ঢাকা, ২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

খোলা চোখে

চাপা থাকছে না ডলার সংকটের ভয়াবহতা

রুমিন ফারহানা
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার
mzamin

রাষ্ট্রের এক চরম সংকটের সময় কথা ছিল নাগরিকরা জানবেন সংকটের ব্যাপ্তি এবং তীব্রতা কতোটুকু , কতোটুকু সময় দীর্ঘ হতে পারে এই সংকট। এমন চরম সংকটের সময় কী করা উচিত তার একটা দিকনির্দেশনাও সরকারের কাছ থেকে আসার কথা। একটি অগণতান্ত্রিক সরকারের সময়ের অনেক সংকটের মধ্যে একটি হলো সরকারটির দেয়া তথ্যে আস্থাহীনতা। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারটি যেহেতু তথাকথিত উন্নয়নকে বিনা ম্যান্ডেটে ক্ষমতায় থাকার অস্ত্র বানিয়েছে, তাই তাদের পক্ষে অর্থনীতির চলমান সংকট স্বীকার করা কার্যত অসম্ভব। ফলে সরকার আমাদের সামনে অর্থনীতি নিয়ে নানা তথ্য হাজির করে যেগুলোর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিলই নেই


আইনে সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স বলে একটা কথা আছে। কোনো ঘটনার সরাসরি কোনো প্রমাণ না পাওয়া গেলে, সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্সের ওপর নির্ভর করতে হয়। মূল ঘটনা ঘটার সময় ঘটে যাওয়া অন্য আরও কিছু ঘটনার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় সেই ঘটনাগুলোই ইঙ্গিত করে মূল ঘটনার হোতা কারা। কে, কবে, কখন, কী করে ঘটনা ঘটিয়েছে, কারা কারা সম্পৃক্ত, কেন সম্পৃক্ত সব কিছুরই একটা উত্তর পাওয়া যায় সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স থেকে। কথাগুলো বলছি এই কারণেই যে সরকারের তথ্য লুকানো, মিথ্যা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দেয়া, আসল চিত্র মানুষের সামনে থেকে সরিয়ে রাখা অবস্থায় প্রকৃত চিত্র কী সেটা বের করা অনেক সময়ই চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে অর্থনীতির আসল অবস্থা মানুষের চোখের আড়ালে রাখা এই ধরনের সরকারের একটা প্রবণতা।

বিজ্ঞাপন
 বহুদিন ধরেই অর্থনীতিতে নানামুখী সংকট চলছে। ডলার ক্রমেই দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠা, আমদানি রপ্তানির ভারসাম্যহীনতা, রিজার্ভ সংকট, ব্যাংকের তারল্য সংকট, সবমিলিয়ে সরকার খুব স্বস্তিতে নেই। সেটারই নানা রকম বহিঃপ্রকাশ ইদানীং দেখছি আমরা। ডলারের সংকট শুরুর পর থেকেই সরকারের নানা পর্যায় থেকে বলার চেষ্টা হয়েছিল বিষয়টি সাময়িক। কতটা ‘সাময়িক’, সেটা একেবারে সুনির্দিষ্ট করে বলেছিলেন সরকারের দুই অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তারা বলেছিলেন, জানুয়ারি থেকেই ডলারের সংকট আর থাকছে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। শুরুতে বিলাসী পণ্য আমদানিতে এক ধরনের রেসট্রিকশন দিয়ে আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। শতভাগ মার্জিন দিয়েও ঋণপত্র খোলা যায়নি। ধারণা করা হয়েছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবস্থার পরিবর্তন হবে। পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই; অবস্থার অবনতি হয়েছে। এখন কেবল বিলাসী পণ্যই নয় এমনকি আমদানি করা যাচ্ছে না নিত্যপ্রয়োজনীয় বহু পণ্যই। পরিশোধ করা যাচ্ছে না বিদেশি বিমান ও জাহাজ ভাড়া।    

