ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

আন্তর্জাতিক

সবুজ জিবিয়া এবং নির্যাতিত ফিলিস্তিনি

মোহাম্মদ আবুল হোসেন
১৭ জানুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার
mzamin

শুক্রবার বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পার্লামেন্টে শপথ নিয়েছেন। এর মধ্যদিয়ে দেশে সবচেয়ে উগ্র ডানপন্থি সরকারের যাত্রা শুরু হলো। তার সরকার ধর্মীয় রক্ষণশীল। নতুন এই কট্টরপন্থি সরকারের অধীনে এসব বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল ও তাদের ওপর হামলা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি করবে বলে আশঙ্কা করা হয়

ফিলিস্তিনের রামাল্লাহ। এর উত্তর-পশ্চিমে একটি গ্রাম জিবিয়া। সেখানে আছে একটি বিস্তৃত, সবুজ এলাকা। দখলীকৃত পশ্চিম তীরে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা দীর্ঘদিন একটু দম ফেলার জন্য, একটু মুক্ত হাওয়ায় হাঁটার জন্য, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে এই স্থানটিকে ব্যবহার করেন। কয়েক বছরে এই বনসমৃদ্ধ এলাকাটিতে তারা পিকনিকে যান। একটু স্বস্তি পেতে স্বাভাবিক হাঁটাহাঁটি করতে যান। কিন্তু সম্প্রতি তাদেরকে সেখানে হয়রানি করছে এবং জোর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে ইসরাইলের সশস্ত্র বসতি স্থাপনকারীরা।

বিজ্ঞাপন
তাদেরকে আবার সমর্থন দিচ্ছে ইসরাইলের সেনাবাহিনী। স্থানীয়রা বলেছেন, প্রথমে সেখানে একটি বেআইনি ‘ফার্ম আউটপোস্ট’ স্থাপন করে বসতি স্থাপনকারীরা। চার বছর আগে এই হয়রানি শুরু করে তারা। ওই আউটপোস্টের নাম দেয়া হয়েছে হাভাট জাভি। গবাদিপশু চরানোর জন্য এই আউটপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, জিবিয়ার ওই সবুজ স্থানটি যাতে ফিলিস্তিনিরা ও পর্যটকরা ব্যবহার করতে না পারেন- এটাই তাদের উদ্দেশ্য। 

 

 

জিবিয়ার এই বনে বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা সংঘটিত সহিংসতার খুব কমই ইসরাইলের খবরের কাগজে এসেছে। ২০২১ সালে ইসরাইলের হারেটজ পত্রিকা রিপোর্ট করে যে, ইসরাইলের নাগরিকত্ব আছে এমন একটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে ওই এলাকায় বসতি স্থাপনকারীরা হয়রানি করেছে। এরপর সেনারা তাদেরকে ওই এলাকা থেকে বের করে দিয়েছে। এর দু’এক সপ্তাহ পরে একই রকম ঘটনার রিপোর্ট হয়। সে সময় আরেকটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে হয়রানি করে ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা। তাদের কোনো কর্তৃত্ব না থাকা সত্ত্বেও তারা ফিলিস্তিনি ওই পরিবারটির আইডি কার্ড দেখতে চায়। এক পর্যায়ে তাদেরকে ওই এলাকা থেকে বেরিয়ে যেতে চাপ দেয়। 

