ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

পাকিস্তানকে মেরূকরণ করা এক সাবেক সেনাপ্রধান

মোহাম্মদ আবুল হোসেন
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বৃহস্পতিবার
mzamin

কথায় বলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব ক্ষত সেরে যায়। এমনকি কাল্পনিক ক্ষতও। অন্য সব ক্ষতের সঙ্গে ভালোবাসার ক্ষত কি আসলেই তেমন! ভালোবাসার ক্ষত কি কখনো শুকায়! হয়তো শুকায়। কিন্তু তা ক্ষণকালের জন্য। আকাশে মেঘ দেখলে যেমন পৃথিবীর মাটি আর্দ্র হয়ে ওঠে, তৃষ্ণার্ত হয়, ভালোবাসার ক্ষতও হয়তো তেমন। তা ক্ষণকালের জন্য হারিয়ে যায়। কিন্তু স্মৃতির অতলে হারায় না। এ জন্যই অসংখ্য মানুষের ভালোবাসায় বিচ্ছেদের পর থেকে যান একা, নিঃসঙ্গ। সেই ক্ষত তার হৃদয়ে অদৃশ্য হয়। কিন্তু বার বার কুরে কুরে খায়।

বিজ্ঞাপন
এ এক অন্য প্রসঙ্গ। এক কথা বলতে গিয়ে অন্য কথায় চলে যাচ্ছি। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও কিংবদন্তি ক্রিকেটার ইমরান খান ও সাবেক সেনাপ্রধান (অবসরপ্রাপ্ত) জেনারেল জাভেদ কমর বাজওয়ার অন্তরঙ্গতা, বিচ্ছেদ নিয়ে লিখতে গিয়ে কলম পিছলে গিয়েছিল। মিডিয়ায় আলোচনা আছে এবং পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, ইমরান খানকে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় এনেছিলেন বাজওয়া। এতে তাদের মধ্যে অন্তরঙ্গতার বহিঃপ্রকাশ পায়। কিন্তু জেনারেল বাজওয়ার ক্ষমতার মেয়াদের শেষের দিকে এসে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ওলট-পালট হয়। ইমরান খানের নীতির কারণে সেনাপ্রধান বাজওয়ার সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়তেই থাকে। এক পর্যায়ে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা হারান ইমরান। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্র, দেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন ইমরান খান। ক্ষমতা হারানোর পর তার লংমার্চে গুলি চালানো হয়। এর জন্য তিনি সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা, সেনাবাহিনীর প্রথম সারির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলাই ঠুকে দেন। 

 জেনারেল বাজওয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগের পর অভিযোগ তুলতে থাকেন। ফলে বহুল আলোচিত এই দুই নেতার মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। ফল হিসেবে সেনাবাহিনী আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ক বিভাগ আইএসপিআর বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়। তাতে ইমরান খানের অভিযোগের জবাব দিয়ে পাল্টা তার বিরুদ্ধে নানা প্রশ্ন ছুড়ে মারা হয়। দৃশ্যত, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চেয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, বিশেষত জেনারেল বাজওয়া যেন ইমরান খানের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন। এ নিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে তোলপাড় হয়। কারণ, একটি দেশের সবচেয়ে শক্তিধর প্রতিষ্ঠান হলো সেনাবাহিনী। তাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের কোনো বিরোধ থাকে না। থাকে বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব, সেই ভালোবাসা তিক্ত হতে হতে নিমপাতার রসের মতো মধুর (!) হয়ে ওঠে পাকিস্তানে। এমনি চলতে চলতে সেনাপ্রধান হিসেবে বিদায় নেন জেনারেল বাজওয়া। বিদায় নেয়ার আগে তিনি বার বার  সেনাবাহিনীকে ছবক দিতে থাকেন। বলেন, সেনাবাহিনীকে সবসময় থাকতে হবে অরাজনৈতিক। সেনাবাহিনী কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। তারা রাষ্ট্রের অখণ্ডতা, বিদেশি শক্তির আগ্রাসন থেকে দেশকে রক্ষায় আত্মনিবেদিত। তারপরও তাকে ছেড়ে কথা বলেন নি ইমরান। এই যে দা-কুমড়ো সম্পর্ক তা দৃশ্যত সাম্প্রতিক সময়ে আরও কঠিন হয়েছে। ইমরান খানের সুর কিছুটা নরম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে। অন্যদিকে ইমরান খানকে পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে অভিযোগ করেছেন জেনারেল বাজওয়া। এর জবাবে প্রকাশ্যে সাবেক সেনাপ্রধানকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে বক্তব্য বাড়িয়ে দিয়েছেন ইমরান খান। কেউ কেউ বলতে পারেন, এখন যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন বলে, তিনি ‘ভুলে যাও এবং ক্ষমা করে’ দেয়ার মুডে আছেন। যুক্তরাষ্ট্রকে ঘায়েল করে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে তার কতোটা ক্ষতি হয়েছে বা হতে পারে তা তিনি ঠাহর করতে পারেন। পাকিস্তানের অনলাইন ডনের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ইমরান খান এখন আর বাইডেন প্রশাসনকে বিদেশি বিশ্বাসঘাতক শক্তি হিসেবে দেখেন না। অথচ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তাকে ক্ষমতা থেকে এই যুক্তরাষ্ট্র উৎখাত করেছিল বলে তিনি জোর বক্তব্য দিয়েছিলেন। 

