নির্বাচিত কলাম
সাফ কথা
দূষিত বাতাসের শীর্ষ তকমা থেকে ঢাকার মুক্তি মিলবে কবে?
কাজল ঘোষ
২৬ জানুয়ারি ২০২৩, বৃহস্পতিবার
এমন নানা আশঙ্কার বলাবলি আছেই। কিন্তু তাতে গা করছে না কেউই। অবস্থা এমন বকাউল্লা বকে যায়, শোনাউল্লা শুনে যায়। আমার দেখা ছেলেবেলায় যে ওয়ারী দেখেছি তা এখন মিলিয়ে দেখতে গিয়ে হতাশ হতে হয়। প্রচুর অট্টালিকা হয়েছে; তবে একসময় যে বাগান আর গাছপালার আধিক্য ছিল তা সমূলে গ্রাস করা হয়েছে। সকলেই অর্থ উপার্জনের জন্য ছুটছেন, রাজনীতিকরাও জমি দখল, নদী ভরাট করে দখল, নগর রক্ষকরা বাড়তি টাকাকড়ির জন্য সকল বেআইনি বিষয়কে বৈধতা দিয়ে শহরকে ভাগাড়ে পরিণত করছেন। যদি আমরা পরিবেশ নিয়ে সচেতন না হই তাহলে পরিবেশকে শুদ্ধ না রাখি তাহলে পরিবেশও আমাদের নিরাপদ স্বাস্থ্য নিশ্চিত করবে না
বছরের শেষদিনে বছরের সবচেয়ে খারাপ খবরটি পেয়েছিলাম আমরা। আর তা হচ্ছে দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা সবার শীর্ষে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর ২২১ নিয়ে ঢাকার বাতাসের মান ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ অবস্থায় ছিল। এ তালিকায় আমাদের পরেই রয়েছে ভারতের দিল্লি ও ঘানার আক্রা।
আমাদের পরিবেশ দূষণজনিত সমস্যা যদি এমন হতো তাহলে কিছুটা স্বস্তি পেতাম। এই দূষণে যে রেকর্ড তা থেকে পরের বছরই রেহাই মিলবে। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। চলছে শীতের মৌসুম। শহরের যে প্রান্তেই যাবেন ধূলায় ধূসরিত প্রান্তর। এতে আপনি আমি সকলেই লুটোপুটি খাচ্ছি। চীনের খুনমিংয়ে একটি শিক্ষা বিষয়ক কর্মশালায় অংশ নিতে গিয়েছিলাম। সেখানে আবহাওয়া গড়পরতা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়ায় থাকে। আমাদের এখানে শীত বেশি বলে যে তাপমাত্রার উল্লেখ করি সাধারণত তাই। সেই শহর আর এই শহরের তফাৎটুকু দৃশ্যমাণ হচ্ছে এখানেই, পুরো শহর সপ্তাজুড়ে ঘুরে বেড়ালেও আপনি এবং আপনার পোশাক থাকবে পরিচ্ছন্ন। কিন্তু ঢাকা নগরীতে ধূলায় আপনার পোশাক ছেয়ে যাবে অন্ধকারে। আর যদি এ সময়টায় একটিবার হাতিরঝিলে চক্রাকার বাসে পরিভ্রমণ কতোখানি সুখকর ও স্বস্তি বয়ে নিয়ে আসে তা যারা চড়েন তারাই জানেন।

এমনকি ব্যক্তিগত গাড়ির কাঁচ নামানো পর্যন্ত কঠিন এসব এলাকায়। তীব্র উৎকট দুর্গন্ধে নাক ভারি হয়ে আসে পুরো পথটিতেই। এ ছাড়াও পুরো শহরজুড়েই চোখে পড়বে মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কর ঝক্কর পরিবহনের কালো ধোঁয়া। কোভিড গেছে মাস্কও গেছে কিন্তু এই শহর কী মাস্ক ছাড়া চলার উপযুক্ত? এই প্রশ্নটি সবসময়ই মাথায় ঘুরেফিরে আসে। যখন আমরা উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আরোহণ করেছি অথচ বায়ু দূষণে আমরা শীর্ষে। বিশাল বিশাল প্রকল্প নিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকই তবে পরিবেশ, বাতাস, পানি এগুলোর কোনো উন্নতি নেই। খালি তলানিতে ঠেকছে। মেগাসিটি ঢাকায় মেগা দূষণ। এই শহরের ফুসফুস খেয়ে ফেলেছে দূষণ। দীর্ঘদিন ধরে বায়ু দূষণে ভুগছে এই মেগাসিটি। ঢাকার বাতাসের মান শীতকালে আরও অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়ে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার বায়ুদূষণের ৩টি প্রধান উৎস হলো- ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলো। আর এই ৩ প্রকারের দূষণ নিয়েই চলছে যুগের পর যুগ তোষণ। অসংখ্য প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে এই ৩ প্রকারের দূষণ নিয়েই। ঢাকার ট্রাফিক থেকে একাধিকবার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে এমন সব গাড়ির বন্ধ করে দেয়ার কথা বললেও তা আদৌ বাস্তবায়ন হয়নি। আর মেয়াদে চলা গাড়িগুলোই যদি কালো ধোঁয়া নির্গমন করে শহরের পরিবেশ দূষিত করে তাহলে সেসব গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কি কেউ নেই? