ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

খোলা চোখে

মানুষের ভাতের ক্ষুধার কাছে সব ক্ষুধাই তুচ্ছ

রুমিন ফারহানা
১ মার্চ ২০২৩, বুধবার
mzamin

যে দেশ ধনী বৃদ্ধির হারে রেকর্ড করে, যে দেশের মানুষের একটা অংশ কানাডা কিংবা মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানায়, যে দেশে প্রতি বছর প্রায় লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়, ব্যাংক, শেয়ারবাজার, বিদ্যুৎ খাত থেকে হাজার কোটি টাকা লোপাট করে একটা গোষ্ঠী সেই দেশেই প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো কয়েক কোটি মানুষ শুধুমাত্র টিকে থাকার আপ্রাণ লড়াই চালায়। কখনো অল্প কিছু টাকা বাঁচানোর চেষ্টায় ওএমএসের লাইনে দাঁড়ায়, কখনো টিসিবি’র ট্রাকের সামনে লম্বা লাইন ধরে, কখনো ভিক্ষা করে, ঋণ করে, বাকিতে নিয়ে, জমি বিক্রি করে আপ্রাণ চেষ্টা করে টিকে থাকার। উন্নয়নের বয়ানের সঙ্গে যায় না বলে ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা থেকে ভিক্ষুক উচ্ছেদের উদ্যোগ নেয় সরকার।


‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো’ কবি রফিক আজাদের বিখ্যাত কবিতার লাইন। ৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে লেখা। মানুষের ভাতের ক্ষুধার কাছে আর সব ক্ষুধাই তুচ্ছ। বাড়ি, গাড়ি, টাকা কড়ি, খ্যাতিসহ যা কিছুর পেছনে দৌড়ে মানুষ তার সবটাই ম্লান হয়ে যায় ভাতের ক্ষুধার কাছে। ভাতের ক্ষুধা ভয়ঙ্কর, এজন্য মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ নেই।   গত কয়েক বছর আমরা কেবল উন্নয়নের গল্প শুনেছি সরকারের কাছে। এই গল্পের সামনে দাঁড়াতে পারেনি মানুষের ভোটের অধিকার হারানোর কথা, মানবাধিকার হরণের কথা কিংবা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নষ্ট হওয়ার কথা। এই উন্নয়নের গল্পও সাধারণ মানুষের উন্নয়নের গল্প না।

বিজ্ঞাপন
এতে আছে কেবল মেগা প্রকল্প, প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভ আর মাথাপিছু আয়ের কথা। গত কয়েক বছর টানা একটা সরকার ক্ষমতায় থাকায় কিছু মানুষের ভাগ্যের যে বেসামাল উন্নয়ন হয়েছে তা অস্বীকারের উপায় নেই। পাকিস্তানে যে ২২ পরিবারের অর্থ, বিত্ত আর সম্পদের কথা শোনা যেতো, যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ে আজকের বাংলাদেশের জন্ম সেই রকম কয়েকটি পরিবার  তৈরি হয়েছে গত কয়েক বছরেই। এই গুটি কয় পরিবারের হাতে জিম্মি বাংলাদেশ। 

 

 

 হাতেগোনা কিছু পরিবারের হাতে কি পরিমাণ সম্পদ জমা হয়েছে সেটি বোঝা যায় বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্ট থেকে। অতি ধনী বৃদ্ধির হারে বিশ্বের সব দেশকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্সের তথ্য মতে ২০১২ সাল থেকে এই বৃদ্ধির হার ১৭ শতাংশ যা যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান বা ভারতের মতো ৭৫টি বড় অর্থনীতির দেশের চেয়ে বেশি। অতি ধনী হচ্ছে তারাই যাদের সম্পদের পরিমাণ ২৫০ কোটি টাকার উপরে। তাহলেই বোঝেন কিছু মানুষের সম্পদের পরিমাণ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। সরকারি বয়ানের এই তথাকথিত অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে দেশের হাতেগোনা কিছু মানুষের জীবনযাত্রার মানে পরিবর্তন এসেছে, এটা যেমন সত্য, তেমনি আবার একটা শ্রেণির হাতে বড় অংশের সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে সেটাও সত্য। ফলে বৈষম্য বাড়ছে হু হু করে। দেশে স্বজনতোষী পুঁজিবাদ বা ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের কারণে অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুৎকেন্দ্র, ব্যাংকের মতো ব্যবসা পাচ্ছে সরকারের কাছের লোকেরা। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পরিসর ছোট হয়ে আসছে। 

