ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সাফ কথা

শীতেও নানামুখী আতঙ্ক দরকার সহানুভূতি ও সচেতনতা

কাজল ঘোষ
১৩ জানুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার
mzamin

দেশের সামনের কিছুদিন শীতের প্রকোপ বাড়তে পারে। এরমধ্যেই শ্রীমঙ্গলে দেশের সবচেয়ে কম তাপমাত্রা রেকর্ড হয়। তা ছিল ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উত্তরের হিমেল বাতাসের কারণেই শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। ঘনকুয়াশায় ঢেকে আছে সারা দেশ। দেশজুড়ে এমন বাতাস বইতে পারে আরও কয়েকদিন। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস বলছে, চলতি জানুয়ারিতে দেশে দুই থেকে তিনটি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। চলতি সপ্তাহের শেষদিকে  শৈত্যপ্রবাহ শুরু হতে পারে। কথা হচ্ছে, শৈত্যপ্রবাহে শীতের প্রকোপ তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। এই লেখা যখন লিখছি, তখন গুগল জানাচ্ছে বাংলাদেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পঞ্চগড়ে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ঢাকায় ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কলকাতায় ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর পাশর্^বর্তী দিল্লিতে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস

সময়টা ১৯৯৮ সাল।

বিজ্ঞাপন
দেশে তখন বন্যা চলছে। প্রায় ৫৪টি জেলায় পানি থই থই। মানুষ চরম দুর্ভোগে। চারপাশে তখন সকলের মধ্যেই দেশের জন্য কিছু করা দরকার। কিন্তু কীভাবে? যে যেভাবে পারবে সেভাবেই মানুষের পাশে দাঁড়াবে। আমি তখন গ্র্যাজুয়েশন করছি। পাশাপাশি পার্ট টাইম একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। কাজ এবং পড়া পাশাপাশি চলছিল। দেশের এই দুঃসময়ে  আমরা বন্ধুরা সকলে একদিন বসে ঠিক করলাম আমাদের অর্থ না থাকলেও শারীরিক সক্ষমতা দিয়ে যারাই বন্যার্তদের জন্য করছে তাদের পাশে দাঁড়াবো। দল বেঁধে আমরা টিএসসিতে গেলাম। সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সমন্বিত ত্রাণ তৎপরতা চলছিল। মনে আছে, টিএসসির ক্যাফেটেরিয়ার ভেতরে তখন লম্বা লম্বা টেবিলে লাইনে দাঁড়িয়ে রুটি বানিয়েছিলাম টানা কয়েকদিন। কোনো নির্ধারিত ব্যক্তি রুটি বানাবে এমন ছিল না। যারাই মানুষের জন্য কাজ করতে চায় তারাই এখানে ভলান্টিয়ারলি এই কাজে অংশ নিতো। শুধু তাই নয়, এর পাশাপাশি শুকনো খাবার প্যাকেট করা। সেগুলো পরে ভাগ ভাগ করে ত্রাণ কাজে ব্যবহৃত গাড়িতে তুলে দেয়া। বন্যা না কমা পর্যন্ত এই কার্যক্রমে সুযোগ পেলেই অংশ নিয়েছি। 

 

 

এই কথাগুলো মনে পড়লো তীব্র শীতে দেশের অনেক স্থানে দরিদ্র মানুষ খুব কষ্টে আছে আর সে খবর বিভিন্ন দৈনিকে প্রতিনিয়ত ছাপা হচ্ছে তা দেখে। এই নগরীতে শীতের প্রকোপ যতটা তারচেয়ে অনেক বেশি বাইরে। কিন্তু একজন সংবাদকর্মী হিসেবে চারপাশে যতটা খেয়াল রাখছি তাতে মানবিক সহায়তা নিয়ে শীতার্ত সাধারণ মানুষের পাশে যেভাবে বিত্তবান ও হৃদয়বান মানুষের ছুটে যাওয়া দরকার তার তোড়জোড় খুব একটা দেখছি না। অনেকেই হয়তো নীরবে মানুষকে সহায়তা দিয়ে থাকেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা। কিন্তু যার যা আছে তা নিয়ে উদাত্ত আহ্বানে এগিয়ে আসা দরকার দেশের সবখানে কষ্টে থাকা মানুষের পাশে।  

