ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

ই-টিকিট; যাত্রীর স্বস্তি না ঝক্কি

নাসরীন গীতি
১১ মার্চ ২০২৩, শনিবার
mzamin

পরিবহনে নগদ লেনদেন বন্ধ করা গেলে এ খাতের মানোন্নয়ন অসম্ভব কিছু নয়। এজন্য পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এক ছাতার তলায় যে নগর পরিবহনকে রাখার চেষ্টা অব্যাহত, তার শতভাগ বাস্তবায়নও দরকার। দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছাও। কারণ অনেক গণপরিবহনের মালিকই রাজনৈতিক দাপটে চলেন। প্রশাসনকে ঢাল বানিয়ে তারা সড়কটা নিজেদের করে নেন। তাই জনস্বার্থে প্রশাসনকেও কঠোর হতে হবে। নিজ দায়িত্ব পালনে তারা যদি সচেষ্ট হয় এবং বিষয়গুলো আমলে নিয়ে গণপরিবহনকে নিয়মিত নজরদারিতে রাখে, তাহলে শৃঙ্খলা ফেরার আশা থাকে আমাদের গণপরিবহন ব্যবস্থায়।

রাজধানীর ব্যস্ততম সড়ক সায়েদাবাদ টু টঙ্গি রুট। বেসরকারি চাকরিজীবী ইতি মানিকনগর সিগন্যাল থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত সড়কপথটুকু রোজ পাড়ি দেন ১৫ টাকা বাস ভাড়ায়। গত ১লা মার্চ, যথারীতি গাড়িতে উঠে ভাড়া দিতে গিয়ে পড়ে বিপত্তিতে।

বিজ্ঞাপন
ই-টিকিটিং-এ তার আগে দুই স্টপেজ থেকে ওঠা যাত্রাবাড়ীর যাত্রীরা যে দূরত্বে দিচ্ছে ২০ টাকা ভাড়া, তার চেয়ে কম দূরত্বে ইতিকেও দিতে হচ্ছে একই ভাড়া। কারণ ডিভাইসে মাঝের দুই স্টপেজ সংযুক্ত করা নেই। একই ঝামেলায় পড়ে বিরক্ত বাসে থাকা এই রুটের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪/৫ জন শিক্ষার্থীও। অগত্যা বেধে গেল সেই পুরনো গণ্ডগোল। 

ভাড়া নিয়ে গণপরিবহনে হট্টগোল নতুন কিছু নয়। যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। দূরত্ব অনুযায়ী বেঁধে দেয়া ভাড়া কোনো পরিবহনেই যথাযথভাবে মানার নজির নেই। না যাত্রীদের পক্ষ থেকে, না পরিবহন শ্রমিকদের পক্ষ থেকে। সিটিং গাড়িতে যাত্রী উঠছে ৩/৪গুণ। অথচ ভাড়া গুনতে হচ্ছে সিটিং সার্ভিসেরই। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করায় গণপরিবহনে যাত্রী লাঞ্ছনার ঘটনাও কম নয়। গত বছরের এক জরিপেই পাওয়া গেছে ২৫টির মতো ঘটনার কথা। এসব ঘটনায় ১৪ যাত্রীকে বাস থেকে ফেলে হত্যা এবং ১০ যাত্রীকে আহত করা হয়েছে। আর যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে অহরহ যাত্রী উঠা-নামা করাটাও যন্ত্রণার পর্যায়ে পৌঁছেছে। দুর্ঘটনার পর দুর্ঘটনায়ও পাশাপাশি চলা দুই বাসের রেষারেষি বন্ধ হচ্ছে না।  
বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতিও কাজ করছে বেশ অনেক বছর হলো। সুশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থা, সড়ক দুর্ঘটনা নির্মূলসহ বিভিন্ন ইস্যুতে তারা কাজ করে চলেছে। সচেতনতা বৃদ্ধিতে জোরালো ভূমিকা রাখছে। কিন্তু বিশৃঙ্খল সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কর্তাদের কোনো কার্যকর উদ্যোগ কেউ দেখেছে বলে মনে হয়নি গত ৪ দশকেও।    

এইসব ঝামেলা থেকে মুক্তি দিতে রাজধানী ঢাকায় প্রথম পর্বে গত বছরের ১৩ই নভেম্বর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে মিরপুর রুটে ৩০টি কোম্পানির ১৬৪৩টি বাসে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় পর্বে ১৬টি কোম্পানির ৭১৭টি গাড়িতে ই-টিকেটিং চালুু করা হয়। সম্প্রতি (১লা মার্চ থেকে) তৃতীয় পর্বে আরও ১৩টি পরিবহন কোম্পানির ৯৪৭টি বাসে ই-টিকেটিং পদ্ধতিতে যাত্রী পরিবহন করছে।   