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে, যা মূলত স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যান্সার ও তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে হচ্ছে। আর এই তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে আমাদের হাসাপাতালে আর ডাক্তারের চেম্বারে চেম্বারে শ্বাসজনিত রোগীদের উপস্থিতিই তার সাক্ষ্য দেয়। সম্প্রতি শিকাগো ইউনিভার্সিটির আরেকটি জরিপও আলোচনায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স’-এর প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে ঢাকায় বসবাসরত মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় ৭ বছর ৭ মাস। আর সারা দেশের মানুষের কমেছে ৫ বছর ৪ মাস। লাইফ ইনডেক্স আরও বলছে, বায়ুদূষণের কারণে সারা বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু কমেছে ২ বছর ২ মাস। স্থায়ীভাবে দূষণ বন্ধ করা গেলে বিশ্বের মানুষের গড় আয়ু ৭২ থেকে ৭৪ বছর হতো, যা সার্বিক হিসাবে ১৭ বিলিয়ন জীবন-বর্ষ। নির্মল বায়ুর জন্য স্থায়ী কোনো নীতি যেটি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে পারে, সেটা গড় আয়ু বাড়ানোর পাশাপাশি জলবায়ুর ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে বলে গবেষকরা মনে করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার ভয়ানক ধুলো দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কর্তৃপক্ষকে একটি বিশেষ কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। কেন না প্রতি বছর শীতকালে, বিশেষ করে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বায়ুদূষণের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। যা নগরবাসীর মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে শহরের বাতাসের গুণমানের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। নির্মাণাধীন স্থাপনা, ভাঙাচোরা রাস্তা, ইটভাটা এবং অন্যান্য উৎস থেকে দূষিত কণা প্রচুর পরিমাণে বাতাসে মিশে যাওয়ার কারণে এমন হচ্ছে। ধুলো দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য শহরের রাস্তাগুলোয় নিয়মিত পানি ছিটিয়ে দেয়া এবং শহরে অযোগ্য মোটরযানের চলাচল বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
একইসঙ্গে, সব নির্মাণাধীন সাইট আচ্ছাদিত করে রাখার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেন তারা। ঢাকায় পানি ও বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বস্তি এলাকার দরিদ্র মানুষ ও শিশুরা। রাজধানীর ৫৯টি এলাকাকে তীব্র মাত্রায় সিসা-আক্রান্ত বা হট স্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকার পানি ও মাটিতে আরও পাওয়া গেছে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, ক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫), কীটনাশক ও সালফার ডাই-অক্সাইডের মতো মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বস্তু। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) প্রধান ড. আব্দুল মতিন পরিবেশ দূষণের এই মাত্রাকে অতিবৃদ্ধির পেছনে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেও দায়ী করেছেন। তিনি গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে যার ফল স্বাস্থ্য বিপর্যয়। আমরা অনেক দিন ধরেই পরিবেশ নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু সমস্যা হলো যারা পরিবেশ দূষণের জন্য প্রধানত দায়ী তারা অনেক ক্ষমতাধর। তাদের এই ক্ষমতা রাজনৈতিকও। ফলে তারা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পরিবেশ দূষণ অব্যাহত রেখেছে। তিনি বলেন, ‘পরিবেশ রক্ষায় আইন আছে, নীতিমালা আছে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। এসব আইন ও নীতিমালা ভঙ্গ করলে শাস্তিরও বিধান আছে, অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে না। কিন্তু সরকার চাইলে পারে। সরকারের সদিচ্ছাই পারে পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা নিতে।
কিন্তু সরকার যদি সুশীল সমাজের মতো শুধু কথা বলে, কাজ না করে তাহলে সামনে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এমন নানা আশঙ্কার বলাবলি আছেই। কিন্তু তাতে গা করছে না কেউই। অবস্থা এমন বকাউল্লা বকে যায়, শোনাউল্লা শুনে যায়। আমার দেখা ছেলেবেলায় যে ওয়ারী দেখেছি তা এখন মিলিয়ে দেখতে গিয়ে হতাশ হতে হয়। প্রচুর অট্টালিকা হয়েছে; তবে একসময় যে বাগান আর গাছপালার আধিক্য ছিল তা সমূলে গ্রাস করা হয়েছে। সকলেই অর্থ উপার্জনের জন্য ছুটছেন, রাজনীতিকরাও জমি দখল, নদী ভরাট করে দখল, নগর রক্ষকরা বাড়তি টাকাকড়ির জন্য সকল বেআইনি বিষয়কে বৈধতা দিয়ে শহরকে ভাগাড়ে পরিণত করছেন। যদি আমরা পরিবেশ নিয়ে সচেতন না হই তাহলে পরিবেশকে শুদ্ধ না রাখি তাহলে পরিবেশও আমাদের নিরাপদ স্বাস্থ্য নিশ্চিত করবে না।