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সামনের কিছুদিন শীতের প্রকোপ বাড়তে পারে। এরমধ্যেই শ্রীমঙ্গলে দেশের সবচেয়ে কম তাপমাত্রা রেকর্ড হয়। তা ছিল ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উত্তরের হিমেল বাতাসের কারণেই শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে সারা দেশ। দেশজুড়ে এমন বাতাস বইতে পারে আরও কয়েকদিন। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস বলছে, চলতি জানুয়ারিতে দেশে দুই থেকে তিনটি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। চলতি সপ্তাহের শেষদিকে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হতে পারে। কথা হচ্ছে, শৈত্যপ্রবাহে শীতের প্রকোপ তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। এই লেখা যখন লিখছি, তখন গুগল জানাচ্ছে বাংলাদেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পঞ্চগড়ে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ঢাকায় ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কলকাতায় ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর পাশর্^বর্তী দিল্লিতে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দিল্লিতে অতিরিক্ত ঠাণ্ডার জন্য স্কুল বন্ধ ঘোষণা করে হয়েছে। ঢাকাসহ এই অঞ্চলের অধিকাংশ বিমানবন্দরেই বিমান চলাচল বিঘ্ন ঘটছে। অতিরিক্ত কুয়াশায় বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণে অচলাবস্থা চলছে।  

দেশের বিভিন্নস্থান থেকেই খবর আসছে ছিন্নমূল মানুষের দুর্ভোগের। বিশেষ করে যারা দিনমজুর, ক্ষেত খামারে কাজ করেন সেইসব মানুষদের দৈনিক আয় অনেক কমে গেছে। রাজধানীর পথে পথে বাইকারদের মধ্যেও হাহাকার দেখেছি। কারণ অতিরিক্ত শীতে বাইক চালাতে বাইকারের যেমন কষ্ট হয় ঠিক তেমনি যিনি চড়েন তীব্র ঠাণ্ডায় তারও দুর্ভোগ বাড়ে। শীতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোগবালাই। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ একজন চিকিৎসক জানালেন, যেখানে আগে গড়ে একশ’ রোগী আসতো চেম্বারে এখন সেখানে প্রায় তিনগুণ রোগী আসছে। সকল শিশুই শীতের কবলে নানাভাবে আক্রান্ত। অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আরেকটি বড় দুর্ঘটনার ক্ষেত্র হচ্ছে আগুনে দগ্ধ হওয়া। এ সময় বাসাবাড়িতে অনেকেই গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রেখে ভেজা কাপড় শুকাতে দেয়, অনেক সময় গরম পানি ব্যবহারের জন্য চুলা ব্যবহার করে। এ সময় অসাবধানতার ফলে আগুন লেগে অসংখ্য মানুষ অগ্নিদগ্ধ হন। আমাদের প্রতিবেদকের দেয়া তথ্য মতে, শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ৫০০ শয্যার একটিও খালি নেই। দগ্ধ রোগী প্রতিমাসে ১৮০০ থেকে ১৯০০ জন আসছে। সাধারণ সময়ে যেটি ছিল ৪০-৫০ জন। সেটি এখন বেড়ে প্রতিদিন গড়ে ৬৫ জন রোগী আসছেন জরুরি বিভাগে। এবং ২৩০ থেকে ২৫০ জন রোগী আসেন বহির্বিভাগে। সেবা নিতে আসা ৩০ শতাংশ রোগী বেড়ে গিয়েছে। 

