নির্বাচিত কলাম
কাওরান বাজারের চিঠি
ওয়াজ মাহফিল, একটি পর্যবেক্ষণ
সাজেদুল হক
৬ মার্চ ২০২৩, সোমবার
বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ আদায় করছিলাম। দেশে তখন চাল এবং চালের দাম নিয়ে নানামুখী সংকট চলছিল। জুমার নামাজের পূর্বে দেখলাম খতিব সাহেব এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেন। চাল সংকটের সমাধান কীভাবে হতে পারে পরামর্শ দিলেন সে ব্যাপারেও। অফিসে এসে তা নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট লিখেছিলাম। প্রকাশও হয়েছিল গুরুত্ব দিয়ে। খুতবায় সাধারণত সমসাময়িক বিষয়ে আলোচনা হয় কম। যদিও খুতবায় সমসাময়িক বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার পক্ষে আলেমদের অনেকের মত রয়েছে। এ নিয়ে নানা সংকটও রয়েছে।
কালেমা নিয়ে গজল বা ইসলামী সংগীতটি লেখা হয়েছে মিশরের সাইয়েদ কুতুবের ঘটনার অনুসরণে। কিন্তু বাংলাদেশের একদল আলেমের মধ্যে এ নিয়ে তৈরি হয়েছে তুমুল বিবাদ। প্রথমে একজন আলেম গজলটির তীব্র সমালোচনা করেন। তার কথা হলো- এটি তাদের উদ্দেশ্য করেই লেখা হয়েছে। যারা ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে নজর রাখেন তারা দেখবেন এ নিয়ে এখনো বাহাস চলছে। তবে এটি কোনো অভিনব ঘটনা নয়। সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই চোখে পড়ে। নানা ইস্যুতে আলেমরা আলেমদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছেন। আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ অবশ্য নতুন কিছু নয় এবং এটা অস্বাভাবিকও নয়। এটা চলে আসছে ইসলামের শুরুর সময় থেকেই। বিশেষকরে যেসব বিষয় পবিত্র কোরআন কিংবা সহীহ হাদিস দ্বারা সুনির্দিষ্ট নয় এমন বহু বিষয়েও আলেমদের মতামত দিতে হয়। এক্ষেত্রে একজনের সঙ্গে আরেকজনের মতপার্থক্য হতেই পারে। জ্ঞানের সব শাখাতেই তা হয়। কিন্তু বিস্ময়করভাবে আমরা এটা লক্ষ্য করি, ফতোয়াগত মতপার্থক্যের কারণে এক আলেম আরেক আলেমকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করেন। প্রকাশ্যেই অত্যন্ত আপত্তিকর ভাষায় একে অপরকে আক্রমণ করেন। ন্যূনতম সম্মানবোধ প্রদর্শনেও তারা ব্যর্থ হন। এটা ইসলাম শাশ্বত সৌন্দর্যের বিপরীত। এবং যারা এই আলেমদের রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করেন তাদের জন্য অত্যন্ত হতাশাজনক। এটা যে আলেমদের হতাশ করে না, তা নয়। গত শুক্রবার রাজধানীর তেজতুরি বাজার মসজিদের ইমাম খুৎবা-পূর্ব আলোচনায় বলেছিলেন, ‘হিংসা সর্বত্র। আলেমদের হিংসা আগে গোপন ছিল। কিন্তু এখন ইউটিউবের কল্যাণে সবই ওপেন।’
ছোটবেলা থেকেই মসজিদে এবং মাহফিলে আলেমদের বক্তব্য শুনতাম। এখনো সুযোগ পেলে বিশেষকরে অনলাইন মাধ্যমে তাদের বক্তব্য শুনি। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই কিছু প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। লিখবো লিখবো করেও লিখছিলাম না। নিজের মধ্যে দ্বিধা ছিল। আমি কোনো ইসলামী স্কলার নই। বিশ্বাসী মুসলিম। হয়তো এসব প্রশ্ন অনেকের মনেই আছে। এটা অনস্বীকার্য, বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার প্রসারে আলেমদের ভূমিকা মুখ্য। ওয়াজ মাহফিলগুলোও এক্ষেত্রে বড় অবদান রেখে চলেছে। এসব মাহফিলে বক্তব্য শুনে অনেকেই নিজেকে শুধরে নিয়েছেন। কিন্তু এই লেখকের ধারণা আলেম-ওলামারা বছরের পর বছর ধরে তাদের বক্তব্যকে একটি বৃত্তের মধ্যে বন্দি করে রেখেছেন। পবিত্র কোরআনের একটি বড় অংশ নিয়ে তারা আলাপ-আলোচনা করছেন খুবই কম। যেমন: ঘুষ, দুর্নীতি আমাদের সমাজের একটি প্রধান সমস্যা। বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক খুব কম মানুষ আছে কোনো না কোনোভাবে ঘুষ-দুর্নীতির ভুক্তভোগী হননি। এটা জুলুমও বটে। এ জুলুম ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় অপরাধগুলোর একটি। এখন এ ঘুষ নেন কারা? দুর্নীতি করেন কারা? তারা সবাই এ সমাজেরই মানুষ। আমরা তাদের বিরুদ্ধে খুব বেশি বক্তব্য পাবো না। মসজিদের খুৎবাতেও এ ইস্যুতে যত আলোচনা প্রয়োজন ততটা হচ্ছে না।

