ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

খোলা চোখে

কেমন যাবে আসছে রমজান?

রুমিন ফারহানা
৩০ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার
mzamin

পরিস্থিতির উন্নতি দূরে থাক, নতুন এলসি খোলা, পুরনো এলসি’র নিষ্পত্তি কোনো ক্ষেত্রেই ন্যূনতম কোনো পরিবর্তন আসেনি। অনেক ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেছে। অবশেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংককে সাফ জানিয়ে দিয়েছে বিদ্যমান ডলার সংকট এবং এলসি খোলায় অন্যান্য সমস্যার সুরাহা করা না হলে আসন্ন রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখা অসম্ভব হবে। রমজানের মধ্যেই পণ্যমূল্যের পরিস্থিতি ঠিক কোন জায়গায় যাবে সেটা এবার একটু বোঝা যাক। এমনিতেই সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও রমজান মাসকে সামনে রেখে সরকারের আনুকূল্যপ্রাপ্ত বড় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেন অনেকটা


গত কয়েক মাস ধরেই দেশে অর্থনৈতিক সংকটের আলোচনা, পর্যালোচনা, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সর্বত্র। পত্রিকার পাতা থেকে নিয়ে টকশোর টেবিল সবখানেই মোটামুটি একই আলোচনা। মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ সংকট, ডলার সংকটে আমদানি বিল পরিশোধ করতে না পারা, এলসি খোলায় ব্যাংকের অনাগ্রহ, অপারগতা সেই সঙ্গে হাজার কোটি টাকা মন্দ ঋণ আর টাকা পাচার; সব মিলিয়ে একটা বিষয় স্পষ্ট; অর্থনীতি ভালো নেই। কাগজে লেখা সংখ্যা, পরিসংখ্যানের কথা যদি সরিয়েও রাখি তারপরও অর্থনীতির দৈন্য দশার আলামত চারদিকেই স্পষ্ট।   অর্থনীতি যে ভালো নেই তার আরও একটি আলামত হলো তীব্র শীতে, এমন কি শৈত্যপ্রবাহের মধ্যেও লোডশেডিং। বলা হচ্ছে- বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানির অবস্থায় নেই ব্যাংকগুলো।

বিজ্ঞাপন
কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাবার মাত্র ২৭ দিনের মাথায় বন্ধ হয়ে গেছে। মূল কারণ কয়লার সংকট। একইভাবে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রও বন্ধ হওয়ার পথে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য চারটি জাহাজে কয়লা এলেও ডলার সংকটে ভাড়া পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এতে আটকে গেছে কয়লা খালাস। এদিকে জাহাজ বসিয়ে রেখে প্রতিদিন ডেমারেজ দিতে হচ্ছে ৬০ হাজার ডলার। এমনকি ডলার সংকটে বন্ধের ঝুঁকিতে পড়েছে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানিও। ফলে ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় পৌঁছলেও তীব্র শীতে মাত্র ৯ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। 

  ডলার সংকটে চাহিদা অনুযায়ী কয়লা, গ্যাস ও ফার্নেস অয়েল না পেয়ে বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর মধ্যে একদিনের উদাহরণ বিষয়টি স্পষ্ট করবে। ১৬ই জানুয়ারি আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ ছিল ৬৬টি কেন্দ্র, যার ২১টি গ্যাসচালিত ও ৪৫টি ফার্নেস অয়েলচালিত। এ ছাড়াও কয়লা সংকটে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও বন্ধ ছিল। ফলে ঐ দিন মাঘ মাসের ঠাণ্ডাতেও লোডশেডিং হয়। সেদিন সন্ধ্যা ৭টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৯৯৯৭ মেগাওয়াট আর উৎপাদন হয় ৮৯০২ মেগাওয়াট। এতে উৎপাদন পর্যায়েই লোডশেডিং করা হয় ১ হাজার ৯৫ মেগাওয়াট। বলে রাখি এর একদিনের মাথায় ১৭ই জানুয়ারি বন্ধ ছিল ৭২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র, এবং লোডশেডিং করা হয় ১২৫৫ মেগাওয়াট। মাঘের শীতে যদি ১০০০ থেকে ১৩০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয় তাহলে বলাইবাহুল্য মার্চ, এপ্রিলের গরমে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?    দুর্ভোগ এখানেই শেষ নয়। বিদ্যুৎ দিতে পারুক আর নাই পারুক, সরকার এরই মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে ৫ শতাংশ। কয়েক বছর আগেও যেখানে ৪ সদস্যের মধ্যবিত্ত একটা পরিবারে মাসে বিদ্যুৎ বিল দিতে হতো ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা, তাদেরই এখন বিল আসে ৮০০০ থেকে ৯০০০ টাকা। উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি আমদানি, হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ সবই গেছে ভোক্তার ঘাড়ে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত বিইআরসি’র একটা লোক দেখানো শুনানি থাকলেও নতুন আইন করে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানোর ব্যবস্থা করেছে সরকার। 