একই বছর অক্টোবরে নূর নামে একজনকে টার্গেট করে ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা। ওই বনে অন্য তিন জনকে নিয়ে এক শুক্রবারে তিনি পিকনিক করতে গিয়েছিলেন। নূর বলেছেন, তারা সবেমাত্র খাওয়া শুরু করেছেন এমন সময় জঙ্গলের  ভেতর থেকে বসতি স্থাপনকারীরা বেরিয়ে আসে এবং তাদের দিকে রাইফেল তাক করে অবিলম্বে চলে যেতে নির্দেশ দেয়। বসতি স্থাপনকারীরা বন্দুক ধরে ৬ মিনিটে সেখান থেকে তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়। এমন খবর পাওয়ার পর ওই বন সফরে যান আল জাজিরার সাংবাদিক জালাল আবু খাতের। তিনি লিখেছেন, গত নভেম্বরে একদল সাংবাদিক, সহযোগী স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে জিবিয়া সফরে যাই আমি। একজন ফিলিস্তিনি খামারির জলপাই তোলা নিয়ে ডকুমেন্টারি বানাই। জলপাই তোলা শুরু হওয়ার আধা ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে সশস্ত্র আট জন বসতি স্থাপনকারী বেরিয়ে আসে। তাদেরকে মদত দিয়ে সমর্থন দিতে থাকে ইসরাইলের চার জন সেনা সদস্য। তারা আমাদেরকে ঘিরে ফেলে। জলপাই তোলা দেখতে যাওয়ার মাধ্যমে আমরা বিরক্ত করছি বলে অভিযোগ এনে, সেখান থেকে চলে যেতে নির্দেশ দেয়। এই জায়গার সরকারিভাবে মালিক ফিলিস্তিনি ওই খামারি বা কৃষক। আমাদেরকে তারা সরিয়ে দিতে ব্যর্থ হলো। ফলে মুখোশ পরা বসতি স্থাপনকারীরা চলে গেল একটি পাহাড়ের উপর। সেখান থেকে আমাদের দিকে পাথর ছোঁড়া শুরু করলো। ঘটনাস্থলের কাছে কৃষক, সাংবাদিক ও স্বেচ্ছাসেবকদের বহন করে নিয়ে যাওয়া গাড়িগুলো ভাঙচুর করলো। তাদের ছোঁড়া পাথর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অন্যদের প্রতি আহ্বান জানালাম। কিন্তু ধাতব রডে লেগে আমার পায়ে ক্ষত হলো। তবে গাড়ির কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হলাম। মারাত্মক হওয়া থেকে রক্ষা পেয়ে ঘটনাস্থল ছাড়ি। পরে জানতে পারি, ওই দিন বসতি স্থাপনকারীরা মোট ১১টি গাড়ি ভাঙচুর করেছে। 

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পুরোটা সময় সেখানে ইসরাইলি সেনারা উপস্থিত ছিল। তারা পরিস্থিতিতে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। কারণ, তারা সেখানে শান্তির জন্য উপস্থিত ছিল না। তারা ছিল বসতি স্থাপনাকারীদের সহিংসতা, অনৈতিক এবং বেআইনি কর্মকাণ্ডের পক্ষে। 
হাভাট জাভির মতো কথিত ‘ফার্ম আউটপোস্টে’ যেসব বসতি স্থাপনাকারী বসবাস করে, তারা ফিলিস্তিনিদের তাড়াতে শুধু নিজেরাই উদ্যোগ নেয় এমন নয়। তাদের এই কর্মকাণ্ডে সমর্থন দেয় ইসরাইলি রাষ্ট্র এবং এর সশস্ত্র বাহিনী। ফিলিস্তিনিদের ভূমি বেআইনিভাবে দখল এবং তার সম্প্রসারণ কীভাবে করছে ইসরাইলের বসতি স্থাপনকারীরা তা ২০২১ সালের একটি রিপোর্ট ‘স্টেট বিজনেস: ইসরাইলস মিসঅ্যাপ্রোপ্রিয়েশন অব ল্যান্ড ইন দ্য ওয়েস্ট ব্যাংক থ্রু সেটলার ভায়োলেন্স’-এ তুলে ধরে বি’টিসেলেম। এতে বলা হয়, ইসরাইলের আইনেও এসব কৃষিজমিতে আউটপোস্ট অনুমোদিত নয়। তা সত্ত্বেও ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের সহায়তায় এসব আউটপোস্ট প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছে তারা। ওই রিপোর্টে বলা হয়, এসব আউটপোস্ট রক্ষা অথবা এর নিরাপত্তা, রাস্তাঘাট করে দেয়া, পানির লাইন স্থাপন, বৈদ্যুতিক অবকাঠামোর পক্ষে সেনাবাহিনীকে থাকার নির্দেশ দিয়েছে ইসরাইল। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সেটেলমেন্ট ডিভিশন অব দ্য ওয়ার্ল্ড জিওনিস্ট অর্গানাইজেশন এবং পশ্চিম তীরে আঞ্চলিক কাউন্সিলগুলোর মাধ্যমে এই সমর্থন দিয়েছে ইসরাইল। 
২০১০ সাল থেকে পশ্চিম তীরজুড়ে বিভিন্ন স্থানে এমন কমপক্ষে ৬৫টি ফার্ম আউটপোস্ট স্থাপন করেছে বসতি স্থাপনকারীরা। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, এসব আউটপোস্টের মধ্যে মাত্র চারটিতে ফিলিস্তিনের ২০৮৬ হেক্টর ভূমি দখল করেছে ইসরাইলিরা। এ ঘটনা ঘটেছে ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে। এই জমি দখল করতে তারা ব্যবহার করে পর্যায়ক্রমিক সহিংসতা ও সন্ত্রাস। এতে সহযোগিতা ও সুরক্ষা দেয় ইসরাইলের সেনাবাহিনী।

