ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

বেহুদা প্যাঁচাল

শেষ পর্যন্ত সাত্তার কি সেই পথেই হাঁটবেন?

শামীমুল হক
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বৃহস্পতিবার
mzamin

গতকাল নির্বাচনী কেন্দ্রে যাওয়ার পর এজেন্টদের এক হাজার টাকার পরিবর্তে দেয়া হয় সাতশ’ টাকা। দুপুরের খাবারও দেয়া হয়নি। এ নিয়ে কিছু কিছু জায়গায় ক্ষোভ দেখা দেয়। এ অবস্থায় ওই কেন্দ্রে আসেন জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা। তাকে এজেন্টরা সব খুলে বলেন। এই এজেন্টরাও সব আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। জেলা নেতা ক্ষুব্ধ হয়ে ইউনিয়ন নেতাকে ডেকে গালমন্দ করেন। বলেন, এখানেও আপনাকে ব্যবসা করতে হয়। নির্বাচনী মাঠের চিত্র তো দেশবাসী সারা দিনই দেখেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো- যে সাত্তারের জন্য আওয়ামী লীগ এত কিছু করছে সেই সাত্তার কি শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকবে? নাকি ডা. আলাউদ্দিনের মতো বিশাল ধাক্কা দেবেন? আওয়ামী লীগের বুকে পেরেক ঠুকে দেবেন নাতো?

 