হাসপাতালে সরজমিন গিয়ে আমাদের প্রতিবেদন দেখতে পান, জরুরি বিভাগে পোড়া শরীরের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে শিশু থেকে শুরু করে বয়স্করা। খালি নেই কোনো শয্যা। গ্যাস সিলিন্ডার, বিদ্যুৎস্পৃষ্টসহ অন্য আগুনে দগ্ধ রোগীদের পাশাপাশি তীব্র শীতের মধ্যে রান্নার চুলায় আগুন পোহাতে গিয়ে পুড়েছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ পাতিলে রাখা গোসলের গরম পানিতে দগ্ধ হয়েছেন। দগ্ধ সব রোগীর ২৫ শতাংশের নিচে পোড়া নেই। বার্ন ও প্লাস্টিক ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, বছরে আনুমানিক পাঁচ লাখ লোক আগুনে পুড়ে যায়। প্রতি বছরই এই সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। শীত আসলে এর সংখ্যা আরও বেড়ে যায় ৩০ শতাংশ। গত তিন মাসে ১ হাজার করে দগ্ধ রোগী বেড়েছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ অনেকেই এই দুর্ঘটনার শিকার হন। তবে শিশুদের সংখ্যা বেশি। গত এক বছরে শুধু বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৮৩ হাজার ২৪৫ জন। এরমধ্যে পুরুষ ৪৫ হাজার এবং নারী ৩৮ হাজার ২৪৫ জন। জানুয়ারিতে ৫ হাজার ৯৪৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৫ হাজার ৯৪১ জন, মার্চে ৬ হাজার ৫০ জন, এপ্রিলে ৪ হাজার ৪৭০ জন, মে ৪ হাজার ৮৭৭ জন, জুনে ৫ হাজার ৪৮০, জুলাইয়ে ৫ হাজার ৬৪, আগস্টে ৫ হাজার ৯৩৮, সেপ্টেম্বরে ৫ হাজার ৭৮৩, অক্টোবরে ৬ হাজার ৬৯৯, নভেম্বরে ৬ হাজার ৩৬৪, ডিসেম্বরে ৬ হাজার ৯৮ জন। মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৬ হাজার ৪২৮ জন। তার মধ্যে পুরুষ ৩ হাজার ৭৩৭ এবং নারী ২ হাজার ৬৯১ জন। 

এরইমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আবারো করোনাভাইরাস বাড়ছে এমন খবরও আছে। চীন, জাপান, উত্তর কোরিয়া এমনকি পাশের দেশ ভারতেও করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট আলোচনায়। যদিও বাংলাদেশ এখনো এই আলোচনায় থাকলেও আতঙ্কের মধ্যে নেই। তবে সাবধানতা অবলম্বন না করলে শঙ্কার কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না। 

ষড়ঋতুর এই দেশে একেক সময় একেক সৌন্দর্য অবলোকন করে থাকে মানুষ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বৈশি^ক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুনিয়াজুড়ে এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেই পরিবর্তনে আমরাও এর বাইরে নই। অতি গরম আর অতি ঠাণ্ডা কখনো বৃষ্টি কখনো খরা এমন টালমাটাল অবস্থার মধ্যদিয়ে চলছে ভূ-প্রকৃতি। স্বাভাবিক নিয়মে যেখানে বর্ষা হওয়ার কথা সেখানে খরা দেখা যাচ্ছে। আবার শীত দেরিতে আসছে। কখনো কখনো অতি মাত্রায় শীতে কাবু হচ্ছে জনজীবন। কিন্তু ধীরে ধীরে শীতও আমাদের জন্য নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিচ্ছে পিঠা পুলির বদলে। কারণ এখন শীত এলেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে বহু মানুষ হতাহতের ঘটনা ঘটছে। কোনো হাসপাতালেই বার্ন ইউনিট খালি নেই। হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো শীতে কাতর রোগীদের নিয়ে। চারপাশে আলোচনা হচ্ছে শীত আসার আগে থেকেই মানুষকে এসব বিষয়ে সজাগ ও সাবধান করতে সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নেয়ার জন্য। তথ্য প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারে মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন কিন্তু তার ছাপ জীবনধারণে নেই। না হলে শীতের কষ্ট নিবারণে শীত নিরোধক পোশাকের ব্যবহার না বাড়িয়ে মানুষ এখনো কেন নির্ভর আদিম শক্তি আগুনের কাছে, যেখানে কড়কড়ে উষ্ণতার পাশাপাশি রয়েছে দুর্ঘটনার ভয়ও। আসুন সম্মিলিতভাবে শীতের নানান রোগবালাই ও নানামুখী দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচতে নিজেরা সচেতনতার পাশাপাশি চারপাশের প্রতিবেশীদেরও সচেতন হতে বলি। আর শীত নিবারণে দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষের পাশে দাঁড়াই, সহযোগিতার হাত বাড়াই।

 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status