ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সাফ কথা

সংকট আর শঙ্কা নিয়েই কি কাটবে নতুন বছর?

কাজল ঘোষ
৪ জানুয়ারি ২০২৩, বুধবার
mzamin

দেশের রাজনীতি নানা শঙ্কায়। গত বছর বিরোধীদের মাঠপর্যায়ে যে ধরনের সভা-সমাবেশ হয়েছে নির্বাচন সামনে রেখে তা এ বছর আরও বাড়বে। ইতিমধ্যেই বিরোধী দল দশ দফা দাবি মেনে নেয়ার দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করছে। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসবে ততই তা পয়েন্ট অব নো রিটার্নের দিকে এগুবে বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। অন্যদিকে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে সারা বিশ্বেই অস্থির। ভোজ্য তেল, চাল ও গমের মতো অতি দরকারি পণ্যের বাজারে অস্থিরতা রয়েই গেছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশও এর বাইরে না। সাধারণ মানুষ যাঁতাকলে


বছরের প্রথম দিনটিও বিগত হয়ে গেছে। সকল বাধা-বিপত্তি, সংঘাত সংঘর্ষ পেরিয়ে আরও একটি বছর জীবন খাতায় অতীত হিসেবে গ্রন্থভুক্ত হয়ে গেল। প্রশ্ন থাকে, আমাদের গেছে যেদিন সেদিন কি একেবারেই গেছে? এই লাইনটি যতবার পড়ছি ততই মনে হচ্ছে ২০২২ সালটি যে সব আশঙ্কা আর উদ্বেগ নিয়ে কেটেছে ভালোই হতো যদি এই দিনগুলোর দেখা আর না মিলতো।

বিজ্ঞাপন
কিন্তু কিছু ভালো অভিজ্ঞতা যদি থাকে তা কি আমরা বাদ দিয়ে দেবো প্রাত্যহিক ঘটনাক্রমের তালিকা থেকে? নিশ্চয়ই না। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকেই সামনে এগিয়ে যেতে চাই। পেছনের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিতে চাই। হাজারো শঙ্কার বিপরীতে আশাবাদ নিয়ে পথ চলতে চাই।  বছরের শেষ দিনটিতে কথা বলছিলাম এক স্কুল বন্ধুর সঙ্গে। বিষয় ছিল ২০২২-এর শুরুর দিনটিতে কী কী করবো বলে ভেবেছিলাম। হিসাব মিলাতে গিয়ে দেখি অনেক প্রতিজ্ঞা আর প্রতিশ্রুতি গোলমাল হয়ে গেছে। এর কিছুটা নিজে দায়ী আর কিছুটা দায়ী দেশের সার্বিক পরিস্থিতি। হয়তো অনেকের মনে জিজ্ঞাসা হতে পারে দেশের পরিস্থিতি কীভাবে ব্যক্তির প্রতিজ্ঞা বা প্রতিশ্রুতি পালনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়? যখন দেশে সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি চলতে থাকে তখন ব্যক্তি মাত্রেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এর শিকার হয়। গেল বছরে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিশেষ করে দ্রব্যের বাড়তি মূল্য প্রতিটি পরিবারকে হয়রান করেছে। খাদ্য সংকট হতে পারে এমন টেনশন বিদায়ী বছরে যেমন ছিল তা নতুন বছরেও হবে না নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।  রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানো হয় অস্বাভাবিক হারে।

 চাল-গমের বাজারেও ব্যাপক অস্থিরতা তৈরি হয়। মূল্য বাড়তে থাকে। মধ্যবিত্ত অসংখ্য মানুষকে ন্যায্যমূল্য পণ্যের জন্য দিনের পর দিন লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। যা এখনো অব্যাহত আছে। রিজার্ভ সংকটে ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে না পারায় প্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের আমদানিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। লাখো ব্যবসায়ী মাসের পর মাস এ নিয়ে মনোবৈকল্যে কাল কাটিয়েছে বিদায়ী বছর। ডলারের বাজারে চরম অস্থিরতা অব্যাহত আছে। ৮৫ টাকার ডলার সরকারি রেটেই ১০৫ আর তা বাইরে খোলাবাজারে ১৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। দেশে রিজার্ভ সংকট রয়েছে এই মর্মে ঘাটতি নিরসনে সরকার আইএমএফের সঙ্গে দর কষাকষি করলেও এখনো তা আসতে শুরু করেনি। ২০২১ সালের আগস্টে যেখানে ৪৮ বিলিয়ন ডলার তা বিদায়ী বছরে নেমে আসে ৩৪ বিলিয়নে। ব্যাংকিং খাতের নানা অনিয়মের খবর এসেছে পত্রিকাতেই। রেকর্ড মূল্যস্ফীতি কাবু করেছে জনজীবনকে। ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল গত বছরের আগস্টে। তা ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। বছরজুড়েই লেগে ছিল জ্বালানি আর বিদ্যুতের তীব্র সংকট। অথচ বিদায়ী বছরেই সরকার শতভাগ বিদ্যুতায়নে উৎসব করেছে। ভোজ্য তেল, ডিম, আটার দাম পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। সবই অজুহাত হিসেবে দেখানো হয়েছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধকে। অথচ এসব দেশ থেকে যেকোনো পণ্য এলসি করে আনতে যে সময়ের দরকার তার অনেক আগেই বাড়ানো হয়েছে দাম। সবই ব্যবসায়ীদের কারসাজি আর সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অসহায়ত্বের ফল।    সরকারের ভেতরে বাইরে সর্বত্র আলোচনায় ছিল মার্কিন নিষেধাজ্ঞা।

 

 