এতেই একটা শ্রেণির হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে প্রতি নিয়ত। এতো গেল অতি ধনী বৃদ্ধি আর বৈষম্যের কথা। ধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। ধনী হচ্ছে তারাই যাদের সম্পদের পরিমাণ ৮ কোটি থেকে ২৫০ কোটি টাকার মধ্যে।  ধনীদের স্বর্গরাজ্য সুইজারল্যান্ড। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা গোপন আমানত জমা রাখতে সেখানে গড়ে উঠেছে তিনশ’র বেশি বেসরকারি ব্যাংক। এরমধ্যে সব চেয়ে বড় ব্যাংকটি হলো ক্রেডিট সুইস। ব্যবসায়িক কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সম্পদশালীদের তথ্য সংগ্রহ করে থাকে জুরিখভিত্তিক এই ব্যাংকটি। প্রায় দেড় দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সম্পদশালীদের পরিসংখ্যান নিয়ে ডেটাবেজ তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা উইং, যা প্রকাশ হয় গ্লোবাল ওয়েলথ ডেটাবুক শিরোনামে। ক্রেডিট সুইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের  তৈরি করা ডেটাবেজটির সর্বশেষ প্রকাশিত ২০২২ সালের সংস্করণে দেখা যায়, বাংলাদেশে এখন ৫০ কোটি ডলার বা ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিমাণের সম্পদ আছে ২১ ব্যক্তির কাছে। কোভিড মহামারির মধ্যেও ২০২১ সালে দেশে ১০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে, এমন ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪৩ শতাংশ। বাংলাদেশের মতো কর্তৃত্বপরায়ণ দেশে তথ্যের অপর্যাপ্ততা আছে, আছে তথ্যের বিকৃতি। তাই যে তথ্য নিয়ে ক্রেডিট সুইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট এই  ডেটাবেইজ  তৈরি করেছে প্রশ্ন তোলা যায় সেই তথ্যের যথার্থতা নিয়েও। আর সে কারণেই আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, ধনীদের সংখ্যা এর চাইতে অনেক বেশি হবে। কিন্তু এই সংখ্যাগুলোকে সঠিক বলে ধরে নিলেও, বাংলাদেশের মতো একটা দরিদ্র দেশে এত বড় পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকা এবং বিশেষ করে করোনার সময় সম্পদশালী মানুষের সংখ্যার এত বৃদ্ধির মানে বুঝে সবাই।    

 এই তথ্যগুলোর মধ্যেই বলে রাখি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬ অনুযায়ী, ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে দেশে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের আয় প্রায় ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। তাদের মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৯৪১ টাকায়। বিপরীতে একই সময় সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে ৫৯ শতাংশ। তাদের মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ৭৩৩ টাকায়, যা ২০১০ সালে ১ হাজার ৭৯১ টাকা ছিল। ধনীরা আরও ধনী হয়েছে, দরিদ্র আরও দরিদ্র হয়েছে। বৈষম্য কি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বুঝতে এর বেশি কিছুর দরকার হয় না। এরমধ্যেই ৭ বছর পার হয়েছে। করোনার মতো ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মধ্যদিয়ে গেছে বিশ্ব, এ ছাড়া রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে গত ৫০ বছরেও বিশ্ববাজার এত অস্থিরতার ভেতর  দিয়ে যায়নি। কিন্তু বিবিএসের সময় হয়নি খানা জরিপ হাল নাগাদ করার। অথচ খানা আয়-ব্যয় জরিপের মান ও বিস্তৃতির কারণে শহর এবং গ্রামে দারিদ্র্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। এটি থেকে শুধু দরিদ্রের সংখ্যা সম্পর্কেই ধারণা পাওয়া যায় না, তাদের জীবনযাপনের মান, পুষ্টি, আয়-ব্যয়, সম্পদের অবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মূল্যস্ফীতির প্রভাব ও পরবর্তী অবস্থাও বোঝা যায়। 