এতে কয়েকটি স্টপেজের বাসের ভাড়া কমেছে। কিন্তু এখন হচ্ছে আরেক বিপত্তি, টিকিট দিতে উদাসীন অনেক কন্ডাক্টর। অনেক সময় কনডাক্টর ইচ্ছা করে বাসের দরজা থেকে ভেতরে আসেন না। নামার সময় তাড়াহুড়ো করে টাকা রেখে দেন, কিন্তু টিকিট দেন না। মতিঝিল থেকে মিরপুর রুটের নিয়মিত যাত্রী মিজান জানান, ই-টিকিটিংয়ে বাসের ভাড়া কিছুটা কমেছে। কিন্তু সড়ক বা বাসের ভেতর শৃঙ্খলা ফেরেনি। তাহলে প্রশ্ন হলো, ই-টিকিটিং পদ্ধতিতে পরিবহন ব্যবস্থায় কতোটা সুশৃঙ্খল হলো? 

আগে চালু হওয়া ই-টিকিটিং ব্যবস্থা এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি, এখনো ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে পরিবহন শ্রমিকরা- এমনটাই বলছেন নিয়মিত গণপরিবহন ব্যবহারকারীগণ। কোথাও কোথাও টিকিট দেয়ার ব্যাপারে শ্রমিকদেরই অনীহা বেশি। কারণ এতে ভাড়া তুলতে বেশি সময় ব্যয় হয়। আবার দূরত্ব অনুযায়ী সবার ভাড়া এক না হওয়ায় অনেক যাত্রীরাও টিকিট নিতে চান না। পরিবহন মালিক সমিতি বলছে, এসব ব্যাপার নিরসনে তারা সচেষ্ট আছেন। তবে যাত্রীদেরই সচেতন হতে হবে, টিকিট ছাড়া ভাড়া যাতে না দেন এ বিষয়টিতে গুরুত্বারোপের তাগিদ দেন মালিকরা। 

রাজধানীতে চলাচলকারী অধিকাংশ বাস লক্কড়ঝক্কর হওয়ায় বসার পরিবেশ নেই। তার ওপর সিটিং সার্ভিসের নামে চলে আরেক প্রতারণা। ভাড়া সিটিং গাড়ির, কিন্তু দাঁড়ানো যাত্রীর চাপে বাসগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। বাসগুলোতে কবে যাত্রীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত হবে, এ রকম প্রশ্ন তো থেকেই যাচ্ছে। মালিক সমিতি বরাবরই বলে আসছে, তারাও চায় একটি সুশৃঙ্খল পরিবেশ। তবে সবার আগে তারা ভাড়া নিশ্চিত করতে চান। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে পরিবহন মালিক সমিতির নেতা খন্দকার এনায়েতউল্লাহ এ রকম কথাই বলেছেন। তার মতে, ই-টিকিটিং পদ্ধতি কার্যকর করা অনেক কঠিন। এটি বাস্তবায়নের জন্য তাদের অনেকগুলো দল রাস্তায় কাজ করছে। তবে ভাড়া নিয়ে অনিয়ম দূর করতে আরও সময় লাগবে বলেও স্বীকার করেন পরিবহন মালিক সমিতির এই নেতা। কারণ অসঙ্গতি তো কিছু আছেই। 

যাত্রীদের অভিযোগ, ই-টিকিটিংয়ের ডিভাইসটিতে দূরত্ব অনুযায়ী কিলোমিটার উল্লেখ নাই। এই পদ্ধতিতে প্রকৃত কিলোমিটার হিসাবে কয়েক স্টপেজের যাত্রীদের ন্যায্য ভাড়া নিশ্চিত হয়েছে। তবে প্রতিটি রুটে বেশিরভাগ যাত্রীদের আগের মতোই বেশি ভাড়া গুণতে হচ্ছে। কারণ তাদেরকে নিজ গন্তব্যের বাইরে ন্যূনতম ২/৩ স্টপেজের ভাড়াসহ দিতে হচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ যাত্রীরা টিকিট কাটতে অনীহা দেখান।   

দূরত্ব উল্লেখ করে ভাড়ার চার্ট তৈরি করার জন্য এরই মধ্যে বিআরটিএ’কে অনুরোধ জানিয়েছে পরিবহন মালিক সমিতি। সে অনুযায়ী বিআরটিএ ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির প্রতিনিধিসহ ৪৬টি পরিবহনের স্টপেজের দূরত্ব মাপার কাজ শেষ হয়েছে। দূরত্ব অনুযায়ী কিলোমিটার উল্লেখ করে ভাড়ার চার্ট তৈরির কার্যক্রম চলছে। চার্ট পেলে ই-টিকেটিং এর ডিভাইসে কিলোমিটার সংযুক্ত করা হবে বলে জানায় মালিক সমিতি। 