 

 

এই দফায় মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে সরকারের নির্বাহী আদেশে। দাম বৃদ্ধির পরও যদি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যেত তাহলেও একটা কথা ছিল। দাম বেড়েছে ঠিকই কিন্তু সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোডশেডিংও।   বিদ্যুতের পরপরই বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে, বৃহৎ শিল্প খাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে প্রায় তিন গুণ বেড়ে ৩০ টাকা হয়েছে। মাঝারি শিল্প খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতে ১০ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের (ক্যাপটিভ) জন্য ইউনিট প্রতি গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। সরকারি, আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে ৫ টাকা ২ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪ টাকা। হোটেল ও রেস্তরাঁর মতো বাণিজ্যিক খাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম আগে ছিল ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩০ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যই কেবল নয়, লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবার দামও। শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনই নয় অস্থির নিত্যপণ্যের বাজারও। বিবিসি বাংলার এক সাক্ষাৎকারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা বলছিল পণ্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যাংকে জমা রাখার শর্তে শতভাগ মার্জিনেও এলসি খুলতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এমনকি কয়েক মাস আগের খোলা এলসিতেও ডলারে বিল পরিশোধ করতে না পারায় আটকে গেছে পণ্য খালাস।  

   আর দু’মাস বাদেই রোজা। রোজা একদিকে যেমন সংযমের তেমনি রোজায় কিছু পণ্যের চাহিদা অন্য সময়ের তুলনার বেড়ে দ্বিগুণ হয়। ছোলা, ভোজ্য তেল, পিয়াজ, খেজুর, ডালের মতো পণ্যের চাহিদা এই মাসে থাকে তুঙ্গে। এক হিসাবে দেখা যায়, রমজান মাসকে কেন্দ্র করে আনুষঙ্গিক ভোগ্যপণ্য আমদানিতে স্বাভাবিক সময়ের চাইতে বেশি ব্যয় হয় আড়াই বিলিয়ন ডলার। অথচ এবার একে তো পণ্য আমদানিতে নতুন এলসি খুলতে পারছে না ব্যাংকগুলো, তার ওপর রোজায় যাতে সংকট না হয়, সেজন্য আগেভাগেই খোলা এলসি’র বিল বিদেশি মুদ্রায় পরিশোধ করতে না পারায় খালাস করা যাচ্ছে না পণ্য। ডলার সংকট এতটাই তীব্র যে বিভিন্ন ব্যাংক শিল্পের কাঁচামাল আমদানির  এলসি খুলতে পারছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চাল, সার, ছোলা, জ্বালানি তেলসহ জরুরি পণ্য আমদানি। এসব খাতে ১১ সংস্থার চাহিদা ২৬৯.৫৩৮ মিলিয়ন ডলার, আর সোনালী ব্যাংকে আছে মাত্র ১১.২৬৭ মিলিয়ন ডলার।   গত ১৮ই জানুয়ারি প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্ট বলছে, ডলারে আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় চট্টগ্রাম বন্দরে আসা তিনটি জাহাজের পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না। জাহাজগুলোতে পবিত্র রমজান মাসের বাজার সামনে রেখে আনা হয়েছে অপরিশোধিত চিনি ও ভোজ্য তেল। পণ্যের পরিমাণ প্রায় ৫৪ হাজার টন, আমদানি মূল্য ৩ কোটি ৫১ লাখ মার্কিন ডলার। পণ্য নিয়ে আসা জাহাজগুলোর মধ্যে একটি মালয়েশিয়া থেকে প্রায় ১২ হাজার টন পাম তেল নিয়ে গত ২৫শে নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছায়। অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, জাহাজ আসার পর কয়েক মাসের বেশি পার হয়ে গেলেও তারা পণ্য খালাস করতে পারেনি। এতে ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রতিদিন গুনতে হচ্ছে ১৬ হাজার ডলার। মুশকিল হলো- ডলার সংকটের কারণে পণ্য খালাস করতে না পারায় জাহাজ ভাড়ায় যে জরিমানা গুনতে হচ্ছে, সেটিও পণ্যের দামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভোক্তার ঘাড়ে চাপবে। 

