ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সময় অসময়

ডলার সংকট এবং কিছু জটিল ভাবনার সহজ সমাধান

রেজানুর রহমান
৩১ জানুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার
mzamin

আলোচনার ডালপালা বাড়তেই থাকলো। আমি চুপচাপ বসে আছি বেঞ্চের কোনায়। চা খাচ্ছি আর সবার কথা শুনছি। মনে হলো, দেশের সাধারণ মানুষ অতীতের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন। আর তাই দেশের ডলার সংকটও তাদের মধ্যে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা জানে কোথায় কি করলে আমরা ডলারের সাশ্রয় করতে পারবো। কিন্তু তাদের পক্ষে কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করা মোটেই সম্ভব নয়। যারা কার্যকর ভূমিকা নিতে পারবেন তারা সবকিছু জানার পরও অনেকটা নিশ্চুপ। অনেকটা উদাসীন। সিগারেটের কথাই ধরি।

বিজ্ঞাপন
সিগারেট একটি বিলাসী পণ্য। সময়টা যেহেতু বিলাসী পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সন্তোষজনক নয় কাজেই আমাদের তো এ ব্যাপারে একটু সচেতন হওয়া দরকার। সিগারেট নেশাজাতীয় দ্রব্য। একটা কথা ব্যাপক প্রচলিত। নেশা খাবি খা মারা যাবি যা। এটা জানার পরও যারা নেশা করেন তারা করতেই পারেন


ব্যবসায় দুর্নীতিই বড় বাধা। পত্রিকায় এই শিরোনাম দেখে চায়ের দোকানের সামনে বসা একজন বয়স্ক লোক বললেন, এই কথা আবার পত্রিকায় ছাপাইতে হয়? এইটা তো হগগলতেই জানে। এই দেশে যে যত বড় মিথ্যুক, যে ততবড় দুর্নীতিবাজ, সে ততবড় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। চায়ের দোকানটিকে ঘিরে প্রায় সারা দিনই নানা পেশার মানুষের আনাগোনা চলে। একটু দূরে বাস স্টপেজ। বাসে ওঠার জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রীদের অনেকে সময় কাটানোর জন্য এই দোকানটাকেই বেছে নেয়। চা-বিস্কুট খায়। অন্যের কথা শোনে। কখনও কখনও অনেকে বক্তার ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হন। যে লোকটি এতক্ষণ দুর্নীতি নিয়ে কথা বলছিলেন বোঝা গেল বাসে ওঠার ক্ষেত্রে তার কোনো তাড়না নেই। ধারে কাছে কোথাও থাকেন হয়তো। অবসর সময় কাটাতে এসেছেন। চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছেন। তার কথা শেষ হতে না হতেই পাশেই বসা একজন তরুণ বললো- ঠিকই বলছেন মুরুব্বি। এই দেশে যারা বেশি দুর্নীতি করে তারাই দূর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে। ওই যে কথায় বলে না- চোরের মায়ের বড় গলা। এই যে দ্যাশে ডলার নিয়া এত ঝামেলা চলতাছে কেউ তো কারও কথা শোনে না। ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অথচ এই সিগারেটও বিদেশ থাইক্যা আনতে হয়। বাংলাদেশে প্রত্যেক মৌসুমে নতুন নতুন ফল পাওয়া যায়। অথচ আমরা অনেকে দেশীয় ফল খাই না। বিদেশি ফল ছাড়া অনেকের চলে না। শুধু কি বিদেশি ফল? মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রেও আমরা বিদেশের প্রতি নির্ভরশীল। অথচ দেশেই উন্নতমানের মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। এত বিদেশপ্রীতি ক্যানরে ভাই? আসেন না কিছুদিন দেশেরটাই কিনি। আবার যখন সময় বদলাইবে তখন না হয় বিদেশেরটা কিনবো।  তরুণের কথা অন্য সবাই গ্রোগ্রাসে গিলছে। তার কথা পছন্দ হয়েছে অন্য সবার। 

আরও কয়েকজন বক্তার ভূমিকা নেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু করে দিলো। একজন বললো- দেশি পণ্য কিনে হও ধন্য। সরকারের এই নির্দেশ মানলেই তো সব কিছুরই সমাধা করা সম্ভব। অন্য আরেকজন বললো, সাধারণ মানুষ ঠিকই সরকারের এই নির্দেশ মানে। তারা দেশি পণ্যই কিনে। অসাধারণ মানুষ মানে বড় লোকেরা অনেকে সরকারের কোনো নিয়ম কানুনই মানে না। অনেকে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পানি ছাড়া দেশের পানি খায় না। সকালের নাস্তা করতেও নাকি অনেকে বিদেশে যায়। বিদেশ যাওয়া মানেই ডলার খরচ... আলোচনার ডালপালা বাড়তেই থাকলো। আমি চুপচাপ বসে আছি বেঞ্চের কোনায়। চা খাচ্ছি আর সবার কথা শুনছি। মনে হলো, দেশের সাধারণ মানুষ অতীতের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন। আর তাই দেশের ডলার সংকটও তাদের মধ্যে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা জানে কোথায় কি করলে আমরা ডলারের সাশ্রয় করতে পারবো। কিন্তু তাদের পক্ষে কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করা মোটেই সম্ভব নয়। যারা কার্যকর ভূমিকা নিতে পারবেন তারা সবকিছু জানার পরও অনেকটা নিশ্চুপ। অনেকটা উদাসীন। সিগারেটের কথাই ধরি। সিগারেট একটি বিলাসী পণ্য। সময়টা যেহেতু বিলাসী পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সন্তোষজনক নয় কাজেই আমাদের তো এ ব্যাপারে একটু সচেতন হওয়া দরকার। সিগারেট নেশাজাতীয় দ্রব্য। 

