযুক্ত নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত অ্যান ভ্যান লিউয়নে।

উন্মোচনের ঠিক আগে দূতাবাসের বাগানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ উপলক্ষে বক্তব্য রাখছিলেন রাষ্ট্রদূত অ্যান। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তখনো পহেলা ফাল্গুন আসার দিন বিশেক বাকি থাকলেও বাস্তবে তখন ফাল্গুনী হাওয়া বইছিল। কিন্তু, বারবার বাইরের রাস্তা থেকে আসা অসংখ্য গাড়ির বিরক্তিকর উচ্চ মাত্রার হর্ন এবং বাতাসে ভেসে আসা নোংরা ধূলিকণায় স্বয়ং রাষ্ট্রদূত সহ আমন্ত্রিত দেশি-বিদেশি অতিথিদের মাঝে চরম বিরক্তির উদ্রেক ঘটে। প্রায় সকলেই ঢাকার বাতাসের অবস্থা নিয়ে কানাঘুষা করতে থাকেন। উপস্থিত একজন বিদেশি অতিথি সেদিনই ঢাকায় প্রথম এসেছেন। নর্ডিক একটি দেশের ওই নাগরিক জানালেন, ঢাকায় পা রেখে পত্রিকা খুলেই দেখতে পেয়েছেন, এই শহরের বাতাস ‘ঝুঁকিপূর্ণ’, দূষিত শহরের তালিকায় বিশ্বের সব দেশের মধ্যে ঢাকা একেবারে শীর্ষে!
ঘটনা ৩: গত ৭ই মার্চ। উত্তরার দক্ষিণখানে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি (বিপিকেএস) কার্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি এবং জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্রোস্টার। যানজটের কারণে সেখান থেকে গুলশান ফিরতে তাদের প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। রাত সাড়ে আটটার দিকে তারা নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছেন। পরদিন ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। অনেকেই অবগত এ দিবসে বিদেশি কূটনীতিকরা নানান অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান। ফলে আগের দিন তিন ঘণ্টা যানজটে বসে থেকে পরদিন কর্মব্যস্ত দিন পার করতে গিয়ে তারা যে রীতিমতো নাকাল হয়ে পড়েছিলেন তা বলাইবাহুল্য।
ঘটনা ৪: এটাও চলতি মাসের ঘটনা। ঢাকাস্থ বৃটিশ হাইকমিশনে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন হাইকমিশনের পলিটিক্যাল কাউন্সিলর টম বার্জ। আলোচনা যখন বেশ জমে উঠেছে তখন মশার উপদ্রবে উপস্থিত সবাই রীতিমতো পাগলপ্রায় হয়ে পড়লেন। বলাবাহুল্য ওই কক্ষ এবং বাইরের চারপাশ সবকিছুই ছিল খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কক্ষের ভেতরে মশা মারার ইলেকট্রিক মেশিনও চলছিল। তারপরও মশার উপদ্রবে বাধ্য হয়ে সবাইকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মধ্যেই মশা মারার ইলেকট্রিক ব্যাট নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছিল। জানা গেছে, ঢাকাস্থ বেশির ভাগ বিদেশি দূতাবাসেই এখন কূটনীতিকদের সন্ধ্যার পর এমনকি দিনের বেলাতেও মশা মারার ব্যাট সঙ্গে রাখতে হয়। অবশ্য রাখাটাই তো স্বাভাবিক। কিছুদিন আগেই পত্রিকায় পড়ছিলাম, সারা দেশে যত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন তাদের ৬০ শতাংশেরও বেশি রাজধানী ঢাকায়। রাজধানীতে এডিস মশাবাহিত এ রোগের প্রকোপ স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হওয়ার পেছনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারাই জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করলেও সাধারণ মানুষের অভিযোগ- সিটি করপোরেশনের মশা নিধন অভিযানের সকল প্রচেষ্টাই নিছক লোক দেখানো হওয়ায় তারা ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না।
ঢাকার কূটনৈতিক পাড়ায় একটি কথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত। সেটি এমন- ঢাকায় নিয়োগ হয়েছে শুনে উন্নত দেশগুলোর বিদেশি কূটনীতিকরা কাঁদতে কাঁদতে এদেশে আসেন। আবার, দায়িত্ব পালন শেষে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার সময়ও তারা কাঁদতে থাকেন, কারণ এখানকার অতিথিপরায়ণ মানুষদের মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে যেতে তাদের খুব কষ্ট হয়। কিন্তু, অত্যন্ত কষ্টের সঙ্গেই লিখতে হচ্ছে, উপরোক্ত ঘটনাগুলো আমলে নিলে সামনের দিনগুলোতে বিদেশি কূটনীতিকরা তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই এদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হবেন।
কারণ, আমাদের সকলের প্রিয় রাজধানী ঢাকায় দূষণ, যানজট, মশার উপদ্রব ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে অব্যবস্থাপনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এর চেয়ে নিচে নামা বা খারাপ পর্যায়ে যাওয়া বুঝি সম্ভব নয়। একটি কৌতুক দিয়ে লেখাটি শেষ করছি:- মন্ত্রী মহোদয় আগামীকাল বিদ্যালয়ে আসবেন। তাই, প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের সবচেয়ে দুষ্ট ছেলে পল্টুকে বললেন, আল্লার দোহাই লাগে, তুই কাল স্কুলে আসিস না। ফলাফল, ‘পাগলরে তুই সাঁকো নাড়াইস নারে’র মতো অবস্থা। স্যারের কথা শুনে পল্টু বেশ কৌতূহল সহকারে পরদিন সবার আগে বিদ্যালয়ে এসে শ্রেণিকক্ষের বেঞ্চের নিচে লুকিয়ে পড়লো। এ ক্লাস সে ক্লাস ঘুরতে ঘুরতে মন্ত্রী এক পর্যায়ে পল্টুদের ক্লাসে এসে ঢুকলেন। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বাবারা বলতে পারো, এমন কি জিনিস আছে যাকে একেক জায়গায় একেক নামে ডাকা হয়? ক্লাসের ফার্স্ট বয় পারলো না, সেকেন্ড বয় পারলো না, থার্ড বয়ও পারলো না। একে একে সবাই যখন ব্যর্থ হচ্ছে- এমন সময় হঠাৎ বেঞ্চের নিচ থেকে পল্টু বলে উঠলো- স্যার আমি পারবো। মন্ত্রী অবাক হয়ে বললেন, তুমি বেঞ্চের নিচে কেন! উঠে দাঁড়াও। পল্টু দাঁড়িয়ে বললো, স্যার জিনিসটা হলো চুল। মন্ত্রী জানতে চাইলেন কীভাবে? পল্টু বললো, স্যার, ঐটা মাথার উপর থাকলে চুল, আরেকটু নিচে নামলে ভ্রু, আরেকটু নিচে নামলে পাপড়ি, আরেকটু নিচে নামলে দাড়ি, আরেকটু নিচে নামলে পশম, আরেকটু...এই বলতেই প্রধান শিক্ষক মশাই চিৎকার করে বললেন, বাবা পল্টুরে থাক, তুই আর নিচে নামিস না।