রাজনীতিতে নয়া ইতিহাস তৈরি করলেন উকিল আবদুস সাত্তার।

বিজ্ঞাপন
বিএনপি ছাড়লেন। আবার বিএনপি থেকে বহিষ্কৃৃতও হয়েছেন। কিন্তু দলবদল না করেও চির প্রতিদ্বন্দ্বী দলের আনুগত্য পাওয়া উকিল সাত্তারের জন্য ভাগ্যের বিষয়। এ যাবৎকালে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে মনে পড়ছে না। ধানের শীষ ছেড়ে কলার ছড়ি মার্কা নিয়ে লড়াই। কিন্তু তার নির্বাচনী মাঠে ভোট প্রচারণায় আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা। এ এক আশ্চর্য বিষয়। এর আগে এমন ঘটনা ঘটেছি কি?  তবে দল বদলের ঘটনায় একেবারে বিপরীত আদর্শের রাজনীতিকেও আঁকড়ে ধরার নজির দেশে বহু। এ যাবৎকালের আলোচিত দল বদলের ঘটনা ঘটান রাজশাহীর পোড় খাওয়া আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আলাউদ্দিন। যার শরীরে জন্ম থেকেই আওয়ামী লীগের রক্ত। যার ধ্যান-জ্ঞানে আওয়ামী লীগ। সে সময় তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যও। সেই আলাউদ্দিন ১৯৯৬ সালে  আওয়ামী লীগের টিকিট না পেয়ে বিএনপিতে যোগ দেন। হয়ে যান জাতীয়তাবাদী সৈনিক। উপহার হিসেবে পান বাঘা-চারঘাট মিলে রাজশাহী-৫ আসন থেকে বিএনপি’র টিকিট। আর সে নির্বাচনে জীবনে প্রথমবারের মতো ধানের শীষ প্রতীকই তাকে জয় এনে দেয়। নামের পাশে সংসদ সদস্য শব্দ বসানোর অধিকার পান। বিএনপি’র এমপি হয়ে সংসদে যান। বিএনপি’র পক্ষে সরব সংসদে। কিন্তু সরকারে তখন আওয়ামী লীগ। দুই বছর না পেরুতেই ১৯৯৮ সালে ফের আলাউদ্দিন যোগ দেন আওয়ামী লীগে। আওয়ামী লীগ থেকে উপহারস্বরূপ তাকে দেয়া হয় প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর পদ। কিন্তু আইন অনুযায়ী তার সংসদ সদস্য পদ চলে যায়। ফের উপনির্বাচনে ডা. আলাউদ্দিন আওয়ামী লীগের টিকিটে নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়ী হন। ধানের শীষের এমপি হন নৌকার এমপি। জাতীয় নির্বাচনে তার পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে বিএনপি দলীয় নেতাকর্মীরা। আর উপনির্বাচনে তার পক্ষে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মাঠে নামেন।  একই সময় ঘটে আরেক ঘটনা। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপনও দল বদলান। একসময় জাসদের ডাকসাইটে নেতা স্বপন বিএনপিতে যোগ দিয়ে এমপি হন। পরে তিনিও যোগ দেন আওয়ামী লীগে। উপহার হিসেবে পান শিল্প উপমন্ত্রীর পদ। তার বেলায়ও ঘটে একই ঘটনা। সংসদ সদস্য পদ চলে যায়। তিনিও উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে লড়াই করে জয়ী হয়ে আসেন। আলোচিত এমন বদলের ঘটনা আরও আছে। আওয়ামী লীগের সে ঘটনার প্রতিশোধ নিতে বিএনপিও খেলে আরেক খেলা। ১৯৯৬ সালে আমিন জুয়েলার্সের মালিক কাজী সিরাজ আওয়ামী লীগের টিকিটে ফরিদপুর থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী নির্বাচনের আগে কাজী সিরাজ যোগ দেন বিএনপিতে। বিএনপি’র টিকিটে ধানের শীষ মার্কা নিয়ে নির্বাচনও করেন। পরে অবশ্য তিনিও ফের আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট না পেয়ে সাবেক এমপি নড়াইলের ধীরেন্দ্রনাথ সাহা যোগ দেন বিএনপিতে। লড়াই করেন ধানের শীষ নিয়ে সরাসরি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। সে সময় শেখ হাসিনা তিন আসনে নির্বাচন করে জয়ী হন। নিয়ম অনুযায়ী গোপালগঞ্জের আসনটি রেখে নড়াইলের দু’টি আসন ছেড়ে দেন। উপনির্বাচনেও ধীরেন্দ্রনাথ ধানের শীষ নিয়ে লড়াই করেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী না দেয়ায় তিনি বিএনপি’র হয়ে জয়ী হন। এক সময় আওয়ামী লীগের পক্ষে সংসদে যে ধীরেন্দ্রনাথ সরব ছিলেন, সেই ধীরেন্দ্র নাথ বিএনপি’র পক্ষে সংসদে বক্তব্য রাখেন। খুলনার বিএনপি নেতা কাজী সেকান্দার ডালিম ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে এমপি নির্বাচিত হন। পরে তিনিও বিএনপিতে ফিরে যান। আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীও এক সময় যোগ দেন বিএনপিতে। পরে বিএনপি ছেড়ে নিজেই তরিকুল ফেডারেশন নামে দল গঠন করেন। বর্তমানে ওই দলের এমপি তিনি। আরেক আলোচিত নাম মোস্তফা মহসিন মন্টু। ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য। ছিলেন যুবলীগের চেয়ারম্যান। পরে ড. কামালের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ছেড়ে যোগ দেন গণ ফোরামে। এখন অবশ্য গণ ফোরামের একাংশের নেতা তিনি। এক সময়ের সাড়া জাগানো ছাত্রলীগ নেতা কিশোরগঞ্জের ফজলুর রহমান ১৯৮৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নৌকা প্রতীকে কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে গড়ে তুলেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। এ দলের সেক্রেটারিও ছিলেন। বর্তমানে ফজলুর রহমান বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচন করেন পাবনার ঈশ্বরদী থেকে। পরের নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে বিএনপিতে যোগ দেন। কিন্তু সে নির্বাচনেও তিনি জয়ী হতে পারেননি। 

ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি রহমতউল্লাহ ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন। তিনিও ৯৬ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ওই সালের নির্বাচনের নৌকা প্রতীকে লড়াই করে এমপি নির্বাচিত হন। মৌলভীবাজারের এবাদুর রহমান চৌধুরী জাপার এমপি ছিলেন। পরে বিএনপিতে যোগ দিয়ে এমপি হন। বিএনপি সরকারের প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন তিনি। মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দীন ভোলা থেকে জাপার এমপি ছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই করে জয়ী হন। পরে বিএনপিতে যোগ দেন। মন্ত্রীও হন। দল বদলের এসব ঘটনার তালিকা দীর্ঘ। রাজনীতিতে দলবদল ইতিহাসের জন্ম দিলেও এ ঘটনা স্বাভাবিক বলেই মনে করেন রাজনীতিকরা। 

