ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

ভোক্তা ঋণের দুর্ভোগ

মহিউদ্দিন আহমেদ
২৩ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার
mzamin

ভোক্তা ঋণ বাংলাদেশের মোট ঋণের প্রায় ১০ শতাংশের বেশি নয়। অতএব, ভোক্তা পর্যায়ে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি  মোকাবিলার চেষ্টায় ‘রিস্ক  বেনেফিট’ এনালাইসিস দরকার, লাভের তুলনায় লোকসান বেশি হলে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। ষান্মাসিক মুদ্রানীতি  ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মাননীয় গভর্নর মহোদয়, পাশাপাশি আশ্বস্ত করেছেন পরিবর্তিত অর্থনীতিতে পুনর্মূল্যায়ন করবেন


সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে এবং  ভোক্তা ঋণের সর্বোচ্চ সুদের হারের নীতি শিথিল করেছে, যার ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ২০২০ সাল থেকে চলমান ৯% থেকে ১২% পর্যন্ত সুদের হার বাড়াতে পারবে। পাশাপাশি আমানতের ক্ষেত্রেও ন্যূনতম প্রদেয় ৬% সুদের হার প্রত্যাহার করেছেন। দেশের ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলায় যতগুলো বিকল্প পথ আছে তার মধ্যে এটি একটি, যা সহজে নেয়া সম্ভব হচ্ছে, যার কারণ হিসেবে ড. বিরুপাক্ষ পাল (বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ) বলেছেন, “ব্যবসায়ীদের মতো নিরীহ  ভোক্তাদের কোনো সংগঠন নেই, যা দিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যায়।”  ভোক্ত ঋণ স্বল্প টাকার হয়ে থাকে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ পর্যন্ত, তাও নির্দিষ্ট আয়ের গ্রাহকদের জন্য এবং হোম লোন কিংবা বাড়ি বানানোর লোন ২ কোটি পর্যন্ত যা আগে ১.২০ কোটি ছিল। সাধারণত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা এই ধরনের লোন গ্রহণ করেন কারণ তাদের হাতে এককালীন সঞ্চয় বা অলস টাকা থাকে না। একজন স্কুল শিক্ষকের চাইতেও একজন ঝালমুড়ি বিক্রেতা মাসে অনেক বেশি আয় করেন কিন্তু স্কুল শিক্ষক পড়াশুনা করা মানুষ কী করে রাস্তায় নামেন, কী করে টিসিবি’র চাল নিতে লাইনে দাঁড়াতে পারেন! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্প্রতি একটি ছবি শেয়ার হয়েছে যেখানে লেখা আছে- “আসলে আমরা গরিব, লোকলজ্জায় আমরা মধ্যবিত্ত বলি।” 

এই মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তরাই তখন নির্ধারিত আয়ের বিপরীতে ভোক্তা ঋণ নিয়ে প্রয়োজন মেটান, যেমন- সন্তানের পড়ার খরচ, মেয়ের বিয়ে, বাবা-মায়ের চিকিৎসা খরচ, সদ্য বিবাহিত জুটি সাংসারিক প্রয়োজনে টিভি, ফ্রিজ, ওভেন ইত্যাদি কেনেন, ভাড়া বাসার ভাড়ার টাকার সঙ্গে নিজের বেতনের কিছু অংশ যোগ করে ফ্ল্যাট কেনেন, স্বামী-স্ত্রী চাকরি করেন, বাচ্চারা স্কুলে যায় সব ম্যানেজ করার জন্য একটি ব্যক্তিগত গাড়ি কেনেন, কিংবা নিজের একটা জমিতে বাড়ি করার জন্য ১৫/২০ বছর মেয়াদি লোন নিয়ে থাকেন। দু’জন ভদ্রলোকের কেস বলা যাক, যারা সমাজের চোখে উচ্চবিত্ত বিবেচিত হতে পারেন।  করোনার কারণে পৃথিবী যখন স্থবির, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকে কর্মী ছাটাই করেছেন, অনেকে সেলারি ও অন্যান্য ভাতা কমিয়ে দিয়েছেন। এমনই একজন কর্মকর্তা যিনি অফিস থেকে গাড়ি পেয়েছিলেন তিনি গাড়িটাকেই এখন বোঝা মনে করছেন, কারণ বেতন ও অন্যান্য ভাতা সঙ্কোচনের কারণে মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকা কম পাচ্ছেন, পক্ষান্তরে অকটেনের দাম ৮৯ টাকা থেকে ১৩০ টাকা হয়েছে, দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির কারণে ড্রাইভারের বেতন বাড়াতে হয়েছে, হোম লোন ছিল তার সুদ এই ঘোষণার আগে এক দফা বাড়ানো হয়েছে যার কারণ কিস্তির আকার বড় হয়েছে, দু’টি বাচ্চার স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে দেখেন নতুন বছরে  সেটাও বেড়েছে উল্লেখজনকভাবে, ছোট বাচ্চার দুধের দাম বেড়েছে আমদানি বন্ধ থাকায়, বাবা মায়ের ইনসুলিন,  মেডিসিন, কার্ডিয়াক অপারেশন সব মিলিয়ে ঋণাত্মক ধারায় চলছে সংসার।

