ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

চলতি পথে

‘বই’ যখন শত্রু...

শুভ কিবরিয়া
১৫ মার্চ ২০২৩, বুধবার
mzamin

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) শুধু বিদ্যার সাগরই ছিলেন না, ছিলেন দয়ার সাগর। তাঁর দান-ধ্যান, অপরকে নিঃশর্তে সহায়তা করার কাজকে তিনি ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। অন্যকে সাহায্য করার বিশেষত আর্থিকভাবে সহযোগিতার ক্ষেত্রও ছিল বিচিত্র ও বহুল। নিজ গ্রাম বীরসিংহের আত্মীয়-স্বজনকে নিয়মিত সাহায্য করতেন, কাশীতে তীর্থে যাওয়া বহু স্বজন-পরিচিত জনকে মাসিকহারে টাকা পাঠাতেন, বিধবা বিবাহের খরচ দিতেন, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষত বালক-বালিকা বিদ্যালয়, কলেজ নির্মাণ ও পরিচালনার খরচ দিতেন, বন্যাপীড়িতদের সাহায্য করতেন, দুর্ভিক্ষে সাহায্য করেছেন, সভা-সমিতিতে চাঁদা দিতেন, বহুজনের পড়াশোনার খরচ ব্যয় করতেন। এর বাইরের জনহিতকর কাজে তাঁর খরচের খাত ছিল ব্যাপক। বিদ্যাসাগর চাকরি করেছেন মাত্র ১৭ বছর। ৩৮ বছর বয়সে চাকরিতে ইস্তফা দেন। তাঁর একাত্তর বছর বয়সের বাকি সময়টা বেতনছাড়াই চলেছেন। তাহলে প্রশ্ন হলো এই বিপুল ব্যয়ের উৎস তাঁর কি ছিল? তাঁর জীবন নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তাদের ভাষ্য হচ্ছে, এই বিপুল খরচের টাকা বিদ্যাসাগর পেতেন নিজে বই লিখে। নিজের প্রেস থেকে বই ছাপিয়ে।

বিজ্ঞাপন
আর নিজের ‘সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি’ নামের বই সংগ্রহ ও সংরক্ষণাগার থেকে বই বিক্রি করে। বই বিক্রির টাকা দিয়েই অকাতরে অর্থ ব্যয় করতেন, রাজকীয় দান-ধ্যান চালু রেখেছিলেন।

তাঁর বই কেমন চলতো, কতোটা সংস্করণ হতো সেসবের একটা যৎসামান্য ছবির বয়ান দিয়েছেন এক গবেষক নিখিল সরকার। তার ভাষায়- ‘‘বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’-এর প্রথম ভাগের প্রকাশ ১৮৫৫ সালে। দ্বিতীয় ভাগও এই বছরে। ১৮৯০ সালের মধ্যে ‘শিশু শিক্ষা’র প্রথম ভাগের ১৮৯টি সংস্করণ হয় (প্রথমে বইটির দাম ছিল ১ আনা ৬ পাই, পরে কমিয়ে ১ আনা করা হয়)। ১৮৯০ অবধি ‘শিশু শিক্ষা’র তৃতীয় ভাগের সংস্করণ হয় ১০১টি। দাম ১ আনা ৬ পাই। অন্যদিকে প্রথম প্রকাশের পর ১৮৯০ সাল অবধি ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ভাগের সংস্করণ হয় ১৫২টি (১৮৫৫-১৮৫৭ সালের মধ্যে ৯টি সংস্করণে ৫৩ হাজার কপি বই প্রচারিত হয়েছিল)। প্রকাশের সময় প্রথম ভাগের দাম ছিল ৯ পাই, পরে বাড়িয়ে ১ আনা করা হয়। ১৮৯০ অবধি ‘বর্ণপরিচয়’-এর দ্বিতীয় ভাগের সংস্করণ হয় ১৪০টি; দাম ছিল প্রথমে ৯ পাই, পরে বাড়িয়ে ১ আনা ৩ পাই করা হয়। ‘শিশু শিক্ষা’ তৃতীয়ভাগ বা ‘বোধোদয়’-এর জনপ্রিয়তাও দেখবার মতো। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৫১ সালে। ১৮৯০ সালের মধ্যে ছাপা হয় ১০৬টি সংস্করণ। ‘বোধোদয়’-এর দাম ছিল ২ আনা। আরেকটি বই ‘কথামালা’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৫৬ সালে। ১৮৯০ সালে হয় তার সংস্করণ হয় ৫১টি।’’ 

