নির্বাচিত কলাম
চলতি পথে
ঘৃণার বাজারে ভালোবাসার দোকান
শুভ কিবরিয়া
১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বুধবার
সম্প্রতি ভারতের চলমান ধর্মবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে দেশজোড়া এক আন্দোলনের সূচনা করেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। বিভেদের বদলে ঐক্য-এই মন্ত্রে তিনি ‘ভারত জোড়ো’ আন্দোলনে গোটা ভারত পরিভ্রমণ শুরু করেছেন। পথে পথে হাঁটছেন আর মানুষকে বলছেন আসুন ঘৃণার বদলে ভালোবাসা জাগ্রত করি। এই আন্দোলনকে তিনি বলছেন, ঘৃণার বাজারে ভালোবাসার দোকান। গোটা ভারতজুড়ে শাসকশ্রেণি তার ভাষায় বিভেদের ধর্মীয়করণ রাজনীতি দিয়ে যে ঘৃণার বিকিকিনির সংস্কৃতি পয়দা করেছে, সেখানে মিলনের রাজনীতি দিয়ে তিনি ছোট করে হলেও ভালোবাসার দোকান খুলতে চাইছেন।
বছর দশেক আগেও মানুষের সঙ্গে মিশে যে আনন্দ ছিল, এখন তা মেলে না। মাঝে মাঝে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। যারা দুনিয়াবি ধন-সম্পদের ধ্যানেই জীবন কাটান তাদের কথা আলাদা। বৈধ পথে, নিয়ম মেনে স্বল্প সময়ে বিপুল ধন সম্পদ অর্জন যেহেতু স্বাভাবিক ব্যাকরণ বা প্রকরণে পড়ে না, তাই যারা এ বিষয়ে অল্প সময়েই বড় অর্জন চান তারা নানা বাঁকা পথ বেছে নেন। সেটা তারা জেনেশুনেই করেন। তারা ভেবেই নেন, এটাই তরিকা। তাই আলাপে আড্ডায়, ভাবে-ভাষায়, টাকা পাচারে, ঘুষের টাকা আয়ে তারা যখন গর্ব করেন, দুর্নীতির ক্ষমতাকে চিরন্তন ক্ষমতা বলে দাবি করেন, তখন সেটা বিপন্ন করে না। বরং ভালোই লাগে অর্জন ও গর্জনের মধ্যে মিল দেখে। তাদের ভাবনা ও কর্মের মধ্যে সাযুজ্য দেখে, তাদের ভণিতাহীনতা দেখে খুব একটা অস্থির বোধ হয় না। একজন নতুন পয়সাওয়ালা, যার মূল কাজ বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক পাঠানোর নামে মানুষ ঠকানো ও ঠেকানো, তিনি একদিন গৌরবের সঙ্গে জানালেন যা কামাই করেছেন তাতে তিনপুরুষ, কাঁচা টাকা কামড়ে খেলেও শেষ করতে পারবে না।
ভদ্রলোকের কড়কড়ে পোশাক, মচমচে জুতোর আওয়াজের সঙ্গে তার এই অভব্য আওয়াজেও দেখি মিল অনেক। লুকোতে চান না যে লোক ঠকানো শক্তিমান মানুষ তিনি। কিন্তু বিপত্তি ঠেকে তখনই যখন দেখি বহুকালের চেনা মানুষ, যিনি পয়সা দিয়ে চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন কিনে পেশাজীবন শুরু করেছেন। অফিসের এটা-সেটা চুরির মধ্যদিয়ে চাকরির প্রথমদিন থেকেই উপরি আয় শুরু যার। দৃশ্যমান ব্যয়, দৃশ্যমান আয়ের সঙ্গে তার ন্যূনতম সঙ্গতি নেই। অথচ সেই তিনিই এখন নিত্য হাদীস আওড়াচ্ছেন, ধর্ম কথা শোনাচ্ছেন, নীতিকথার ফুলঝুড়ি ওড়াচ্ছেন সর্বত্রই। এই ভণিতাওয়ালা মানুষদের সংখ্যাই হয়তো এখন বেশি। কিন্তু সত্যি সত্যিই বিষন্ন লাগে যখন দেখি সাহিত্য-সংস্কৃতির উচ্চতর চর্চা করা মানুষরাও, আচরণে তাদের চেয়ে ভিন্ন কিছু নন। অন্যের সুখ তাদের অসুখ বাড়িয়েছে। নিজের প্রাধিকার ছাড়া অন্যের সবকিছুই তাদের কাছে গৌণ। মুখে হয়তো আওড়াচ্ছে ক্ষিতি মোহন সেনের সাধন কথা, কিন্তু বাস্তবে চলছে সম্পূর্ণ উল্টোপথে। একটা বৈষয়িক অর্জনের জন্য নীতি-নৈতিকতা ভেঙে যেকোনো পথে চলতেই মরিয়া। শুধু তাই নয় বিপরীত মতের মানুষকে মোকাবিলা করতে এমন কোনো হীন কৌশল নেই যার আশ্রয় তিনি নিচ্ছেন না। এই যে মানবিক অবনমন, তার কারণ কি? এটার কারণ সম্ভবত আমাদের উচ্চতাহীন, নিম্নগামী রাজনৈতিক সংস্কৃতি। রাজনীতি এখানে আদর্শের পথে যতটা না হেঁটেছে তার চেয়ে অনেক বেশি হেঁটেছে যেকোনো উপায়ে বৈষয়িক লক্ষ্য অর্জনের পথেই।