বিজ্ঞাপন
 আরেকজন ভদ্রলোক (সঙ্গতভাবেই নাম অপ্রকাশ্য) ৬/৯ সুদের সুবাতাসে সাহস করে একটি বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন, হঠাৎ করোনাতে অনেক ভাড়াটিয়াই ঢাকা ছেড়ে চলে যায়, কারোর ভাড়া কমিয়ে দিয়ে রাখা হয়। 

 

 

এর মধ্যে বিদ্যুৎ, গ্যাস সব খরচ বেড়েছে, সব মিটিয়ে হাতে যা থাকে তা দিয়ে কিস্তি দেয়াই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে, প্রতিমাসেই ঋণ করতে হচ্ছে  লোনের কিস্তি পরিশোধ করার জন্য।  এমতাবস্থায় ঋণের সুদ বাড়ানো হলে ভাড়াটিয়াদের ভাড়া বাড়াতে হবে, ভাড়াটিয়াদের আবার নিজের কোনো পার্সোনাল লোন থাকতে পারে যার সুদ বাড়তে চলেছে, খাওয়ার খরচ/বাচ্চার পড়ার খরচ সব সংকট আরও ঘনীভূত হবে, নিজস্ব ফ্যামিলি বাজেট তখন ঘাটতি বাজেটে পরিণত হতে পারে যা সমন্বয়ের জন্য তারা বাচ্চার টিউটর ছাড়িয়ে দিতে পারেন, অফিসে দুর্নীতি করতে পারে, বা ফ্যামিলি গ্রামের বাসায় পাঠাতে পারেন, আবার আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারেন-সব নির্ভর করবে  সে কতোটা মানসিকভাবে শক্ত। উল্লেখ্য, তার চলমান ভোক্তা ঋণটি ইতিমধ্যে খেলাপি  লোনে পরিণত হয়ে যাবে।  ২০২০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক  ভোক্তাঋণসহ সকল লোনের সুদ সর্বোচ্চ ৯% নির্ধারিত করেছিলেন। অর্থনীতির ছাত্র নয় এমন একজন ভদ্রলোক বলছিলেন, “একটি ১০০০ বর্গফুটের স্পেস রেসিডেন্সিয়াল প্রয়োজনে ব্যবহার হলে যদি ভাড়া দিতে হয় ২০ হাজার টাকা একই স্পেস কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ভাড়া নিলে তাকে ভাড়া দিতে হবে কয়েকগুণ বেশি, কারণ স্পেসটি ব্যবসায়িকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। অথচ ব্যাংকের টাকা যখন বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার হচ্ছে তখন প্রাইস (সুদের হার) কম।” আমার কাছে কথাটা ফেলে দেয়ার মতো মনে না হলেও এটাও বাস্তবতা  যে, উৎপাদন খাতে ব্যাংকিং সহায়তা না হলে পণ্যের দাম বাড়বে এবং তা ভোক্তা পর্যায়ে প্রভাব ফেলবে। ট্রেডিং ও সেবা খাতে ও এটা প্রযোজ্য- সব  ভোক্তাকেই পরিশোধ করতে হবে। নতুন ঘোষণায় ব্যবসায়িক  লোনের সুদের হার ৯% বহাল আছে, কিন্তু ভোক্তার খরচ বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। 