ইসলামে মানুষের প্রাণের, জীবনের উচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নরহত্যা বা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করা হেতু ব্যতীত কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকে হত্যা করলো; আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করলো।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৩২)। হাদিসে বলা হয়েছে ‘দুনিয়া ধ্বংস করে দেয়ার চেয়েও আল্লাহর কাছে ঘৃণিত কাজ হলো মানুষ হত্যা করা’ (তিরমিজি)। অপর হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কবিরা গোনাহসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় গোনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া এবং মিথ্যা কথা বলা।’ (বুখারি, মুসলিম)। আমাদের ওয়াজ মাহফিলে প্রাণের এই গুরুত্ব নিয়ে বক্তব্য শুনেছি কম। শুধু মানুষ নয়, ইসলামে প্রতিটা প্রাণেরই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জীবনে এবং আলোচনায় আমরা এর যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারিনি।
ইসলাম এতিমদের সম্মানিত করেছে। এতিমদের প্রতি সদয় হওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কোরআন শরীফে বারবার এতিমদের আলোচনা এসেছে। সূরা বনি ইসরাঈলে বলা হয়েছে, ‘এতিম পরিণত বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তার সম্পত্তির নিকটবর্তী হইও না। তবে সদুপায়ে (সম্পত্তির উন্নতি করার লক্ষ্যে) তা ব্যবহার করা যাবে। আর প্রতিশ্রুতি পূরণ কর। কেননা (কিয়ামতের দিন) প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ এমনকি এতিমের সঙ্গে রূঢ় আচরণকে দ্বীন অস্বীকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তুমি কি দেখেছো তাকে, যে দ্বীনকে অস্বীকার করে? সে তো সে-ই, যে এতিমকে রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয়।’ (সূরা: মাউন, আয়াত: ১-২)। ইসলাম যে এতিমকে এত গুরুত্ব দিয়েছে এ নিয়েও সম্ভবত আলোচনা কম।
উদাহরণ হয়তো অনেক দেয়া যাবে। আলেমদের সমালোচনা করাও এ লেখকের উদ্দেশ্য নয়। বরং ইসলামের বিস্তৃত জগৎ সম্পর্কে আমরা যেন আরও জানার সুযোগ পাই, সেদিকে দৃৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টা মাত্র। এক শ্রেণির আলেম অন্য শ্রেণির আলেমদের যে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন তা যে অনুচিত তা নিয়েও আলোচনা প্রয়োজন। মতভেদ বজায় রেখেও কীভাবে সম্মান করা যায় পরস্পরকে সে পথও খুঁজে বের করা উচিত। প্রয়োজনে এ নিয়ে আলেমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে পারেন। এ ছাড়া, শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অনেক সময়ই কেউ কেউ নানা কেচ্ছা-কাহিনীর অবতারণা করে থাকেন তাও ঠিক কিনা এটা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
দিন-তারিখ মনে নেই। ১৫-১৬ বছর আগের কথা। বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ আদায় করছিলাম। দেশে তখন চাল এবং চালের দাম নিয়ে নানামুখী সংকট চলছিল। জুমার নামাজের পূর্বে দেখলাম খতিব সাহেব এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেন। চাল সংকটের সমাধান কীভাবে হতে পারে পরামর্শ দিলেন সে ব্যাপারেও। অফিসে এসে তা নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট লিখেছিলাম। প্রকাশও হয়েছিল গুরুত্ব দিয়ে। খুতবায় সাধারণত সমসাময়িক বিষয়ে আলোচনা হয় কম। যদিও খুতবায় সমসাময়িক বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার পক্ষে আলেমদের অনেকের মত রয়েছে। এ নিয়ে নানা সংকটও রয়েছে। আমাদের দেশে খুতবা সাধারণত আরবি ভাষাতেই দেয়া হয়। এর পূর্বে বাংলায় আলোচনা করে থাকেন খতিব সাহেব। অল্প কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে বাংলায় খুতবা দিতে দেখছি। এই সব আলেমদের কারও কারও স্পষ্ট মত হচ্ছে, খুতবা মাতৃভাষাতেই দেয়া উচিত। কারণ মানুষ বুঝতে পারেন কিনা সেদিকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
[email protected]