খানা আয়-ব্যয় জরিপের মাধ্যমে পুরো দেশের খানার ভোগ ও চাহিদার তথ্য মেলে, যা সরকারকে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়তা করে। কিন্তু কোনো সরকারের যদি ব্যবস্থা নেয়ার ন্যূনতম কোনো তাগিদ না থাকে বরং দায় থাকে প্রকৃত চিত্র লুকাবার তাহলে সে সত্যিই চাইবে না এ ধরনের জরিপ করে একটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে। আর সে কারণেই করোনাকালে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা জরিপ চালিয়ে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির এবং শ্রেণি কাঠামো পাল্টে যাওয়ার তথ্য একটির পর একটি সামনে আনলেও সরকার এ বিষয়ে ছিল সম্পূর্ণ নীরব।  অতি ধনী বৃদ্ধির হারে প্রথম কিংবা ধনী বৃৃদ্ধির হারে তৃতীয় হওয়া বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ কেমন আছে? অর্থনীতিবিদদের মতে মূল্যস্ফীতি যখন ডাবল ডিজিট পার হয়েছে অনেক আগে তখন সীমিত আয়ের মানুষ চলছে কেমন করে? চাল থেকে প্রসাধন সামগ্রী সব কিছুর দাম বাড়ছে হু হু করে। অল্প কিছু চালের আশায় ওএমএসের দীর্ঘ সারিতে কেবল নিম্নবিত্তই নয় মুখ ঢেকে দাঁড়িয়েছে নিম্ন থেকে মধ্যবিত্ত পর্যন্ত অনেকেই। একই অবস্থা টিসিবি’র লাইন ঘিরে। পণ্য পাওয়ার আসায় ভোর ৪টা থেকে লাইনে দাঁড়ায় অসহায় মানুষ। একটু দেরি হলেই থাকে পণ্য না পাওয়ার ঝুঁকি। অসুস্থ, বৃদ্ধ থেকে ছোট্ট শিশু লাইনে আছে সকলেই। সামান্য কিছু টাকা বাঁচানোর এ এক প্রাণান্ত প্রচেষ্টা।

  ডব্লিউএফপি’র প্রতিবেদন বলছে খাদ্যের দাম বাড়ায় বেঁচে থাকতে তিন উপায় বেছে নিয়েছে মানুষ। তাদের তথ্য মতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে সঙ্গে তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সবচেয়ে বেশি বিপদে আছে দেশের অর্ধেকের (৫৩ শতাংশ) বেশি মানুষ। খাদ্যের দাম লাগামহীন হওয়ায় তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদনের মতো বিষয়গুলোতে কাটছাঁট করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে তারা। ডব্লিউএফপি’র প্রতিবেদন বলছে কেবলমাত্র খাদ্যের উচ্চমূল্য ৬৮ শতাংশ মানুষের জন্য গভীর দুশ্চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চালের দাম এক বছরে বেড়েছে ১১ শতাংশ আর কোভিডের আগের তুলনায় বেড়েছে ৬১ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির চাপে যে ৫৩ শতাংশ মানুষ দিশাহারা তারা পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে থাকার জন্য বেছে নিয়েছে তিন উপায়। এরমধ্যে ২৮ শতাংশ পরিবার বাকিতে খাবার কিনছে, ৫৩ শতাংশ ঋণ করছে, ১৫ শতাংশ তাদের সঞ্চয় ভেঙে প্রতিদিনের খরচ যোগাচ্ছে। ৪ শতাংশ জমি বেঁচে বা জায়গা বদল করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। যে দেশ ধনী বৃদ্ধির হারে রেকর্ড করে, যে দেশের মানুষের একটা অংশ কানাডা কিংবা মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানায়, যে দেশে প্রতি বছর প্রায় লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়, ব্যাংক, শেয়ারবাজার, বিদ্যুৎ খাত থেকে হাজার কোটি টাকা লোপাট করে একটা গোষ্ঠী সেই দেশেই প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো কয়েক কোটি মানুষ শুধুমাত্র টিকে থাকার আপ্রাণ লড়াই চালায়।

 কখনো অল্প কিছু টাকা বাঁচানোর চেষ্টায় ওএমএসের লাইনে দাঁড়ায়, কখনো টিসিবি’র ট্রাকের সামনে লম্বা লাইন ধরে, কখনো ভিক্ষা করে, ঋণ করে, বাকিতে নিয়ে, জমি বিক্রি করে আপ্রাণ চেষ্টা করে টিকে থাকার। উন্নয়নের বয়ানের সঙ্গে যায় না বলে ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা থেকে ভিক্ষুক উচ্ছেদের উদ্যোগ নেয় সরকার। রাস্তার ধারে ফুটপাথে খোলা আকাশের নিচে শোয়া মানুষ, পথে দাঁড়ানো ভিখারি, ওএমএসের লাইনে চালের আশায় দাঁড়ানো মানুষ কিংবা টিসিবি’র ট্রাকের পেছনে দীর্ঘ সারি সরকারের উন্নয়নের বয়ানকে ব্যঙ্গ করে প্রতি মুহূর্তে। আর বড় বড় ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, স্যাটেলাইটের ভিড়ে চাপা পড়তে থাকে সাধারণ মানুষের আর্তনাদ, ক্ষুধা আর কষ্ট। ৭৪ সালে যে কবিতা লেখার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন রফিক আজাদ, তেমন কবিতা লেখার সাহসও এখন কারও নাই।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status