কিন্তু এরপরও কি স্বস্তি আসবে গণপরিবহন ব্যবহারকারীদের মধ্যে? নগরকর্তারাও চাচ্ছেন নগরের এই বিশৃঙ্খল খাতটিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। পরিবহন মালিক সমিতিও চাচ্ছে শান্তি। কেন অভিযোগের শেষ হচ্ছে না এই গণপরিবহন খাতে। একজন যাত্রী কেন ৬ কিলোমিটার সড়ক পাড়ি দিয়ে ১০ কিলোমিটার সড়কের ভাড়া গুনবেন? যাত্রীরা বলছেন, এর মধ্যেও এক ধরনের কারসাজি আছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের। আর মালিক-শ্রমিকদের বক্তব্য হচ্ছে, তারা যাত্রীদের অনেক ছাড় দিয়েই চলে।   

গত বছর জ্বালানির দাম বৃদ্ধির দোহাই-এ বাস ভাড়া বাড়ানো হয়েছে কয়েক দফায়। এর জের টানতে হচ্ছে যাত্রীকেই। কেননা এরপর জ্বালানির বর্ধিত দাম থেকে (স্বল্প হলেও) লিটার প্রতি ৫ টাকা করে কমানো হলেও, বাস ভাড়া কমানোর নজির কেউ দেখলো না প্রতিদিনকার গণপরিবহনে। 

দেশের গণপরিবহনে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, সড়কের তুলনায় গাড়ির সংখ্যা বেশি, অদক্ষ ও অশিক্ষিত চালক-হেলপার ও তাদের প্রতি মালিকদের অসহনীয় আচরণ, এক চালক একটানা দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানো, যত্রতত্র গাড়ি থামানো ও যাত্রী উঠা-নামা ইত্যাদি নানা সমস্যা তো রয়েছেই। অপরপক্ষে, যাত্রীদেরও সড়কে নামলেই তাড়া বেড়ে যায়। তারা লম্ফঝম্প দিয়ে গাড়িতে ওঠার চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত হয়। বিশেষ করে অফিসগামীদের এই যুদ্ধ প্রতিদিনকার চিত্র। গাড়িতে উঠে ভাড়া নিয়ে, আসন ব্যবস্থা কিংবা দাঁড়ানো নিয়ে কখনো পরিবহন শ্রমিক, কখনো বা যাত্রী-যাত্রীতেই বাধে হট্টগোল। 

যদিও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে এবং পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে রাজধানীতে প্রায়শই অভিযানে নামে বিআরটিএ-এর ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু তখন আরেক ধরনের বিপদে পড়তে হয় গণপরিবহনের যাত্রীদের। অভিযানের ভয়ে কিংবা বিরোধিতা করে কয়েকদিন সড়কে যাত্রীর তুলনায় বাস থাকে খুবই কম। 

এই ধরনের ঘটনা চলমান জীবনে হওয়া উচিত ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু আমাদের ব্যবহারিক জীবনে এই একই চিত্র এখন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ থেকে কী পরিত্রাণ মিলবে? নাকি এখানেও একটি দুষ্টুচক্র তৈরি হয়েছে? 

পরিবহন খাত নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা কয়েকজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়। আরে একটি হলো- গণপরিবহনে নগদ লেনদেন। বাসে এই নগদ লেনদেন বন্ধ করা গেলে, ভাড়ার নৈরাজ্য কমবে। দেশ উন্নত হচ্ছে, কিন্তু পরিবহন খাত উন্নত হচ্ছে না। আদায় করা ভাড়ার টাকা মালিকের পকেটে ঠিকঠাক পৌঁছাবে কিনা, এই চিন্তাটাও দূর করা দরকার। এর জন্য র?্যাপিড পাসের সংযোজন করা যেতে পারে। সেইসঙ্গে চুক্তিভিত্তিক বাস চলাচল বন্ধ করতে হবে। ভাড়া নির্ধারণের যে শর্ত আছে, সেই শর্তানুযায়ীই বাস চালাতে হবে। 

মোদ্দা কথা হলো- পরিবহনে নগদ লেনদেন বন্ধ করা গেলে এ খাতের মানোন্নয়ন অসম্ভব কিছু নয়। এজন্য পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এক ছাতার তলায় যে নগর পরিবহনকে রাখার চেষ্টা অব্যাহত, তার শতভাগ বাস্তবায়নও দরকার। দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছাও। কারণ অনেক গণপরিবহনের মালিকই রাজনৈতিক দাপটে চলেন। প্রশাসনকে ঢাল বানিয়ে তারা সড়কটা নিজেদের করে নেন। তাই জনস্বার্থে প্রশাসনকেও কঠোর হতে হবে। নিজ দায়িত্ব পালনে তারা যদি সচেষ্ট হয় এবং বিষয়গুলো আমলে নিয়ে গণপরিবহনকে নিয়মিত নজরদারিতে রাখে, তাহলে শৃঙ্খলা ফেরার আশা থাকে আমাদের গণপরিবহন ব্যবস্থায়।   

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

 

 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status