ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

আন্তর্জাতিক

সুবিধা পেলে তালেবানও ছাড় দিতে পারে

মোহাম্মদ আবুল হোসেন
১০ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার
mzamin

অল্প কিছু মিডিয়ার খবরে ইঙ্গিত মিলেছে যে, সীমান্ত এলাকায় টিটিপি’কে নিরস্ত্র করতে এবং তাদেরকে শনাক্ত করতে পাকিস্তানের কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়েছে তালেবান শাসকগোষ্ঠী। তবে এমন রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে তালেবানরা। যদি তালেবানরা সত্যিই এমন প্রস্তাব দিয়ে থাকে, তাহলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত এই সুযোগকে লুফে নেয়া। এর অন্য অর্থ হলো আফগানিস্তানের  ভেতরে বিরাষ্ট্রীয় উপাদান উপস্থিত থাকার বিষয়ে জানে তালেবানরা। তাদের পক্ষে সুবিধা পেলে তারা এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে এ নিয়ে দরকষাকষি করতে পারে।

 

দোহা এগ্রিমেন্ট বা দোহা চুক্তির তৃতীয় বার্ষিকীর এক সপ্তাহ আগে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল কাবুল সফরে যায় ২২শে ফেব্রুয়ারি। তারা তালেবান নেতৃত্বকে প্রশংসা জানাতে সেখানে যাননি। তারা গিয়েছিলেন পাকিস্তানে নিষিদ্ধ উগ্রপন্থি সংগঠন তেহরিকে তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) ইস্যুতে গুরুতর বার্তা ও উদ্বেগ পৌঁছে দিতে। কারণ, এই সংগঠনটি পাকিস্তানের ভেতরে মারাত্মক সব সন্ত্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে কয়েকগুণ। এক্ষেত্রে তারা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে। পাকিস্তানের এই প্রতিনিধিদলকে খুবই উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় তালেবানরা।

বিজ্ঞাপন
তবে তারা উল্লেখযোগ্য কিছু দিতে পারেনি পাকিস্তানকে। ২০২০ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি দোহা চুক্তি স্বাক্ষর করে তালেবানরা। তারপর থেকে তারা যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের সঙ্গে একই রকম আচরণ করে আসছে। তালেবানের পক্ষে দোহা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন মোল্লা আবদুল গণি বারাদার। তিনি এখন আফগানিস্তানে ভারপ্রাপ্ত উপ-প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা বা সমঝোতায় নেতৃত্ব দেন তিনি। রিপোর্টে বলা হয়েছেÑ আফগানিস্তানের তালেবান নেতৃত্বকে খুবই ঠাণ্ডা একটি বার্তা দিয়েছে পাকিস্তান। তাতে দাবি জানানো হয়েছে যে, টিটিপি যাতে পাকিস্তানের ভেতরে আক্রমণের জন্য আফগানিস্তানকে ব্যবহার করতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কিছু মিডিয়ার রিপোর্টে বলা হয়েছে, তালেবানদেরকে সতর্ক করেছে পাকিস্তান। তারা বলেছে, আন্তঃসীমান্ত হামলা চালানোর ক্ষেত্রে টিটিপি’কে থামাতে ব্যর্থ হচ্ছে আফগানিস্তান। এটা যদি চলতেই থাকে, তাহলে আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকায় টিটিপি যেসব স্থানে লুকিয়ে আছে, তা টার্গেট করা ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না পাকিস্তানের হাতে। এসব নিয়ে পাকিস্তানের অনলাইন ডনে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। 

 

 

ওদিকে তালেবান নেতৃত্বও তাদের উদ্বেগ তুলে ধরেছে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদের সামনে। গত বছর পাকিস্তানের আকাশসীমা এবং সীমান্ত নিরাপত্তা বিষয়গুলোকে ব্যবহার করে আল কায়েদা প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরিকে কাবুলে হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন। এ বিষয়ে পাকিস্তানের কাছে উদ্বেগ তুলে ধরেছে তালেবানরা। অন্যদিকে আফগানিস্তানে টিটিপি’র উপস্থিতি তারা অস্বীকার করেছে। জবাবে হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতিসহ নিরেট প্রমাণ হাজির করেছে পাকিস্তান। মোল্লা বারাদারের কাছ থেকে ইন্টারেস্টিং একটি যুক্তি এসেছে। তিনি বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোনো রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তার বিষয় অনুমোদন দেয়া উচিত হবে না পাকিস্তানের। 

ভারতও একবার একই রকম পরামর্শ দিয়েছিল পাকিস্তানকে। তবে ইসলামাবাদ তার অবস্থান বজায় রেখে বলেছে, সর্বপ্রথম সমাধান হতে হবে বিতর্কিত কাশ্মীর ইস্যু। কঠোরভাবে তালেবানদের কাছে পাকিস্তানি প্রতিনিধিরা বার্তা দিয়েছেন যে, টিএপিআই চালু, রেলওয়ে প্রজেক্ট চালুসহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার অন্য ক্ষেত্রগুলো নির্ভর করবে আফগান তালেবানরা তাদের দেশে উপস্থিত টিটিপি’র বিষয়ে কি উদ্বেগ দেখায় এবং তা কীভাবে সমাধান করে তার ওপর। আফগানিস্তানের ভেতরে টিটিপি’র উপস্থিতি নিয়ে পাকিস্তানের এই সন্দেহ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। এ নিয়ে তালেবান সরকারের সঙ্গে সরাসরি এবং আনুষ্ঠানিক আলোচনা একটি যথার্থ কৌশল। কিন্তু কঠোর মনোভাব এবং অর্থনীতিতে শর্তসাপেক্ষ নিরাপত্তা ইস্যু অতীতের মানসিকতাই ফুটিয়ে তুলেছে, যা থেকে অতীতে খুব সামান্যই ফল এসেছে। 

দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানি এস্টাবলিশমেন্টকে তালেবান স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। দোহা’র আলোচনার টেবিলে তালেবানদের নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব নিয়েছে পাকিস্তান। দৃশ্যত এখন পাকিস্তানের এ ক্ষেত্রে উচ্চ মাত্রায় প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু তালেবানদের নীতি তাদের সেই প্রত্যাশাকে বিভ্রমে ফেলেছে। তাদের আফগানিস্তান বিষয়ে আর্কিটেক্টদের মধ্যে এ ঘটনা হতাশার সৃষ্টি করেছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও একই রকম ভুল করেছে। তারা নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেয়ে, তাদের মনোভাব হাঁটু ঝাঁকানি প্রতিক্রিয়াভিত্তিক। নিরাপত্তা এবং পররাষ্ট্র বিষয়ক নীতি এখনো এক্সক্লুসিভ বিষয়। এ প্রক্রিয়ায় পার্লামেন্ট বা রাজনৈতিক দলগুলো জড়িত নয়। এর ফলে তালেবানদের ভূমিকা অধিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আফগানিস্তানের ওপর প্রগতিশীল উপায়ে প্রভাব বিস্তারে ব্যর্থ হয়েছে পাকিস্তান। ঘন ঘন সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যেসব আফগান পাকিস্তান সফরে আসেন চিকিৎসা, বাণিজ্য এবং ট্রানজিটের জন্য, তাদের জন্য ভিসায় বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছে। এর পাল্টা ফল এসেছে। পাকিস্তানের জন্য একই সময়ে আফগানিস্তান একটি চ্যালেঞ্জ এবং একই সঙ্গে একটি সম্ভাবনা। চ্যালেঞ্জকে কীভাবে পরিবর্তন করে সম্ভাবনায় রূপ দেবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তার ওপর নির্ভর করে এসব। 

বহুমাত্রিক লেভেলে তালেবান শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত হওয়া প্রয়োজন পাকিস্তানের। এক্ষেত্রে শীর্ষ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নিরাপত্তা সহযোগিতা। তবে বহুজাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা এবং দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি বহু স্তরবিশিষ্ট এনগেজমেন্টের মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে। এর ফলে জটিল কাজগুলো সমাধানে সহায়ক হবে। তালেবান শাসকগোষ্ঠী এরই মধ্যে  বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ এবং বাণিজ্য বিষয়ে মনিটারি পলিসি ঘোষণা করেছে। এতে সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পাকিস্তান। দুই দেশই পণ্য বিনিময় বাণিজ্যের মতো ইস্যুতে আলোচনায় জড়িত হতে পারে। স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য সম্প্রসারণের পথে যেতে পারে। বাণিজ্য এবং ট্রানজিট বিষয়ক ইস্যুগুলো সমাধানে ডজন ডজন আইডিয়া এবং অপশন আছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিস্তৃত নীতির অধীনে সেদিকে অগ্রসর হয় না। যদি রাষ্ট্র নতুন এসব আইডিয়াকে কিছুটা জায়গা দেয়, তবে অদক্ষ ব্যুরোক্রেসি এবং মাফিয়ারা তা ভণ্ডুল করে দেয়। মাফিয়ারা অনানুষ্ঠানিক এবং বেআইনি অর্থনৈতিক কাঠামোকে বেশি পছন্দ করে। 

অল্প কিছু মিডিয়ার খবরে ইঙ্গিত মিলেছে যে, সীমান্ত এলাকায় টিটিপি’কে নিরস্ত্র করতে এবং তাদেরকে শনাক্ত করতে পাকিস্তানের কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়েছে তালেবান শাসকগোষ্ঠী। তবে এমন রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে তালেবানরা। যদি তালেবানরা সত্যিই এমন প্রস্তাব দিয়ে থাকে, তাহলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত এই সুযোগকে লুফে নেয়া। এর অন্য অর্থ হলো আফগানিস্তানের  ভেতরে বিরাষ্ট্রীয় উপাদান উপস্থিত থাকার বিষয়ে জানে তালেবানরা। তাদের পক্ষে সুবিধা পেলে তারা এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে এ নিয়ে দরকষাকষি করতে পারে। 

আফগানিস্তানের তালেবান, টিটিপি এবং আল কায়েদার মধ্যে আদর্শগত বন্ধনের বিষয়কে অস্বীকার করতে পারেন না কেউ। তাই আদর্শের বিষয়ে ছাড় না দিয়ে পাকিস্তান ও অন্যদের সঙ্গে সমস্যা সমাধানে চেষ্টা চালাতে পারে তালেবানরা। এমন উদ্যোগের বিরোধিতা করতে পারেন তাদের ভেতরের কট্টরপন্থি উচ্চ পদস্থরা। কিন্তু কিছু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা তাদেরকে দিলে, তাতে তারা নমনীয় হতে পারেন। এই পরিবর্তন প্রক্রিয়া ধীর হতে পারে। তবে তালেবান, চীন, ইরান, মধ্য এশিয়ার রাষ্ট্রসহ আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে পারে পাকিস্তান। তালেবানদেরকে তাদের কট্টর আদর্শ থেকে বিচ্যুত করাতে সহায়তা করতে পারেন এসব প্রতিবেশী।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status