তো আনা পাইয়ে হিসাবে বই বিক্রির টাকার পরিমাণটা কতো হতে পারে? এ নিয়ে গবেষকরা বিস্তর মাথা ঘামিয়েছেন। এক জীবনীকার লিখেছেন বিদ্যাসাগর বই বিক্রি বাবদ মাসে ৩০০০(তিন হাজার) টাকা থেকে ৫০০০ (পাঁচ হাজার) টাকা উপার্জন করতেন। সে সময় চাকরি সূত্রে বিদ্যাসাগরের মাসিক আয় ছিল ৫০০ টাকা। বই বিক্রির মাসিক আয় তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকার গড় করে একটা মধ্যপন্থি হিসাবে গবেষকরা দেখিয়েছেন বই বিক্রি বাবদ বিদ্যাসাগরের পুস্তক ব্যবসায় আয় হয়েছিল ১৬ থেকে ১৭ লাখ টাকা। সেই সময়ের হিসাবে এটা বিপুল পরিমাণ টাকা।
সংস্কৃত কলেজ থেকে বিদ্যাসাগর যখন সহকারী সম্পাদকের পদে ইস্তফা দেন, কলেজের সম্পাদক রসময় দত্ত রস করে বলেছিলেন, এখন বিদ্যাসাগর খাবে কী? তেজী বিদ্যাসাগর এই কথা শুনে মন্তব্য করেছিলেন, রসময় দত্তকে জানিয়ে দিও, বিদ্যাসাগর আলু পটল বেচে খাবে। কথা রেখেছিলেন বিদ্যাসাগর। আলু পটলের বদলে বই লিখে, বই ছাপিয়ে, বইয়ের দোকান দিয়ে যে টাকা আয় করেছিলেন তাতে শুধু তার নিজেরই খাবার জোটে নাই, বহু বহু লোকের জীবন ধারণের ব্যবস্থা হয়েছিল। আজকের দিনে বসে বিদ্যাসাগরের এই শক্তি হয়তো অনুভব করা যাবে না। কি তেজ, কি অমিত পরিশ্রম, কি দৃঢ় আকাঙ্ক্ষায় এরকম বিদ্যানির্ভর জীবন বেছে নিয়েছিলেন তিনি। 

 

 

এই শক্তিমান বিদ্যাসাগরের বইজীবনের কথা বলতে এসব উল্লেখ করলাম, ঘটনা তা নয়। এই বয়ান দিলাম এ কারণে যে, বিদ্যাসাগরের মতো লোকের বইকেও শাসকশ্রেণির রোষানলে পড়তে হয়েছিল। শাসকশ্রেণি বিদ্যাসাগরের বইও একসময় শিক্ষা বিভাগে ক্রয় করা কমিয়ে দেয় তাঁকে শায়েস্তা করতে। তাঁর জীবনীকার শম্ভুচরণ বিদ্যারত্ন জানাচ্ছেন একসময় বিদ্যাসাগরের আয় কমে যায়। তখন তিনি বাধ্য হন ব্যয় সংকোচ করতে। সাহায্য প্রার্থীদের অনেকের মাসোহারার  অঙ্কও কমিয়ে দেয়া হয়। কারণ হিসেবে শম্ভুচন্দ্র বলেছেন, ‘ আয় কম হইবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে বিদ্যাসাগর বলিলেন, বর্তমান ছোটলাট ক্যাম্বেল সাহেবের সহিত আমার মনান্তর হয়। এই কারণে, শিক্ষা বিভাগে আমার পুস্তকের বিক্রয় কমিয়া যাওয়ায়, আয়ের অনেক হ্রাস হইয়াছে।’
কাজেই ‘বই’ বহুকাল ধরেই রাজরোষকে সহ্য করেই এগিয়েছে। অন্যকথায় ধর্ম-ব্যক্তি-শাসকের অনুভূতিকে আঘাতের নামেও বইকে কখনো নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কখনো আংশিক নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কখনো বই বিক্রিতে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে। 
হালে যারা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির দিকে নজর রাখেন তারা জানেন শাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও মোকাবিলা করতে হচ্ছে এইরকম এক ‘বই’কে। পশ্চিমবঙ্গে একচ্ছত্র ক্ষমতাধর মমতা ব্যানার্জির দল সম্প্রতি একটি উপনির্বাচনে কংগ্রেস-বাম জোটের প্রার্থীর কাছে উল্লেযোগ্য ভোটে হারেন। এই ফলাফলের পর মমতা ব্যানার্জী পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি অধীর চৌধুরীর মেয়ের আত্মহত্যা নিয়ে কটু মন্তব্য করেন। তার প্রত্যুত্তরে কংগ্রেসের মুখপাত্র কৌস্তভ বাগচী একটি বই সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন। প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক, প্রাক্তন আইএএস অফিসার দীপক ঘোষের লেখা এই বইয়ের নাম ‘মমতা ব্যানার্জি এজ আই হ্যাভ নোন হার’ বা ‘মমতা ব্যানার্জিকে আমি যেমন চিনেছি’।

কৌস্তভ বাগচীর এই হুমকির পরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে অবশ্য তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান। বলা বাহুল্য এই বইয়ের বিরুদ্ধে কোটি টাকার মানহানির মামলা হয়েছে। এই বইয়ে একসময় মমতা ঘনিষ্ঠ দীপক ঘোষ যেসব কথা লিখেছেন তাতে মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত অনেক মিথ মিথ্যাচারে পরিণত হয়ে যায়। এই বইটি এবং বইয়ের লেখক দীপক ঘোষকে নিয়ে পুরো পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ও মিডিয়ায় এখন চলছে তোলপাড়। একটা বই কীভাবে শক্তিমান রাজনীতিকের জন্য চোখের বিষ হয়ে উঠতে পারে এটা তার উদাহরণ।