গত কয়েক মাস আগে থেকেই ডলার সংকটের কারণে করা নানা রকম আমদানি থমকে গেছে, এমন সংবাদ আমাদের সামনে নিয়মিত ভাবেই আসছিল। বিলাসী পণ্য নয়, এমন অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নিয়ে সমস্যা  তৈরি হয়েছে। রমজানকে সামনে রেখে আমদানি করা তেল, চিনির মতো অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্যপণ্য বন্দরের আসার পরও খালাস করা যায়নি ডলারে এলসি’র দায় পরিশোধ করা যায়নি বলে। ফলে লাগাম ছাড়া হচ্ছে ভোগ্যপণ্যের দাম, বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। পায়রা, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি না করতে পারার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সংকট তৈরি হয়ে ঢাকাবাসী মাঘ মাসেও লোডশেডিং দেখেছে। এই সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে গত দুই সপ্তাহে প্রকাশিত কিছু সংবাদ, যা সত্যিকার অর্থেই পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে ফুটিয়ে তোলে। এখন আর কেবল নিত্যপ্রয়োজনীয় কিংবা অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্যপণ্যই নয় সংকট দেখা দিয়েছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের বাজারেও।   ‘এলসি খুলতে না পারায় বাজারে ব্লাড ব্যাগের সংকট, হাসপাতালে হাহাকার’ শিরোনামে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস) এ প্রকাশিত একটি সংবাদে (৯ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩) দেখা যায় এই সংকটের কারণে রোগীদের চিকিৎসার চরম সংকট  তৈরি হয়েছে। 

সেই রিপোর্টে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক বলেন, ‘ডাবল ও ট্রিপল ব্যাগের সংকট দেখা দিয়েছে। সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরস ডিপোট থেকে আমাদের ব্লাড ব্যাগ সরবরাহ করা হয়। সেখানে সরবরাহ শেষ হলে আমরা লোকাল মার্কেট থেকে কিনি। বেশ কয়েকদিন ধরেই লোকাল মার্কেটে যোগাযোগ করছি আমরা, কিন্তু কেউ ব্যাগ দিতে পারছে না।’ দেশের ব্লাড ব্যাগের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী জেএমআই গ্রুপের জেএমআই সিরিঞ্জস অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক অভিজিৎ পল টিবিএসকে বলেন, ‘এলসি খুলতে না পারায় যথেষ্ট ব্যাগ আমদানি করা যাচ্ছে না’। অর্থাৎ রক্ত, প্লাজমা, প্লাটিলেট, আরবিসি সব থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ব্যাগের অভাবে হয়তো রক্ষা করা যাবে না রোগীর জীবন। বিষয়টি কতটা মর্মান্তিক সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া বোঝানো মুশকিল। 

 

 

 টিবিএস এ এর চার দিন আগেই, ৫ই ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ‘ঋণপত্র সমস্যায় তীব্র হচ্ছে অস্ত্রোপচার সরঞ্জাম সংকট’ শিরোনামের রিপোর্টে জানা যায় ডলার সংকটের কারণে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এলসি খুলতে না পারায় গত বছরের নভেম্বর থেকে হার্টের ভাল্ব, পেসমেকার, রিং, হার্টের স্টেন্ট ও অক্সিজেনেটরসহ বিভিন্ন ধরনের সার্জিক্যাল ইকুইপমেন্ট আমদানি করতে পারছে না। এতে হার্ট সার্জারি, বাইপাস সার্জারি, নিউরোসার্জারি, কিডনি সার্জারি, অর্থোপেডিক সার্জারির মতো গুরুত্বপূর্ণ সার্জারিগুলো মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এই ধরনের সার্জারি যাদের প্রয়োজন হয় তারা সবাই গুরুতর অসুস্থ। সার্জারির বেশির ভাগই ইমার্জেন্সি এবং জীবন রক্ষাকারী। এই সার্জারি যখন ইকুইপমেন্ট’র অভাবে বন্ধ থাকে তখন বোঝা যায় পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ।  ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের একজন চিকিৎসক নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে বলেন, সব হাসপাতালেই প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্টের ঘাটতি রয়েছে, তাই তারা রোগীদের বাড়িতে ফেরত পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি বলেন, অনেক রোগী আছে যাদের অবিলম্বে ভাল্ব রিপ্লেসমেন্ট প্রয়োজন হয় এবং তাদের অনেকের ভাল্ব দ্রুত প্রতিস্থাপন করা না হলে বেঁচে থাকতে পারে না। কিন্তু ভাল্ব সংকটের কারণে অনেক রোগীর চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে। ভাল্ব, পেসমেকার, রিং, ও অক্সিজেনেটরসহ বিভিন্ন ধরনের ইকুইপমেন্ট আমদানি ও সরবরাহ করে লিডিং ইলেক্ট্রো মেডিকেল।

