ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

চলতি পথে

এনার্জি জাস্টিস, কোন পথে আমরা!

শুভ কিবরিয়া
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, রবিবার
mzamin

বিশ্ব দ্রুত বদলাচ্ছে। আমাদের চারপাশের চিন্তা জগতেও ঘটছে দ্রুত পরিবর্তন। এক সময় তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কথা হতো বিস্তর। এখন কথা হচ্ছে জ্বালানি নিয়ে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ব জ্বালানিতন্ত্র বা বিশ্ব জ্বালানি রাজনীতিতে যে পরিবর্তন ঘটছে দ্রুতলয়ে, তাতে বহুরকম পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। প্রভাবও পড়ছে বহুকিছুতে। জ্বালানি যে আমাদের জীবন এবং সামষ্টিক অর্থনীতিকে এরকমভাবে পরিবর্তন করতে পারে, তা এই যুদ্ধপর্ব না ঘটলে বোঝা যেতো না।  এসব নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম ঘরোয়া এক আলোচনায়। সেখানেই এলো ডার্টি এনার্জির কথা। এই টার্মটাও নতুন।

বিজ্ঞাপন
আগে বলা হতো ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানি। আমরা যে জ্বালানি ব্যবহার করি, যা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করি প্রধানত সেই জ্বালানি তেল, কয়লা, গ্যাস ব্যবহারের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। প্রধানত এসব জ্বালানি সম্পদের ভাণ্ডার অফুরান না। এগুলো ব্যবহারের পর এক সময় শেষ হয়ে যাবে। এগুলো নবায়ন করা যায় না। এগুলোর পরিবেশের ওপর প্রভাব মারাত্মক নেতিবাচক। এগুলো আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম নিয়ামক। এসব জ্বালানি ব্যবহরের ফলে আমাদের মাটি, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যাপক ক্ষতি হয়। সে কারণেই গোটা পৃথিবী সমবেতভাবে ২০১৫ সালে প্যারিসে বসে চুক্তি করে একমত হয়েছিল, যে ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানি (তেল, গ্যাস, কয়লা) আমরা ব্যবহার করছি তার ব্যবহার কমাতে হবে। কেননা এই জীবাশ্ম জ্বালানি বাতাসে কার্বনের পরিমাণ বাড়ায়। পরিবেশকে দূষণ করে। উষ্ণতা বাড়ায়। জলবায়ু পরিবর্তনকে তরান্বিত করে। 

তাই পৃথিবীকে পরিবেশের বিপন্নতার হাত থেকে বাঁচাতে হলে, জলবায়ুর পরিবর্তনের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে, দ্রুত এই ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার কমাতে হবে। পৃথিবীসমেত সমবেত সিদ্ধান্ত ছিল এই ফসিল ফুয়েল বা অনবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের বদলে ক্রমান্বয়ে আমরা সবাই মিলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা রিনিউয়েবল জ্বালানির দিকে যাত্রা শুরু করবো। এই জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যাত্রাপথকেই আমরা বলছি এনার্জি ট্রানজিশন বা জ্বালানি রূপান্তর।  এই যে জীবাশ্ম জ্বালানি যাকে আমরা পরিত্যাগ করতে চাই বাসযোগ্য পৃথিবী গড়বার তাগিদেই হালে তাকে বলা হচ্ছে ডার্টি এনার্জি। এটা একটা নতুন পরিভাষা। আমাদের চেষ্টা হচ্ছে একটা সফল জ্বালানি রূপান্তর প্রক্রিয়ার যেখানে আমরা ডার্টি এনার্জির বদলে ব্যবহার করবো ক্লিন এনার্জি। যে এনার্জি আসবে বাতাস থেকে, সূর্য থেকে, পানি থেকে। যে এনার্জির ভাণ্ডার কোনোদিন ফুরোবে না। এই এনার্জি ট্রানজিশন বা জ্বালানি রূপান্তরের আলোচনাতেই এসে গেল এনার্জি জাস্টিসের কথা। বলা হচ্ছে এমনভাবে জ্বালানি রূপান্তর হওয়া উচিত যাতে ভোক্তা সুবিচার পায় বা ভোক্তার জ্বালানি জাস্টিস নিশ্চিত হয়। এখন এই জ্বালানি জাস্টিস নিশ্চিত হবার পথটা কী? আলোচনার এ অবস্থাতে আমাদের এক বন্ধু একটা ভালো পরামর্শ দিলেন। তার বক্তব্য হচ্ছে জাস্টিস চাইলে আগে চিহ্নিত করতে হবে ইনজাস্টিস হচ্ছে কোথায়? অর্থাৎ আমরা যদি অবিচারের জায়গাগুলো বুঝতে পারি তবেই সুবিচারের পথ বের করা সহজ হবে। ভোক্তারা আমাদের দেশে কীভাবে বিপন্ন হচ্ছে তার একটা বড় উদাহরণ ঘটে গেছে গত কিছুদিন আগে। 

 

 