 

 

একটা কথা ব্যাপক প্রচলিত। নেশা খাবি খা মারা যাবি যা। এটা জানার পরও যারা নেশা করেন তারা করতেই পারেন। তাই বলে তারা দেশের ডলার খরচ করবেন? বাংলাদেশে মৌসুমি ফলের আধিক্য বেশ অহঙ্কারের। প্রতি  মৌসুমে বাংলাদেশে নতুন নতুন ফলের আধিক্য দেখা যায়। তবুও দেশের একশ্রেণির মানুষ বিদেশি ফলের প্রতি ঝুঁকে থাকেন। বিশেষ করে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা দেশীয় ফলকে সেভাবে গুরুত্ব দেন না। ফলে এক শ্রেণির ফল ব্যবসায়ী বিদেশি ফল আমদানি করতে গিয়ে ডলার পাঠাচ্ছেন বিদেশে। দেশে ডলার সংকটের এই সময়ে সবার উচিত শুধু বিদেশি ফল নয়, বিদেশি পণ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটু সচেতন থাকা। অনেক বিদেশি পণ্যের বিকল্প দেশেই পাওয়া যায়। কাজেই এই সংকটকালে দেশীয় পণ্যকেই গুরুত্ব দিতে আমরা কেন কার্পণ্য করছি।  মোবাইল ফোন এখন আর বিলাসিতা নয়। অতি জরুরি ব্যবহার্য্য দ্রব্য। দেশেই একাধিক প্রতিষ্ঠান উন্নতমানের মোবাইল ফোন তৈরি করছে। তবুও আমরা অনেকেই ডলার খরচ করে বিদেশ থেকে দামি মোবাইল ফোন কিনছি। অথচ সময় বিবেচনায় আমাদের উচিত এক্ষেত্রে একটু সচেতন থাকা। ডলার যেন বিদেশে না যায় সে ব্যাপারে আন্তরিক হওয়া সময়ের দাবি।  

চলছে বিয়ের মৌসুম। দেশের মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সব পরিবারেই একটু বিয়ের জিনিসপত্র অর্থাৎ পোশাক, গয়না, স্বর্ণালঙ্কার সবই বিদেশ থেকে কেনার প্রতিযোগিতা করেন অনেকে। বিশেষ করে পাশের দেশ ভারতের কলকাতার দিকেই অনেকে ছোটেন। ভারতীয় দূতাবাসের ভিসা সেন্টারে গেলেই যে চিত্রটা চোখে পড়বে তা বেশ উদ্বেগজনক। ভিসা প্রত্যাশী শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষ হয় চিকিৎসার জন্য না হয় ভ্রমণের নামে কেনাকাটার জন্য ভারতের ভিসা নিচ্ছেন। বিদেশ গেলেই ডলার লাগে। সংকটের এই সময়ে আমরা কি বিয়ের কেনাকাটা দেশেই সারতে পারি না? একটা দুইটা বছর না হয় দেশেই কেনাকাটা করি। পরিস্থিতি নিশ্চয়ই একদিন পাল্টাবে। তখন না হয় আবার বিদেশে কেনাকাটা করতে যাবো। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও প্রতিদিন অসংখ্য ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে। অথচ দেশে অনেক আধুনিক মানের চিকিৎসাকেন্দ্র আছে, হাসপাতাল আছে। তবুও আমরা সামর্থ্যবানরা চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিদেশকেই বেশি প্রাধান্য দেই। কেন দেই? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখেছি বিদেশে অর্থাৎ কলকাতায়ও চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে একটা বিশ্বাস জন্মেছে- ওই দেশের চিকিৎসকরা রোগীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন।

 আর আমাদের দেশে তার উল্টো। এই অভিযোগ যদি সত্য হয় তাহলে তো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। দেশে উন্নতমানের চিকিৎসাকেন্দ্র, দক্ষ চিকিৎসক থাকতে কেন দেশের মানুষ চিকিৎসা নিতে বিদেশে যাবে? একজন রোগীর সঙ্গে পরিবারের আরও ৪/৫ জন সদস্য বিদেশে যান। তাদের যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া, কেনাকাটা সব মিলিয়ে বিদেশে যে অর্থ খরচ করে তার সবটাই ডলারে দিতে হয়। অথচ দেশেই যদি সুচিকিৎসার ব্যাপারে আস্থা তৈরি করা যেত তাহলে কিছু না কিছু ডলার সাশ্রয় হতো।  কথায় আছে বিন্দু বিন্দু জল জমেই একদিন মহাসমুদ্র তৈরি হয়। শুধু সিগারেট, মোবাইল ফোন, ফল আমদানি ও বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বদলালেই যে ডলার সংকট কেটে যাবে তা কিন্তু নয়। কিন্তু শুরুটা তো করতে হবে? মোদ্দাকথা, দেশে যা পাওয়া যায় তা কেন বিদেশ থেকে আমদানি করবো? আমদানি করা মানেই ডলার জরুরি। এই সংকট কালে যার যার অবস্থান থেকে আমরা যদি নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করি, আমাদের যার যা আছে তাই দিয়ে যদি প্রয়োজন মেটাই তাহলে সংকট মোকাবিলা করা সহজ হবে।  এখন প্রশ্ন হলো- আমরা কি সংকট মোকাবিলায় আন্তরিক?     

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।  

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status