ডলারের সংকট কতোটা চরমে তার একটা ছোট্ট নমুনা হলো আসন্ন রমজানকে সামনে রেখে সিটি গ্রুপ চিনি, ছোলা, তেল সহ সাত ধরনের পণ্য আমদানির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে, ২৮টি ব্যাংকে যোগাযোগ করেও এলসি খুলতে পারেনি তারা। শেষমেশ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হলেও সুরাহা হয়নি কোনো।    পরিস্থিতির উন্নতি দূরে থাক, নতুন এলসি খোলা, পুরনো এলসি’র নিষ্পত্তি কোনো ক্ষেত্রেই ন্যূনতম কোনো পরিবর্তন আসেনি। অনেক ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেছে। অবশেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংককে সাফ জানিয়ে দিয়েছে বিদ্যমান ডলার সংকট এবং এলসি খোলায় অন্যান্য সমস্যার সুরাহা করা না হলে আসন্ন রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখা অসম্ভব হবে।   রমজানের মধ্যেই পণ্যমূল্যের পরিস্থিতি ঠিক কোন জায়গায় যাবে সেটা এবার একটু বোঝা যাক। এমনিতেই সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও রমজান মাসকে সামনে রেখে সরকারের আনুকূল্যপ্রাপ্ত বড় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেন অনেকটা।   

এবার রমজানের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত চাহিদার তুলনায় খুব ছোট ভগ্নাংশই আমদানি করা হচ্ছে অর্থাৎ একটা বড় সরবরাহ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে শুরুতেই। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও সরবরাহ ঘাটতি পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেয় অনেকটা। ওদিকে ডলারের বিপরীতে টাকা আপাতত স্থিতিশীল অবস্থা দেখালেও সামনের গরমে জ্বালানি সহ অন্যান্য পণ্যের আমদানির চাপ পড়ার পর দ্রুতই সেই স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়বে; টাকা তার মূল্য হারাবে আরও। সেটারও সরাসরি প্রভাব পড়বে পণ্য মূল্যের ওপর। সর্বোপরি বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি সরাসরি প্রভাবিত করবে প্রতিটি পণ্য উৎপাদন এবং পরিবহনে। সুতরাং সেটাও মূল্যস্ফীতির আগুনে ঘৃতাহুতি দেবে।  আসন্ন রমজানে একদিকে বিদ্যুৎ সংকট অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কোনোভাবেই স্বস্তি দেবে না মানুষকে। অবশ্য কেবল দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিই নয়, আশঙ্কা করা হচ্ছে পণ্যের সংকটও দেখা দেবে দ্রুতই। সব মিলিয়ে নানান দুর্ভোগে থাকা মানুষ রোজাতেও ন্যূনতম স্বস্তি পেতে যাচ্ছে না সেটা বলা যায় এখনই।  

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status