 এ বছরও নতুন নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে- এমন মিশ্র আলোচনাও অব্যাহত রয়েছে। রাজনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। মাঠের রাজনীতিতে সরব ছিল বিরোধীপক্ষ। সরকারও একেবারে ফাঁকা মাঠ ছেড়ে দেয়নি। ১০ই ডিসেম্বর নিয়ে টানটান উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সমাবেশের স্থান নিয়ে নানা টালবাহানা আর সবশেষে গোলাপবাগ মাঠে অনুমতি মিললেও সমাবেশের আগেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাসসহ বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তারে দৃশ্যপট বদলে যায়। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ১০ই ডিসেম্বরের খেলায় সরকারের জয় হয়েছে বলে একাধিক সভায় দাবি করেছেন। বিদায়ী বছরে রাজনৈতিক দলের মিছিলে হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে। বিদায়ী বছরে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয়েছে। বিগত বছরে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের  মাঠপর্যায়ে তৎপরতা যেমন বেড়েছে তেমনি কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বাধা ও সংঘর্ষের ঘটনাও বেড়েছে বহুগুণ। চলতি বছর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে ৭৪টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যবেক্ষণ এবং তা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে। আসকের হিসাবে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবার দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যায় সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। মোট ৭৪টি সংঘাতের ঘটনায় একজন নিহত হয়েছেন। 

 সংঘাতে আহত হয়েছেন ১ হাজার ৪৬১ জন। এ সময় আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ ও বিএনপি’র সংগঠন ছাত্রদলের মধ্যেও সংঘর্ষ হয়। দুই ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ১০টি সংঘর্ষে আহত হন ৭৪ জন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ভোলা, মুন্সীগঞ্জ, নয়াপল্টনে বিরোধী নেতাকর্মী হতাহত হয়েছেন। ১০ই ডিসেম্বর গোলাপবাগের সমাবেশে বিরোধী এমপিরা সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছে। সিরিজ আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণাও এসেছে। বিদায়ী বছরের একেবারে শেষদিকে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে ২৭ দফা প্রস্তাবনাও পেশ করেছে বিএনপি।   সরকারি দল আওয়ামী লীগও মাঠে সরব ছিল বিদায়ী বছরে। ২০২৪ সালে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দল ও অঙ্গ সংগঠন ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি বিরোধী দলের সকল কর্মসূচিতেই ঘোষণা দিয়ে মাঠে থেকেছে। দলকে পুরোপুরি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে তা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সর্বত্রই। বছরের শুরু থেকেই চাউর হয়ে আছে এটা হবে নির্বাচনের বছর। সরকারি মহল এবং নির্বাচন কমিশন তাদের তৎপরতায় এটিকে আরও দৃশ্যমান করছে। কিন্তু যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বরাবরই আলোচনায় আসে নির্বাচনের আগে তার কি হবে?  এত গেল নির্বাচনী আওয়াজ। কিন্তু অর্থনীতি নিয়ে যে শঙ্কা তা থেকে চলতি বছরও মুক্তি নেই- এমন আভাস দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। 

বছরের শুরতেই কঠিন সতর্কতা দিয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফ। সংস্থাটির প্রধান ক্রিস্টিলিনা জর্জিয়েভা বলেছেন, এ বছর বিশ্ব অর্থনীতির এক তৃতীয়াংশ আর্থিক মন্দায় পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং চীনে অর্থনীতি ধীরগতির মুখে গত বছরের তুলনায় ২০২৩ সাল হবে আরও কঠিন। সিবিএস নিউজ  প্রোগ্রাম ‘ফেস দ্য  নেশন’-এ সংস্থার প্রধান মিস জর্জিয়েভা এসব কথা বলেন। ১৯০টি সদস্য দেশ নিয়ে গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক সংগঠন আইএমএফ। বৈশ্বিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার জন্য তারা একসঙ্গে কাজ করে। তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে আগেভাগে অর্থনৈতিক সতর্কতা দেয়া অন্যতম। ইউক্রেন যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি, সুদের উচ্চ হার এবং চীনে করোনাভাইরাস বিস্তারের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর চাপ পড়েছে। ২০২৩ সালের জন্য বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অক্টোবরে কর্তন করেছে আইএমএফ। মিস জর্জিয়েভা বলেন, আমরা মনে করছি বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ অর্থনীতি মন্দায় পতিত হবে। একদিকে দেশের রাজনীতি নানা শঙ্কায়।

 গত বছর বিরোধীদের মাঠপর্যায়ে যে ধরনের সভা-সমাবেশ হয়েছে নির্বাচন সামনে রেখে তা এ বছর আরও বাড়বে। ইতিমধ্যেই বিরোধী দল দশ দফা দাবি মেনে নেয়ার দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করছে। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসবে ততই তা পয়েন্ট অব নো রিটার্নের দিকে এগুবে বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। অন্যদিকে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে সারা বিশ্বেই অস্থির। ভোজ্য তেল, চাল ও গমের মতো অতি দরকারি পণ্যের বাজারে অস্থিরতা রয়েই গেছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশও এর বাইরে না। সাধারণ মানুষ যাঁতাকলে। তাদের দু’বেলা দু’মুঠো ভাত নিশ্চিন্তে খাওয়া দরকার। একটু সুস্থতার জন্য চিকিৎসা দরকার। নিরন্ন অগুনতি মানুষের মুখে হাসি কি সবসময় আছে? মাথাপিছু আয় বেড়েই চলেছে কিন্তু আমজনতার পকেট যা থাকার তাই। নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতি আর অর্থনীতি সামনে রেখে জীবনযুদ্ধ, রুটি- রুজির যুদ্ধ দুই-ই সমানতালে চলবে। একটি বছর গিয়ে যখন নতুন বছর আসে মানুষও বাঁচে নতুন আশায়। আমাদের সামনে সেই আশার ফর্দ এবারো কি ফিকে?  

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status