একটি টিভি কিনতে ভোক্তাকে ৩% সুদ বেশি দিতে হবে, একটি ফ্ল্যাট কিনতে  ভোক্তাকে ৩% বেশি সুদ দিতে হবে। ভোক্তাদের কথা না ভাবলেও ব্যবসায়ীদের কথাও যদি ভাবা হয়, তবে বলা যায়  ভোক্তা পর্যায়ের সুদ বাড়ানোর কারণে টিভি, ফ্রিজ, ওভেন, ওয়াশিং মেশিন, মোবাইল, ল্যাপটপ, বাসাবাড়ির ফার্নিচার, রেডিমেট গার্মেন্টস, মোটরসাইকেল, আবাসিক ফ্ল্যাট ইত্যাদি বিক্রি অনেক কমে যাবে এবং এরসঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্প চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে। আবাসন খাত এমনিতেই নির্মাণসামগ্রীর দাম বহুলাংশে বাড়ার কারণে ফ্ল্যাটের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে পারছেন না, তার ওপর সুদ বাড়ানো হলে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা আরও কমে যাবে। অবিক্রীত অবস্থায় অনেক ফ্ল্যাট পড়ে থাকলে ডেভেলপারদের ব্যাংক ঋণ পরিশোধ অসম্ভব হয়ে যাবে, গ্রাহক ও জমির মালিকগণের প্রতি অঙ্গীকার রাখতে পারবেন না এবং মামলা সংক্রান্ত ঝামেলা বাড়বে।  নতুন ঘোষণায় শিক্ষা লোনকেও বর্ধিত সুদের আওতায় রাখার কথা বলা হচ্ছে।  অতি সম্প্রতি ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষা খাতে ব্যয়ের ৭১% বহন করে পরিবার। শিক্ষা খাতের ব্যয়ের মধ্যে আছে স্কুলের টিউশন ফি, প্রাইভেট টিউশন ফি, পরীক্ষা ফি ইত্যাদি। উক্ত  প্রতিবেদনের আলোকে অনেক শিক্ষাবিদরা শিক্ষায় সরকারের বিনিয়োগ বাড়াতে অভিমত দিয়ে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, করোনাকালে দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কমেছে, এক বছরের ব্যবধানে যা প্রায় আড়াই লাখ। শিক্ষার ব্যয়  মেটাতে না পেরে  এবং সংসারের হাল ধরতে তারা কর্মে নিয়োজিত হয়েছেন বলে মনে করেন শিক্ষাবিদগণ। এদেরকে ক্লাসে ফেরানোর তাগিদের মধ্যেই নতুন সংকট হবে শিক্ষা খাতের ঋণের সুদ বাড়ানো। করোনার কারণে বিদেশে উচ্চশিক্ষার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটাকে কাজে লাগাতে শিক্ষা খাতের মতো সংবেদনশীল খাতে আরও সহায়ক নীতিমালা প্রয়োজন। এই খাতে ঋণের সুদের হার বাড়ানো থেকে অব্যাহতি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বল্পসুদের রিফাইন্যান্স স্কিম চালু করলে উচ্চশিক্ষা খাত মজবুত ভিত্তি পাবে।   

ভোক্তা ঋণের গ্রাহকদের স্বস্তিতে কিছু প্রস্তাবনা   

১. লোনের সর্বোচ্চসীমা ১২% নির্ধারণ না করে আমানত ও ঋণের স্প্রেড (ব্যবধান) নির্ধারণ করা। ২. চলমান ঋণগুলোতে বাড়তি সুদের হার কার্যকর না করা। ৩. শিক্ষা খাতের  লোনকে আওতামুক্ত রাখা: উচ্চশিক্ষার সুযোগকে প্রসারিত করার লক্ষ্যে। ৪. হোম লোন ও হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্সগুলোকে আওতামুক্ত রাখা, কারণ এগুলোর ক্ষেত্রে ব্যাংকের জন্য প্রভিশন ইতিমধ্যে কমিয়ে ১% করা হয়েছে, তাছাড়া এগুলো সিকিউরড লোন/ মর্টগেজ লোন, জামানতবিহীন লোনের তুলনায় ঝুঁকি কম, তাই ঝুঁকি অধিহার (Risk Premium) কম, অতএব সুদের হারও কম হওয়া  যৌক্তিক। তাছাড়া আবাসন খাত সুরক্ষায় এটি কার্যকর হবে।  ৫. ট্যাক্সের তথ্য দিয়ে সুদের হারের বিভিন্ন অনুকূল (Customize) ধাপ করা। ৬. গ্রাহকের Risk Grading করে অনুকূল সুদ নির্ধারণ করা:   বিভিন্ন পেশাকে ক্যাটাগরি করে এবং রিস্ক অনুযায়ী সুদের হার নির্ধারণ করা।  ৭. ভালো গ্রহীতাদের প্রণোদনা চালু করা:। 

পরিশেষে, ভোক্তা ঋণ বাংলাদেশের মোট ঋণের প্রায় ১০ শতাংশের বেশি নয়। অতএব, ভোক্তা পর্যায়ে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি  মোকাবিলার চেষ্টায় ‘রিস্ক  বেনেফিট’ এনালাইসিস দরকার, লাভের তুলনায় লোকসান বেশি হলে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। ষান্মাসিক মুদ্রানীতি  ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মাননীয় গভর্নর মহোদয়, পাশাপাশি আশ্বস্ত করেছেন পরিবর্তিত অর্থনীতিতে পুনর্মূল্যায়ন করবেন। মুদ্রানীতির আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মানিত নীতি নির্ধারকগণ ব্যাংকগুলোর জন্য দিকনির্দেশনা  দেবেন। ক্লাসে শিক্ষক যেমন  পেছনের সারির সবচেয়ে দুর্বল ছাত্রকে মাথায় রেখে সহজ বোধগম্য করে  লেকচার দেন, তেমনি ঋণ সংক্রান্ত নীতিমালায় চূড়ান্ত ভোক্তাদের জন্য সহজ  কোনো সমাধান আসবে দেশের  কেন্দ্রীয় ব্যাংক  থেকে, এই আশা সবার।  

ই-মেইল: [email protected]

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status