এবার বাংলাদেশের একুশের বইমেলাতেও বেশ কিছু বই নামে ও তার কনটেন্টের কারণে আলোড়ন তুলেছে। অনেক কটা বইকে বইমেলাতে ঢুকতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ। বইমেলাতে বইগুলো নিষিদ্ধ হয়েছে কিন্তু সর্বত্র নিষিদ্ধ হয়নি- এরকম আলোড়িত বই ছিল, বেশক’টি। বইগুলোর বইমেলায় না ঢুকবার কারণে প্রকাশকরা একদিকে হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্যদিকে বইগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে বহুল পরিচিতি পেয়েছে। প্রকাশকের নামও পরিচিতি পেয়েছে ব্যাপকভাবে। এক প্রকাশক আদালতের দ্বারস্থ হয়েও বইমেলায় ঢুকতে পারেননি। পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য শাসক মমতার চোখ রাঙানিকে সেখানকার আদালত পাত্তা দেয় নাই। ফলে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য অস্বস্তিকর বইটি নিষিদ্ধ হয় নাই, লেখকও মুক্ত থাকতে পেরেছেন। বাংলাদেশের ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’  [লেখক: জান্নাতুন নাঈম প্রীতি, প্রকাশক: নালন্দা], ‘উন্নয়ন বিভ্রম, এক দশকের  না-বলা ইতিহাস’ [লেখক: জিয়া হাসান, প্রকাশক: আদর্শ], ‘বাঙালির মিডিয়াক্রিটির সন্ধানে’ [লেখক: ফাহাম আব্দুস সালাম, প্রকাশক: আদর্শ], ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা, টেকসই উন্নয়ন ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত’ [লেখক: ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, প্রকাশক: আদর্শ] বইগুলোর ভাগ্য সেরকম সুপ্রসন্ন নয়। তারা বইমেলায় বিক্রয়ের জন্য নিষিদ্ধ হলেও আগ্রহী পাঠকেরা তা খুঁজে নিয়েছেন নানাভাবেই, কষ্ট করে। বরং স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বইগুলো আলোচনায় এসেছে বেশি। তবে বইমেলায় না থাকার কারণে পাঠকদের একটা বড় অংশ বঞ্চিতও হয়েছেন। বইমেলার  একেবারে শেষের দিকে আরও দুটি বই এসেছে। সেগুলোর ভাগ্যে কোনো নিষেধাজ্ঞা জোটেনি বটে তবে বইগুলোর নাম ও কন্টেন্ট অনেকের জন্যই স্বস্তিকর হবে না বলেই মনে হয়। বিশেষত মাহবুব তালুকদারের ‘নির্বাচননামা, নির্বাচন কমিশনে আমার দিনগুলো’ এবং আলী রীয়াজ সম্পাদিত ‘লুণ্ঠিত ভবিষ্যৎ, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটের চালচিত্র’ বই দুটো অনেকের গলার কাঁটা হয়ে থাকবে।

আলোচনা শুরু করেছিলাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা দিয়ে। তাঁর সঙ্গে বৃটিশ লাটের মতের মিল না ঘটায়, রাষ্ট্র বিদ্যাসাগরের বই কেনা কমিয়ে দিয়েছিল। এটা বিদ্যাসাগরের জন্য ছিল বৃটিশ শাসকের তরফ থেকে শাস্তি। দুশ’-আড়াইশ’ বছরের আগের সেই ভূত এখনো আমাদের কাঁধে ভর করে আছে। এখনো নিছক নিরীহ বইয়ের শত্রু হয়ে দাঁড়াচ্ছে খোদ রাষ্ট্র। রাষ্ট্র কতোভাবে শক্তিমান, তার দল আছে, লোকবল আছে, বাহিনী আছে, আমলাতন্ত্র আছে, অর্থ আছে, দেশ-বিদেশের বন্ধু আছে, তবুও সে একটা সামান্য ‘বই’কেই ভয় পাচ্ছে। তাই আমরা যখন বলি আমরা উন্নত হচ্ছি, সভ্য হচ্ছি, স্মার্ট হচ্ছি- কিন্তু আমার মতের সঙ্গে না মেলা লেখা বা তথ্যকে সহ্য করতে পারছি না, তখন সেই উন্নয়ন বা স্মার্টনেস প্রকৃতই কতোটা গ্রহণীয় সেটাও একটা প্রশ্ন। 
মনে রাখা দরকার পৃথিবীর ইতিহাসে বহু নিষিদ্ধ বই আজও বরণীয় হয়ে টিকে আছে। কিন্তু যারা এই বইগুলো নিষিদ্ধ করেছিল তাদের কথা কেউ ভালোবাসার সঙ্গে মনে রাখে নাই।
[email protected].

 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status