কিন্তু অস্বাভাবিক যা তা হলো উকিল আবদুস সাত্তারের এ ঘটনা। তিনি অভিযোগ করেছেন, বিএনপি তাকে মূল্যায়ন করেনি। তার কথার কোনো মূল্য ছিল না দলে। তার এ অভিযোগ সত্য না মিথ্যা এটা তিনি এবং বিএনপি শীর্ষ নেতৃত্ব জানেন। কিন্তু সাদা চোখে যা দেখা গেছে তা হলো- তিনি দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপি’র সভাপতি। বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য ছিলেন চারবার। ২০০১ সালে জোটের কারণে তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। কিন্তু নির্বাচনে চারদলীয় জোট জয়ী হলে বিএনপি উকিল সাত্তারের সেক্রিফাইসকে মূল্যায়ন করে তাকে মন্ত্রী বানিয়ে। ওই সময় প্রথমে ভূমি তারপর আইন ও সবশেষ মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। পুরো পাঁচ বছর তিনি ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। ফ্ল্যাগ উড়িয়ে এলাকায় গেছেন। দাপটের সঙ্গে দলও চালিয়েছেন। সাদা চোখের এ দেখায় তাকে দল অবমূল্যায়ন করেছে বলে মনে হয় কি? সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনেও বিএনপি তাকে মূল্যায়ন করেছে তার হাতে ধানের শীষ তুলে দিয়ে। সে যাক গে, এটি উকিল সাত্তার ও বিএনপি’র বিষয়। সে বিষয়ে তারাই ভালো জানেন। এখন প্রশ্ন হলো- আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ডা. আলাউদ্দিন বিএনপিতে যোগ দিয়ে ধানের শীষের এমপি হলেও তার মন পড়েছিল আওয়ামী লীগেই। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে ওই সংসদেই। তিনি ফ্লোর ক্রসিং করেন। আওয়ামী লীগে যোগ দেন। সংসদ সদস্য পদ হারান। সেই সংসদেই আবার ফিরে আসেন নৌকার প্রার্থী হয়ে। মন্ত্রীও হন। উকিল সাত্তারের গতকালের উপনির্বাচন ঘিরে ক’দিন ধরেই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা উচ্ছ্বসিত। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আহমদ হোসেন ক’দিন আগে সরাইল গিয়ে বলে এসেছেন পহেলা ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে উকিল সাত্তারই জয়ী হবেন। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে ইউনিয়ন, উপজেলা এমনকি জেলার নেতারাও আটঘাট বেঁধে নামেন উকিল সাত্তারের পক্ষে। তারাই সাত্তারের কলার ছড়ি মার্কার প্রচারণা চালান। কেন্দ্রের দায়িত্ব, ভোটার উপিস্থিতির দায়িত্বও তাদের দেয়া হয়। ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতারা সব ভাগ করে নেন। নির্বাচনী মাঠেও তার প্রমাণ মিলেছে। এজেন্টদের টাকা দেওয়া ও খাওয়ার ভার ছিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতিদের হাতে। উকিল সাত্তার সেই টাকা আগেই পৌঁছে দেন দায়িত্বপ্রাপ্তদের হাতে। গতকাল নির্বাচনী কেন্দ্রে যাওয়ার পর এজেন্টদের এক হাজার টাকার পরিবর্তে দেয়া হয় সাতশ’ টাকা। দুপুরের খাবারও দেয়া হয়নি। এ নিয়ে কিছু কিছু জায়গায় ক্ষোভ দেখা দেয়। এ অবস্থায় ওই কেন্দ্রে আসেন জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা। তাকে এজেন্টরা সব খুলে বলেন। এই এজেন্টরাও সব আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। জেলা নেতা ক্ষুব্ধ হয়ে ইউনিয়ন নেতাকে ডেকে গালমন্দ করেন। বলেন, এখানেও আপনাকে ব্যবসা করতে হয়। নির্বাচনী মাঠের চিত্র তো দেশবাসী সারা দিনই দেখেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো- যে সাত্তারের জন্য আওয়ামী লীগ এত কিছু করছে সেই সাত্তার কি শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকবে? নাকি ডা. আলাউদ্দিনের মতো বিশাল ধাক্কা দেবেন? আওয়ামী লীগের বুকে পেরেক ঠুকে দেবেন নাতো?

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status