শুক্রবার বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পার্লামেন্টে শপথ নিয়েছেন। এর মধ্যদিয়ে দেশে সবচেয়ে উগ্র ডানপন্থি সরকারের যাত্রা শুরু হলো। তার সরকার ধর্মীয় রক্ষণশীল। নতুন এই কট্টরপন্থি সরকারের অধীনে এসব বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল ও তাদের ওপর হামলা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি করবে বলে আশঙ্কা করা হয়। ইতামার বেন-গাভির জিউস পাওয়ার পার্টি রয়েছে জোট সরকারে। তার প্ররোচনায় নেতানিয়াহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম ৬০ দিনের মধ্যে তিনি এমন বেআইনি কয়েক ডজন আউটপোস্টকে বৈধতা দেবেন। এই বেন গাভির সম্প্রতি প্রবেশ করেন মুসলিমদের পবিত্র আল আকসা মসজিদ চত্বরে। এর মধ্যদিয়ে তিনি রেড লাইন অতিক্রম করেছেন বলে তার কঠোর নিন্দা জানায় মিশর, জর্ডান, সৌদি আরব, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফিলিস্তিন এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত। ফিলিস্তিনি নেতারা তার এমন কর্মকাণ্ডকে অপ্রত্যাশিত উস্কানি বা প্ররোচনা বলে অভিহিত করেন।  দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ‘মসজিদ চত্বরে চরমপন্থি মন্ত্রী বেন গাভির প্রবেশের কড়া নিন্দা জানায় ফিলিস্তিন। একই সঙ্গে এটা যুদ্ধে উস্কানি ও বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্ররোচনা। আল আকসা মসজিদে বেন গাভিরের সফরকে এই মসজিদ ইহুদিদের উপাসনালয় বানানোর একটি ফন্দি হিসেবে অভিযোগ করেন ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ সত্যয়ে। সতর্কতা উচ্চারণ করেছে গাজা উপত্যকায় ক্ষমতায় থাকা যোদ্ধাগোষ্ঠী হামাস। তারা বেন গাভির এই উদ্যোগকে ‘রেডলাইন’ অতিক্রম হিসেবে অভিহিত করেছে। এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস ব্রিফিংয়ে বলেন, একতরফা যেকোনো কর্মকাণ্ড, যাতে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়, তার জন্য আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। কারণ, আমরা এর বিপরীতটা দেখতে চাই। জেরুজালেমের পবিত্র স্থাপনাগুলোর ঐতিহাসিক মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা সংরক্ষণে কঠোর অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি আরও বলেন, স্থিতাবস্থাকে নষ্ট করে এমন যেকোনো একতরফা কর্মকাণ্ড অগ্রহণযোগ্য। 
উপরন্তু বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারে আরেক উগ্র ডানপন্থি অংশীদার বেজালের স্মোট্রিচের রিলিজিয়াস জিওনিজম। তাদের হাতে পশ্চিমতীরের প্রশাসনিক ক্ষমতা তুলে দিতে রাজি হয়েছেন নেতানিয়াহু। রিলিজিয়াস জিওনিজম এসব আউটপোস্টকে শুধু বৈধতাই দিতে চায় এমন নয়। একই সঙ্গে তারা পশ্চিমতীরে ‘এরিয়া সি’তে ফিলিস্তিনিদের অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করে দিতে চায়। এর অর্থ হলো ইসরাইলে নতুন সরকারের অধীনে এমন নতুন নতুন ‘ফার্ম আউটপোস্টের’ সংখ্যাই শুধু বাড়বে এমন নয়। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের পশ্চিমতীরে যেসব নতুন ও পুরনো সহায় সম্পদ আছে, তা গুঁড়িয়ে দেয়া হতে পারে।

 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status