নির্বাচিত কলাম
বেহুদা প্যাঁচাল
দাওয়াত, ধমক, নির্বাচন আসল কথাটা হলো...
শামীমুল হক
৫ মার্চ ২০২৩, রবিবার
হঠাৎ স্থানীয় দুই যুবককে কাছে এনে ঠেসে দিলেন চড়। এরপর বললেন, এরা পর্যটক। দেশ-বিদেশ থেকে এখানে পর্যটকরা আসে বলে তোদের খাবার জুটে। না হলে ভিক্ষা করেও ভাত জুটতো না। পর্যটকদের নিরাপত্তা দেয়া স্থানীয়দের কাজ। আর এ কাজ করতে তোরা ব্যর্থ হয়েছিস।... ঠিক আছে, এই দুই দিন এখানে থাকবেন ফ্রিতে। কোনো টাকা পয়সা দিতে হবে না।
রাত প্রায় ৮টা। বাইরে থেকে হোটেলের রুমে প্রবেশ করেছি মাত্র। সোফায় বসে একটু আরাম করবো ভাবছি। এ সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলতেই বললেন, চলুন। কি ব্যাপার? ব্যাপার ট্যাপার পরে বুঝা যাবে। আগে চলুন। রুম তালা দিয়ে আগন্তুকের সঙ্গে পথচলা। হোটেলের নিচে নামতেই রিকশা দাঁড়ানো। বললেন, উঠুন। কি আর করা? উঠলাম। তিনিও উঠলেন। রিকশাচালককে নির্দেশ দিলেন মহল্লার ভেতর দিয়ে যাওয়ার। প্রায় দশ মিনিট রিকশা চলার পর এক জায়গায় গিয়ে থামলো। জায়গাটা পরিচিত মনে হচ্ছিল। রিকশা থেকে নামলাম। তিনি বললেন আসুন। আগে আগে তিনি, আর পেছনে আমি। বাড়ির ভেতরে প্রবেশের পর চেনা হয়ে গেছে বাড়িটি। এটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির বাড়ি। একটি রুমে প্রবেশ করতেই দেখি, রুমভর্তি মানুষ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জেলা ছাত্রলীগের শীর্ষ এক নেতার তর্জন। কি করেছেন আপনি? এমনটা কেন করলেন? এর মধ্যেই আমাকে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিটি তেড়ে গেলেন ওই ছাত্রলীগ নেতাকে থাপ্পড় দিতে। মুখে দিলেন ধমক। বললেন, আমি নিয়ে এসেছি। উনি কোন মাফের সাংবাদিক তুই চিনোস? অন্যরা এসে তাকে থামালেন। পরিস্থিতি শান্ত হলো। আমাকে এখানে যিনি নিয়ে এসেছেন তিনি আর কেউ নন। এ জেলার আলোচিত সাংবাদিক তোফায়েল আহমেদ। এক সময় তার স্ত্রী আমার সহকর্মী ছিলেন। সেদিন তোফায়েল আহমেদের ভূমিকা আজও আমার মনে পড়ে। যাই হোক- জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম মোজাম্মেল হক আমাকে প্রথমেই বললেন, আপনাকে আমি আজ দুপুরে দাওয়াত দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি আসেননি। আমি বললাম, আমি কি আপনার দাওয়াত রেখেছি? সভাপতি বললেন, রাখেননি। তবে, আমি তো মনে করেছি আপনি আমার কথা রাখবেন। বললাম, আসল কথাটা কি? এবার সভাপতি বললেন, আজকে আপনার পত্রিকায় যা লেখা হয়েছে তার সবটাই সেক্রেটারি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর পক্ষে গেছে। আমি বললাম, রিপোর্টে কি আমার নিজের কথা আছে? সবই তো আপনাদের কথা। আপনি যা বলেছেন তার সবই লিখেছি। সেক্রেটারি সাহেবও যা বলেছেন তার সবটুকু লিখেছি। আমার দোষটি কোথায়? এবার সভাপতি বললেন, সেক্রেটারির কথা আমার চেয়ে অনেক বেশি ছাপা হয়েছে। আমার আরও কথা আছে। আমি সবটুকু বলিনি। এখন আপনাকে সবটুকু শুনে এটি পত্রিকায় ছেপে দিতে হবে। এরই মধ্যে চা-নাস্তা এলো। খাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন সভাপতি। বললাম, যে সভাপতির সামনে সামান্য ছাত্রলীগের নেতা এমন আচরণ করে সেখানে খাবার কি গলা দিয়ে নামবে? লজ্জা পেয়ে গেলেন তিনি। ছাত্রলীগ নেতাকে ধমক দিয়ে বললেন, ক্ষমা চা বেটা। ছাত্রলীগের ওই নেতা উঠে এসে ক্ষমা চাইলেন। আমি সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে বললাম, জেলা আওয়ামী লীগে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব। এ নিয়ে প্রথমে আপনার কাছে এসেছি। আপনি যা বলেছেন, প্রতিটি শব্দ আমি লিখেছি। আপনার কাছ থেকে যাই সেক্রেটারি সাহেবের কাছে। তিনিও দ্বন্দ্ব নিয়ে যা বলেছেন তার সবটুকু লিখেছি। আপনি আমার একাধিক প্রশ্নের জবাব দেননি। সেক্রেটারি সাহেব দিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে সেক্রেটারি সাহেবের বক্তব্য বেশি হয়েছে। এখন আপনি যা বলতে চান তা লিখিত আকারে আমাকে দিন। আমি সেটি অফিসে পাঠিয়ে দেবো। আমি আরও তিন চার দিন এখানে থাকবো। এরমধ্যে পাঠিয়ে দিলেই হবে। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে এলাম। কিন্তু আরও ক’দিন সেখানে ছিলাম। সভাপতি সাহেব আর লেখা পাঠাননি। আমিও আর খোঁজ নেইনি।

দুই হাজার এক সালে কক্সবাজার যাই পত্রিকার এসাইনমেন্ট নিয়ে। জেলার রাজনীতি, দুর্নীতি, সন্ত্রাস নিয়ে ধারাবাহিক রিপোর্ট ছাপা হয় সে সময়। প্রথম রিপোর্টটি নিয়েই ঘটে এ ঘটনা। মজার বিষয় হলো-আগের দিন পত্রিকায় ঘোষণা ছিল, আগামীকাল ছাপা হবে কক্সবাজার আওয়ামী লীগের হালচাল। এ কারণে এজেন্ট অতিরিক্ত পত্রিকা অর্ডার করেন। কিন্তু বেলা ১১টার মধ্যে সব পত্রিকা বিক্রি হয়ে যায়। এরপর চলে ফটোকপি বিক্রি। এ রিপোর্ট নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলে কক্সবাজার জুড়ে।
সেবার কক্সবাজার ছিলাম ৯ দিন। কিন্তু রিপোর্ট নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার সময়টুকুও পাইনি। অথচ সৈকতের পাশ দিয়ে যাওয়া সড়ক দিয়ে একাধিকবার আসা-যাওয়া করেছি। দূর থেকে সৈকত দেখেছি। কাছে গিয়ে সমুদ্রের জল ছুঁতে পারিনি। এটা হয়েছে শুধুমাত্র সময়ের অভাবে।
কক্সবাজারের হোটেল-রেস্তরাঁ নিয়ে রিপোর্ট করার চিন্তা থেকে যাই হোটেলপাড়ায়। সঙ্গে সে সময়ের মানবজমিন প্রতিনিধি মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম। ভদ্রলোক মানুষ। প্রায়ই তিনি আমাকে টেনে নিয়ে যান তার বাসায়। কারণ একটাই তার সঙ্গে খাবার খেতে হবে। যেতে চাইতাম না। তখনই বলতেন, আপনার ভাবি আজ কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী খাবার রান্না করেছে। আর সেটা করেছে আপনার জন্য। নুরুল ইসলাম আমাকে নিয়ে যান হোটেল মালিক সমিতির সভাপতির কাছে। রিপোর্টের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে তার মতামত প্রয়োজন। সভাপতিকে ফোন করলে তিনি বলেন, আমি অমুক রিসোর্টে আছি, সেখানে চলে আসুন। সেখানে গিয়ে দেখলাম দরবারে বসেছেন তিনি। সঙ্গে তার কমিটির সেক্রেটারি সহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ক’জন। কি নিয়ে বিচার? ঢাকা থেকে একদল যুবক গেছেন কক্সবাজার। তারা উঠেছেন ওই রিসোর্টে। একদিন আগে তারা এই রিসোর্টে উঠে সমুদ্র সৈকতে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে স্থানীয় কিছু যুুবকের সঙ্গে সামান্য বিষয় নিয়ে তাদের কথা কাটাকাটি হয়। স্থানীয়রা তাদের দুয়েক জনকে মারধরও করেন। মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যান। ঢাকা থেকে যাওয়া যুবকরা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। এ রিপোর্ট যায় হোটেল মালিক সমিতির কাছে। তারা এ নিয়ে সালিশে বসেন। আমি ও নুরুল ইসলাম দর্শক। চুপ করে