ফলে নৈতিকতা আমাদের রাজনীতির মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে নাই। উল্টো বিবাদ-বিভেদ আমাদের রাজনীতিতে শক্তিমান বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এখনকার রাজনীতিতে প্রতিহিংসা লুকানো কোনো বিষয় নয়। একে অপরকে নির্মূল করার, নিশ্চিহ্ন করার ঘোষণা রাজনীতিতে প্রকাশ্য ও সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত ভাবনা। আমাদের রাজনীতির ইতিহাস শুধু রক্তাক্তই নয় শাস্তি বরণেরও। প্রবল প্রতাবাম্বিত শাসকগোষ্ঠীর দুর্দিনকালের যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতাও এখানে নতুন নয়। তারপরও আমাদের রাজনীতি ইতিহাস ও অতীত থেকে কখনই শিক্ষা নিতে আগ্রহী হয় নাই। তারা ক্ষমতাকালীন উদ্যাপনকেই চিরকালীন ভেবেছে। ফলে, অতীতের অভিজ্ঞতা এখানে হালে পানি পায় নাই। বর্তমানের কোনো কাজ যে ভবিষ্যতকে বিপদাপন্ন করতে পারে এই ভাবনাকে আমলে নেয় নাই এখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি। শুধু সহিংসতার ধারা নয়, দালালি-আপসকামিতা-পদলেহনের নির্লজ্জ ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতিও এখানে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে ভীষণভাবেই। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রশ্নহীন অনুসরণেই পুষ্ট হয়েছে এখানকার বৃহত্তর আমলাতন্ত্র। আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলও রাজনীতির এই বিকাশমান ধারার সঙ্গেই থেকেছে গভীরভাবে।
তাই, সংস্কৃতি এখানে রাজনীতিকে পথ দেখানোর বদলে, রাজনীতির পথেই পা ফেলেছে আনন্দে, নির্ভয়ে এবং সুবিধাবাদের সাক্ষাতে। আমাদের সংস্কৃতিতে, আমলাতন্ত্রে, জনসংস্কৃতির মধ্যে, জনআচরণে প্রতিদিন আমরা যে বিপুলতর নিম্নগামীতা, অকল্যাণময়তা, রুচিহীনতা, ঘৃণার দেখা পাই তার জন্ম হয়েছে এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির গর্ভেই। তাই রাজনীতিতে পালাবদল ঘটলেও, দলবদল ঘটলেও, বাস্তব কল্যাণের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এই রোগ এখন শুধু আমাদের একার রোগ নয়। চারপাশের বহু রাষ্ট্র এই রোগে আক্রান্ত। বিশেষ করে আমাদের উপমহাদেশের রাজনীতি বড়ভাবে এই রোগে কাবু। উপমহাদেশের নোবেল বিজয়ী দুই অর্থনীতিবিদ গোটা বিশ্বে এবং প্রতিবেশী দেশে দারুণভাবে সমাদৃত হলেও নিজ নিজ দেশে শাসকশ্রেণির চক্ষুশূল হয়ে পড়েছেন। রাষ্ট্র তাদের নানারকম পীড়নে অস্থির করে রেখেছে। কেন না রাষ্ট্র চায় সবাই তাদের সহগামীই হবেন। কোনো ভিন্নমত, ভিন্ন চিন্তাকে রাষ্ট্র আর স্পেস দিয়ে স্বস্তি পাচ্ছে না। ভারতে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন শাসক বিজেপির সমালোচনা করেন বলে এখন তার বসতবাড়ি নিয়েই টানাটানি শুরু হয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে। অমর্ত্য সেন ভাবেন, বলেন, লেখেন যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার প্রগতিশীল বহুত্ববাদী ভারতের আদি চরিত্রকে বিনষ্ট করছেন। বিজেপি ভারতকে হিন্দু ভারতের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করছেন তিনি। ব্যক্তি অমর্ত্য সেনের এই চিন্তাকেও নিরাপদ ভাবতে পারছে না সে দেশের শাসককুল।