 কোম্পানিটির একজন পরিচালক টিবিএসকে বলেন, আগে প্রতি মাসে কয়েকটা করে এলসি খোলা হতো। প্রতি বছরে প্রায় ২০ লাখ ডলারের ইকুইপমেন্ট আমদানি করা হতো। কিন্তু গত ৪-৫ মাস ধরে এলসি খোলা পুরোপুরি বন্ধ আছে। ফলে এখন তারা পুরো অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। তিনি বলেন ‘ভেবেছিলাম জানুয়ারি থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হচ্ছে না। প্রতিদিন ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলি, কিন্তু ব্যাংক জানায় ডলার নেই’। দ্য ডেইলি স্টার ২৪শে জানুয়ারি ‘ডলার সংকটের প্রভাব ওষুধ শিল্পে’ শিরোনামের রিপোর্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাতে আমাদের জানায়, স্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারীরা চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে ৪৬৫ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খুলেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ৪১ শতাংশ কম। একইভাবে, ওষুধ উৎপাদন খাতে ব্যবহৃত মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য গত জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে এলসি’র পরিমাণ ৩৫ দশমিক ১৫ শতাংশ কমে ৬৫ দশমিক ১৫ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের ওষুধ প্রস্তুতকারকরা সময়মতো কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন না উল্লেখ করে মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান বলেন, ‘এতে করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে আমদানিকারকরা তাদের কাঁচামাল বন্দর থেকে সময়মতো খালাস করতে পারেন না, কারণ ব্যাংক এলসি নিষ্পত্তি করতে পারে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ মার্জিন দেয়ার পরেও আমরা এলসি খুলতে পারছি না।’ জীবন রক্ষাকারী ওষুধের কাঁচামাল সেইসঙ্গে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করতে না পারায় একদিকে যেমন দেশের মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়ছে তেমনি বিদেশে আমাদের ওষুধ রপ্তানির বাজার হারাচ্ছি আমরা।  রাষ্ট্রের এক চরম সংকটের সময় কথা ছিল নাগরিকরা জানবেন সংকটের ব্যাপ্তি এবং তীব্রতা কতোটুকু, কতোটুকু সময় দীর্ঘ হতে পারে এই সংকট।

 এমন চরম সংকটের সময় কী করা উচিত তার একটা দিকনির্দেশনাও সরকারের কাছ থেকে আসার কথা। একটি অগণতান্ত্রিক সরকারের সময়ের অনেক সংকটের মধ্যে একটি হলো সরকারটির দেয়া তথ্যে আস্থাহীনতা। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারটি যেহেতু তথাকথিত উন্নয়নকে বিনা ম্যান্ডেটে ক্ষমতায় থাকার অস্ত্র বানিয়েছে, তাই তাদের পক্ষে অর্থনীতির চলমান সংকট স্বীকার করা কার্যত অসম্ভব। ফলে সরকার আমাদের সামনে অর্থনীতি নিয়ে নানা তথ্য হাজির করে যেগুলোর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিলই নেই।  সরকার রিজার্ভ নিয়ে যে গল্প করে বিশেষত আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতার যে বড়াই সরকারের মধ্যে আমরা দেখি মাঠের চিত্র কিন্তু সরকারের সেই বয়ানকে সমর্থন করে না। সত্যি যদি সরকারের দাবি মতো রিজার্ভের পরিমাণ ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো হয়ে থাকতো, তাহলে অন্তত জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এবং চিকিৎসাসামগ্রী আমদানিতে সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। এগুলো বিদেশি চকলেট, বিস্কুট কিংবা প্রসাধন সামগ্রীর মতো বিলাসী পণ্য নয়। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা খাদ্যের প্রয়োজনীয়তাকেও ছাড়িয়ে যায়। এসব কিছুই সচেতন নাগরিকদের সামনে আসে অমোঘ সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স হয়ে, তাদের কাছে আর চাপা থাকে না ডলার সংকটের ভয়াবহতা।  

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status