সম্প্রতি ভয়েস অব আমেরিকাকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ইমরান খান। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী এতে ভীরুতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করেছেন যে, নতুন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কি সেই নতুন তথ্য! এমন কৌতূহল জাগা খুবই স্বাভাবিক। সেই নতুন তথ্য হলো- তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে বিদেশি কোনো কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন না, যারা তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছে। কিন্তু তিনি এবারও জেনারেল বাজওয়াকে ছেড়ে দেননি। বলেছেন, বিদেশিরা নয়, তার নিজের সেনাপ্রধানই ওয়াশিংটনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন- ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে যেতে হবে। 

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য ইমরান খানকে সবচেয়ে বড় হুমকি বলে বর্ণনা করেছেন সাবেক সেনাপ্রধান বাজওয়া। তার এই বক্তব্যের জবাবে ইমরান খান ইউ-টার্ন নিয়েছেন বলে মনে করা হয়। ওই সাক্ষাৎকারে জেনারেল বাজওয়া আরও বলেন, ইমরান খান যদি অব্যাহতভাবে ক্ষমতায় থাকতেন, তাহলে পাকিস্তান বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হতো। দৃশ্যত, এ কারণেই তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব বক্তব্যের কারণে জেনারেল বাজওয়ার দিকে সরাসরি সমালোচনার বন্দুক তাক করতে ইমরান খান উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। 

তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে পাকিস্তান কি অর্জন করেছে- এ নিয়ে প্রশ্ন করেছেন ইমরান খান। এমন প্রশ্নের সম্ভবত যৌক্তিক কারণও আছে। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন এ জন্য যে, তার উত্তরসূরিরা দেশের অর্থনীতিকে শোচনীয় করে তুলেছেন। এর মধ্য দিয়ে দেশ আরও রসাতলে গিয়েছে। সরকারের বেশির ভাগ ক্ষমতা জেনারেল বাজওয়া চর্চা করতেন বলে অভিযোগ করেন ইমরান। বলেন, পক্ষান্তরে সব দোষ চাপানো হয়েছে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফের (পিটিআই) বিরুদ্ধে। যদিও ইমরান খানের এসব অভিযোগ বেপরোয়া এবং সময়ের সঙ্গে সুবিধাজনক বলে মনে হচ্ছে, এতে সত্যের মূল বিষয় বলে মনে করা হয়। 

পিটিআই এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএলএন) অন-রেকর্ড সাবেক এই জেনারেলের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ করেছে। তারা অভিযোগ করেছে যে, এই জেনারেল পর্যায়ক্রমিক সরকারের পতন ঘটিয়েছে। তবে তার হস্তক্ষেপের বিষয়টি কখনোই হয়তো প্রকাশ্যে আসবে না। তবে জেনারেলের নিজস্ব বিবৃতি থেকে মনে হয়, তিনি এসব বিষয়ে তীব্র আগ্রহ দেখিয়েছিলেন- যা তার নাগালের বাইরে ছিল। 

তার আওতাবহির্ভূত কার্যকলাপের ফল ছিল বিপর্যয়কর। তিনি যখন এক পক্ষের হয়ে খেলেছেন এবং পরে অন্য পক্ষের, তখন দেশ ক্রমশ মেরূকরণ হয়েছে। তার সমালোচকরা বলেন, তিনি যা করেছেন তা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য। এমনকি যদি দেখতেন যে, জনস্বার্থে কাজ করছেন। ফলে আগের যেকোনো সেনাপ্রধানের তুলনায় খুব বেশি ইমেজ সংকট নিয়ে বিদায় নিয়েছেন জেনারেল বাজওয়া। এতে জেনারেল বাজওয়ার মেয়াদে রাষ্ট্রের এবং প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির পরিমাণ আমলে নিয়ে বলা যায়, এর পেছনে নিশ্চয় কোনো না কোনো কারণ আছে। ডনের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, জেনারেল বাজওয়ার সময়কে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। এর জানা-অজানা সব বিষয়ের পরীক্ষিত তথ্য জনগণের সামনে অবশ্যই আনতে হবে।    

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status