তাই ব্যক্তি অমর্ত্যকে প্রবল শক্তিমান রাষ্ট্রের নানাবিধ চাপ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। কিন্তু এই অন্ধকারই কী শেষ কথা? আমাদের চারপাশের এই রাজনীতি, সংস্কৃতিতে জনকল্যাণের ইতিবাচক ধারার কী পুনর্জাগরণ ঘটবে না? মানুষ কী তাহলে অন্ধকারেই সমর্পিত হতে থাকবে? ঘৃণার, সহিংসতার, প্রতিশোধের রাজনীতি কী তাহলে জয়যুক্ত হতেই থাকবে? মানুষের হৃদয়ের শুভবোধ কী তাহলে জাগ্রত হবে না? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আমাদের অতীতের কাছেই যেতে হবে। খণ্ডিত সময়কালে হয়তো এর উত্তর মিলবে না। মহাকালের বিবেচনায় যেতে হবে। কেন না মহাকালের সীমানার ব্যাপ্তি নিয়ে ভাবা অতীত বলে, অন্ধকার কখনো চিরস্থায়ী হতে পারে না। সভ্যতার বিজয়রথ চিরকালই অন্ধকার কেটেই আলোর পথেই হেঁটেছে। মানুষ কখনো অন্ধকারকে নিজের বলে ভাবতে পারে না। কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ অন্ধকারকে পরাজিত করতে আলোর নিশানা হাতে দাঁড়াবেই। সম্প্রতি ভারতের চলমান ধর্মবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে দেশজোড়া এক আন্দোলনের সূচনা করেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। বিভেদের বদলে ঐক্য-এই মন্ত্রে তিনি ‘ভারত জোড়ো’ আন্দোলনে গোটা ভারত পরিভ্রমণ শুরু করেছেন। পথে পথে হাঁটছেন আর মানুষকে বলছেন আসুন ঘৃণার বদলে ভালোবাসা জাগ্রত করি। এই আন্দোলনকে তিনি বলছেন, ঘৃণার বাজারে ভালোবাসার দোকান।
গোটা ভারতজুড়ে শাসকশ্রেণি তার ভাষায় বিভেদের ধর্মীয়করণ রাজনীতি দিয়ে যে ঘৃণার বিকিকিনির সংস্কৃতি পয়দা করেছে, সেখানে মিলনের রাজনীতি দিয়ে তিনি ছোট করে হলেও ভালোবাসার দোকান খুলতে চাইছেন। রাজনীতির শক্তিমত্তায় এই আহ্বান কতোটা হালে পানি পাবে সেটা বলা মুশকিল। কিন্তু দার্শনিক বিবেচনায় এই আহ্বানের একটা বহুমাত্রিক বিশেষ গুরুত্ব আছে। সেটা হয়তো ভারতের সীমানা পেরিয়ে বহুদূরের মানুষকেও উজ্জীবিত করতে পারে। প্রেরণা দিতে পারে। পুনশ্চঃ কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সন্তান হরিনাথ মজুমদার ওরফে কাঙ্গাল হরিনাথকে (১৮৩৩-১৮৯৬) নিয়ে সম্প্রতি নতুন করে ভাবনা শুরু করেছেন ভারতের বিদ্ব্যৎসমাজের একাংশ। তারা বলতে চাইছেন কাঙ্গাল হরিনাথ ১৮৬৩ সালে ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকা প্রকাশের মধ্যদিয়ে সাংবাদিকতায় জনকল্যাণের ধারার প্রবর্তকই শুধু নন তিনি সামগ্রিক বিচারে বাংলা নবজাগরণের একজন কৃতী যুগবাহকও বটে। সাংবাদিক, সমাজ সংস্কারক, ভাবজগতের বাউল ঘরানার সৃষ্টিশীল মানুষ কাঙ্গাল হরিনাথ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সত্য লড়াইয়ের একজন প্রেরণাদায়ী পুরুষ বটে। যদিও তিনি জনসমক্ষে অনেকটাই অনালোচিত, অনাদৃত ও অনাবিষ্কৃত।
লেখাটি শেষ করতে চাই কাঙ্গাল হরিনাথের দলের একটি গান দিয়ে, যা হয়তো আজকের দিনে খুব প্রাষঙ্গিক-
“ভাব মন দিবানিশি, অশিবনাশি,
সত্যপথের সেই ভাবনা।
যে পথে চোর-ডাকাতে কোনোমতে,
ছোঁবে না রে সোনাদানা।
সেইপথে মনোসাধে চলরে, পাগল,
ছাড়, ছাড় রে ছলনা।
সংসারের বাঁকাপথে দিনে রাতে,
চোর-ডাকাতে দেয় যাতনা;
আবার রে ছয়টি চোরে ঘুরে ফিরে
লয়রে কেড়ে সব সাধনা।
ফিকির চাঁদ ফকির তাই কয়,
কি কর ভাই, মিছামিছি করি ভাবনা-
চল যাই সত্য পথে, কোন মতে,-
এ যাতনা আর রবে না।”
লেখক: সাংবাদিক। [email protected]