বসে আছি। হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি একে একে দুই পক্ষের বক্তব্য শুনলেন। এখন রায়ের পালা। হঠাৎ স্থানীয় দুই যুবককে কাছে এনে ঠেসে দিলেন চড়। এরপর বললেন, এরা পর্যটক। দেশ- বিদেশ থেকে এখানে পর্যটকরা আসে বলে তোদের খাবার জুটে। না হলে ভিক্ষা করেও ভাত জুটতো না। পর্যটকদের নিরাপত্তা দেয়া স্থানীয়দের কাজ। আর এ কাজ করতে তোরা ব্যর্থ হয়েছিস। ঢাকা থেকে যাওয়া যুবকদের জিজ্ঞেস করলেন আপনারা ক’দিন থাকবেন। তারা জানালো, আর দুই দিন। ঠিক আছে, এই দুই দিন এখানে থাকবেন ফ্রিতে। কোনো টাকা পয়সা দিতে হবে না। খাওয়া-দাওয়া করবেন অমুক হোটেলে। সেটাও ফ্রিতে। স্থানীয়দের ক্ষমা চাইতে বললেন। তারা ক্ষমা চাইলো। সবশেষ নিজের পকেট থেকে ঢাকায় ফেরার গাড়ি ভাড়া একজনের হাতে তুলে দিলেন। বললেন, কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন। আমার জীবনের সেরা বিচার দেখলাম সেদিন। অবাকও হলাম।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে যাওয়া কক্সবাজারে অনেক ঘটনার আরেকটি হলো- জেলার সন্ত্রাসী তালিকায় কারা আছেন? কক্সবাজার সদর থানা থেকে অনেক কৌশল করে সে তালিকা সংগ্রহ করেছি। তালিকা ধরে ধরে সন্ত্রাসীর নাম পত্রিকায় ছাপা হয়। আর যায় কোথায়? তালিকায় থাকাদের অনেকেই শুরু করেন দৌড়ঝাঁপ। পুলিশও ক্ষুব্ধ হন। তাদের গোপন তালিকা কেন প্রকাশ্যে আনা হলো। তৎকালীন ওসি ফোন করে বলেন, ভাইজান আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে গেছে। কেন এটা ছাপালেন? এ তালিকা কার কাছ থেকে পেয়েছেন? আমি বললাম, তালিকা ঠিক আছে কিনা? রিপোর্টে তালিকার বাইরের কারও নাম দেয়া হয়েছে? তিনি বললেন, সবই ঠিক আছে। কিন্তু এ তালিকা শুধু আমাদের জন্য। আপনি তো প্রকাশ করে দিলেন। এতে প্রচ- চাপে আছি।
একের পর এক রিপোর্ট ছাপা হতে থাকলো। কক্সবাজার জুড়ে আলোচনার শীর্ষে মানবজমিন। আওয়ামী লীগ সরকার তখন ক্ষমতায়। আর তাই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে চলছে নেতায় নেতায় লড়াই। সে লড়াইয়ের রিপোর্ট সংগ্রহ করতে গিয়েও আরেক বিপদ। এক নেতা আরেক নেতার নাম নিয়ে গালমন্দ। প্রতি নির্বাচনকে সামনে রেখেই দেশে এটা হয়। বর্তমানেও চলছে আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নেতাদের লড়াই।
উখিয়ায় গিয়ে নজরে পড়লো পরিবার পরিকল্পনার বালাই নেই। পাহাড়ের মাঝে মাঝে বাড়ি। একেক পরিবারে ছয় সাতজন সন্তান। কেউ কোলে, কেউ মাটিতে বসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। একাধিক গৃহিণীকে জিজ্ঞেস করলাম পরিবার পরিকল্পনার কোনো লোক কি আপনাদের এখানে আসেন? তারা জানান, পরিবার পরিকল্পনা কী তারা জানেন না। কেউ কোনোদিন এখানে আসেননি। অথচ উখিয়ায় পরিবার পরিকল্পনা অফিসে দিব্যি কাজ করছেন কর্মকর্তা- কর্মচারীরা। তাদের রয়েছে মাঠকর্মীও। এ নিয়ে রিপোর্টও সাড়া জাগিয়েছিল।
সে সময় সমুদ্র সৈকত না দেখতে পারলেও এরপর দুই বার কক্সবাজার গিয়েছি পর্যটক হিসেবে। তখন মাথায় ছিল না এসাইনমেন্টের চাপ। পর্যটক হিসেবে ঘুরে বেড়িয়েছি গোটা কক্সবাজার। তখন সহকর্মী কাফি কামালও সঙ্গে ছিলেন। কক্সবাজার যাওয়ার পথে তার বাড়িতে খানিক বিরতি দেই। আর কক্সবাজারে সঙ্গ দেন কক্সবাজারের স্টাফ রিপোর্টার রাসেল চৌধুরী। এবার সমুদ্রের জল ছুঁয়ে দেখেছি। জলের সঙ্গে মিতালি করেছি।