কিছুদিন আগেও দেশে গ্যাসের দাম, বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)-এর মাধ্যমে গণশুনানি করেই তা বাড়াতে হতো। সরকার সম্প্রতি সেই ব্যবস্থাকে ঠুঁটোজগন্নাথ বানিয়ে গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কাজটি জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিভাগের হাতে নিয়েছে। নতুন আইন বানিয়ে সরকার এই কাজটা করেছে। ফলে সরকার চাইলে যখন প্রয়োজন নিজের মতো করে গ্যাস, জ্বালানি, বিদ্যুতের দাম বাড়াতে পারবে।  ইতিমধ্যে এই নতুন আইনের প্রয়োগ ঘটিয়ে সরকার চড়াহারে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়িয়েই চলেছে। ভবিষ্যতে আরও দ্রুততর সময়ে দ্রুতগতিতে সেটা বাড়াবার সম্ভবনাও জারি রয়েছে। কেন না এই আইনের (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন- ২০০৩) সংশোধনীতে সরকার লিখেছে, ‘৩৪ক। এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, ভর্তুকি সমন্বয়ের লক্ষ্যে, জনস্বার্থে, কৃষি, শিল্প, সার, ব্যবসা-বাণিজ্য ও গৃহস্থালি কাজের চাহিদা অনুযায়ী এনার্জির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে উহাদের উৎপাদন বৃদ্ধি, সঞ্চালন, পরিবহন ও বিপণনের নিমিত্ত দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধার্থে বিদ্যুৎ উৎপাদন, এনার্জি সঞ্চালন, মজুতকরণ, বিপণন, সরবরাহ, বিতরণ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ট্যারিফ নির্ধারণ, পুনঃনির্ধারণ বা সমন্বয় করিতে পারিবে।’ ইতিমধ্যে এই আইনের সুবিধা কাজে লাগিয়ে গ্যাসের দাম রেকর্ড পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে। 

এখন এই গ্যাস বেচে পেট্রোবাংলা লাভ করতে শুরু করেছে। এখন প্রতি ইউনিট (ঘনমিটার) গ্যাস সরবরাহে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন-পেট্রোবাংলার ব্যয় হয় গড়ে ১৪ টাকা। গত ১৮ই জানুয়ারি ২০২৩ সরকার দাম বাড়িয়ে দেয়, যা ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে। এতে নতুন গড় দাম দাঁড়িয়েছে ২১ টাকা ৬৭ পয়সা। ফলে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ইউনিট গ্যাসে পেট্রোবাংলার লাভ থাকছে প্রায় ৮ টাকা। (প্রথম আলো, ৯ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩) সরকার আরও একটা আইন বহুবছর ধরে ব্যবহার করে চলেছে। যার নাম ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০’-যাকে বলা হয় দায়মুক্তির আইন। এই আইনের আওতায় সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইচ্ছেমতো চুক্তি করতে পারছে বা করছে। দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট (২০২২ সালের ১৬ই এপ্রিল)। ফলে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রকেই অলস বসে থাকতে হচ্ছে। যদিও বসে থাকলেও তারা কেন্দ্রভাড়া (ক্যাপাসিটি পেমেন্ট) পাচ্ছে। বছরে এর পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি।  শুধু তাই নয়, সরকার ভারত ও বাংলাদেশে আলোচিত আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তি করে যে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বানিয়েছে, তাতে খরচও পড়ছে বিপুল। উল্লেখ্য, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডা জেলায়। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার। এটিতে উৎপাদিত পুরো বিদ্যুৎ ২৫ বছর ধরে কিনবে বাংলাদেশ। মার্চ ২০২৩ থেকে আদানির কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হতে পারে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, আদানি গ্রুপ প্রতি টন কয়লার দাম ধরতে চায় ৪০০ ডলার। এই দরে কয়লা আমদানির ঋণপত্র খোলার কথা তারা জানিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)। অথচ বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত রামপাল এবং বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে করা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লার দাম পড়ছে প্রতি টন ২৫০ ডলারের মতো।

 কিন্তু আদানি প্রতি টন কয়লার যে দাম প্রস্তাব করেছে, তা রামপাল ও পায়রার চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি। এর ফলে বাংলাদেশকে অনেকটা বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। (৮ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩, প্রথম আলো) এ নিয়ে আমাদের সংসদে আলোচনাও হয়েছে। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘আমি সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হলাম, যে আদানি গ্রুপ নিয়ে ভারতে এতে সমালোচনা, সেই আদানি গ্রুপ ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে, তাদের থেকে আনা প্রতি ইউনিটের (বিদ্যুৎ) মূল্য ২৪ টাকা ১০ পয়সা। বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ (বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া) দিতে হবে ৬ হাজার কোটি টাকা। আদানি গ্রুপ থেকে এত উচ্চ মূল্য দিয়ে আমরা কেন বিদ্যুৎ আনবো? (৮ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩, প্রথম আলো) ভোক্তার জন্য আমরা চাই সাশ্রয়ী মূল্যে, নিরবচ্ছিন্ন, মানসম্মত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ। বাস্তবে তা সোনার পাথরবাটিতে পরিণত হয়েছে। 

জ্বালানি সেক্টরে আমাদের সক্ষমতা দিন দিন কমছে। পুরো জ্বালানিতন্ত্রে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও লুণ্ঠনমূলক মুনাফা ভোক্তাদের সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি সরবরাহের অন্যতম বাধা। অদক্ষতা-দুর্নীতি-বাণিজ্যমুখীন-বেসরকারিকরণ প্রবণতায় নুয়ে পড়া জ্বালানিতন্ত্র ইন্টারেস্ট অব কনফ্লিক্টের ভারে জর্জরিত।  পুরো জ্বালানি ব্যবস্থাপনাতে আমরা পরনির্ভর, আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ছি। আইন-নীতি ক্রমান্বয়ে ভোক্তার হাত থেকে বাজারের হাতে চলে যাচ্ছে। কাজেই এনার্জি ইনজাস্টিস বা জ্বালানি অবিচার এত প্রকট হয়ে পড়ছে যে জ্বালানি জাস্টিস বা জ্বালানি সুবিচার ক্রমাগত দূরপরাহত হয়ে পড়ছে। এর ফল দু’রকম। প্রথমত আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। জ্বালানি সার্বভৌমত্ব অনিরাপদ হয়ে উঠছে। দ্বিতীয়ত ভোক্তা প্রতারিত হচ্ছে। তার জ্বালানি অধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক [email protected]

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status