নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
রাজনীতি-কূটনীতির খেলা চলুক, তবে স্বদেশ নিয়ে নয়
তারিক চয়ন
২৫ ডিসেম্বর ২০২২, রবিবার
রাশিয়ান দূতাবাসের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এক টুইটে প্রশ্ন করে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে রাশিয়া, এটা (এই নীতি) কি ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? এখানেই শেষ নয়। ওইদিন রাতেই রাশিয়া দূতাবাস পাখির ছবি দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বকে কটাক্ষ করে টুইটারে একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে। এসবের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি দেশের মধ্যেকার বিরোধ প্রকাশ্যে চলে এসেছে বলে অনেকের ধারণা। কূটনীতির খেলা মাঠের খেলার মতো দেখতে ভয়াবহ না হলেও তার প্রভাব যে ক্ষেত্রবিশেষে কতোটা বিধ্বংসী, ভয়াবহ, সুদূরপ্রসারী হতে পারে তা নিশ্চয়ই সবাই বুঝতে সক্ষম। পরিশেষে লিখি, আমরা জমজমাট খেলা দেখতে চাই
৩২টি দেশ নিয়ে শুরু হওয়া কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবল শেষ হলো আর্জেন্টিনা-ফ্রান্সের মধ্যে অনুষ্ঠিত টানটান উত্তেজনাপূর্ণ, শ্বাসরুদ্ধকর এবং জমজমাট এক ফাইনাল ম্যাচের মধ্যদিয়ে। পরদিন সব পত্রিকার সংবাদ শিরোনামেই ছিল ফাইনাল ম্যাচের উত্তেজনার ছোঁয়া। তবে, মানবজমিনের ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রোমাঞ্চকর ফাইনাল’ শিরোনামটি বিশেষভাবে পাঠককুলের নজর কেড়েছে। শুরুতে ২-০ গোলে এগিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো মেসিবাহিনী। কিন্তু, ফরাসি তারকা এমবাপ্পে একাই তাদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ভয়াবহভাবে রুখে দাঁড়ান। ৯৭ সেকেন্ডের ব্যবধানে দুই গোল করে ম্যাচে সমতা নিয়ে আসেন এমবাপ্পে। এরপর আর্জেন্টিনা ফের এগিয়ে গেলেও ফের পেনাল্টি থেকে গোল করে এমবাপ্পে মেসিদের আরামের ঘুম হারাম করে দেন। কিন্তু, ফুটবল তো একার খেলা নয়। ১১ জনের খেলা। পুরোদস্তুর টিমওয়ার্কের বিষয়। সবাই মিলে ভালো খেললেই কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়। আর্জেন্টিনা যেমন পরেছে বিশ্বসেরার মুকুট। হেসেছে শেষহাসি। তৃতীয়বারের মতো জয় করে নিয়েছে বিশ্বকাপ। তবে, একথাও ঠিক, বড় প্রায় সব দলেই দু’একজন এমন খেলোয়াড় থাকেন যারা অনেক সময় হঠাৎ করে পুরো খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম। তারা মাঝেমাঝে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে প্রায় একাই ম্যাচ ছিনিয়ে নেন। কিন্তু, সেগুলোকে ব্যতিক্রমই বলা চলে। আর, ব্যতিক্রম কখনোই উদাহরণ হতে পারে না। আমরা বরং প্রচলিত ধারাতেই বিশ্বাস রাখতে চাই।
আর্জেন্টিনা-ফ্রান্সের মধ্যে অনুষ্ঠিত ওই ফাইনাল ম্যাচের মাত্র কয়েকদিন আগেই ছিল বিএনপি’র ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ। সমাবেশের তারিখ (১০ই ডিসেম্বর) নিয়ে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে রাজনীতির মাঠে এতো আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল যে ১০ই ডিসেম্বর দিনটি আসার আগেই ‘১০ই ডিসেম্বর’ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিহাস রচনা করে ফেলেছিল। যদিও সারা দেশে বিএনপি’র বিভাগীয় সমাবেশগুলোর মতো ১০ই ডিসেম্বর ছিল ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ কিন্তু, ‘১০ই ডিসেম্বরের পর শেখ হাসিনার কথায় দেশ চলবে না, দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়’, ৮ই অক্টোবর পল্লবীর কালশীতে আয়োজিত জনসভায় বিএনপি’র ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমানের এমন বক্তব্যের মধ্যদিয়ে ১০ই ডিসেম্বরকে নিয়ে দেশব্যাপী তুমুল আলোচনা শুরু হয়। আমানের বক্তব্যের পর তার সাথে সুর মিলিয়ে এমনকি আরো কয়েকধাপ এগিয়ে অনেক নেতারা ‘সমাবেশে খালেদা জিয়া উপস্থিত থাকবেন’, ‘তারেক জিয়া দেশে ফিরে আসবেন’ এমন ধরনের বক্তব্য দিতে শুরু করেন। কম যাননি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতারাও। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তো প্রতিদিনই ‘খেলা হবে, খেলা হবে’ বলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেইসাথে দলের অন্য অনেক নেতার পাশাপাশি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অনেকেই ১০ই ডিসেম্বর রাজধানীতে ‘কড়া পাহারা’ বসাবেন জানিয়ে দিয়ে বিএনপিকে ‘বাড়াবাড়ি’ না করতে সতর্ক করে দেন।

এভাবে, ১০ই ডিসেম্বরের খেলা নিয়ে যখন একদল ব্যাপক শোডাউন এবং অন্যদল কড়া পাহারার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, তখনই মূল খেলার বদলে খেলার ভেন্যু ইস্যুটিই প্রধান আলোচ্য হয়ে ওঠে। কখনো পল্টন, কখনো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, কখনো পূর্বাচলে বাণিজ্য মেলার মাঠ, কখনো ইজতেমা মাঠ, তুরাগ নদীর তীর আলোচনায় আসছিল। বিএনপি যদিও পল্টনেই সমাবেশ করার পক্ষে অনড় ছিল, কিন্তু সরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দেয়ার পক্ষেই প্রত্যক্ষ অবস্থান নিয়েছিল। চমকপ্রদ বিষয় এই যে, যেই ভেন্যু নিয়ে কোনো আলোচনাই ছিল না, সেই গোলাপবাগ মাঠেই শেষ পর্যন্ত সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১০ই ডিসেম্বর বিএনপি’র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু, ফাইনাল ম্যাচের আগেই (৭ই ডিসেম্বর) পেনাল্টি থেকে গোল করে বসে সরকারি দল! ম্যাচ শুরুর আগেই পিছিয়ে যায় বিরোধীরা! ফাউল না করেও পেনাল্টির শিকার হয়েছে বলে শুধু বিরোধীরাই দাবি করছে না, সচেতনমহলও একই কথা বলছে। শুধু তাই নয়, খেলা শুরুর আগেই লাল কার্ড দেখিয়ে মূল খেলোয়াড় ফখরুল, আব্বাস, সালাম ও রিজভীদের জেলে পুরা হয়। রাজপথে নিহত হন এক বিএনপি সমর্থক। তারপরও খেলা চালিয়ে যায় বিএনপি। ১০ই ডিসেম্বর অর্থাৎ মূল খেলার দিনটিতেও বিভিন্ন জায়গায় সরকারি দলের বাধার মুখে পড়েছে বিরোধীরা।
অনেক জায়গায় তাদের মোবাইল ফোনও ‘চেক’ করা হয়েছে। বন্ধ ছিল ঢাকার সিংহভাগ মানুষের যাতায়াতের প্রধান বাহন বলে পরিচিত পাবলিক বাসগুলোও। আগের দিন সন্ধ্যায় গোলাপবাগ মাঠ মানুষে ভরে গেলেও ১০ই ডিসেম্বরের জনসমাগম নিয়ে উপহাস করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এতকিছুর পরও সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তির বিষয় এই যে ১০ই ডিসেম্বর ঢাকায় কোনো সহিংসতা হয়নি। কিন্তু, ২৪ই ডিসেম্বর একইদিনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির কর্মসূচি নিয়ে ফের উত্তেজনা শুরু হয়। আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন ২৪শে ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ১০ই ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ থেকে ওইদিনই গণমিছিলের কর্মসূচি দিয়েছিল বিএনপি। স্বাভাবিকভাবেই ফের আতংকিত হয়ে উঠে সাধারণ মানুষ। কিন্তু, আওয়ামী লীগের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২৪শে ডিসেম্বর গণমিছিল করার সিদ্ধান্ত বাতিল করে বিএনপি। ফের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সাধারণ মানুষ। কিন্তু, এরইমধ্যে হঠাৎ করেই ঘটে গেছে দুটি ঘটনা যা নিয়ে কূটনৈতিক পাড়ায় শুরু হয়েছে তোলপাড়। রাজনীতির খেলার পর এবার কূটনীতির খেলা শুরু হয়েছে বলে অনেকেরই অভিমত। ঘটনা-১: ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গত ১৪ই ডিসেম্বর রাজধানীর শাহীনবাগে একটি বাড়িতে গুমের শিকার স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে যান।
ওই সময় ‘মায়ের কান্না’ নামের আরেকটি সংগঠনের সদস্যরা রাষ্ট্রদূতের অবস্থান করা বাড়ির প্রবেশদ্বারে তাকে ঘিরে ধরে স্মারকলিপি দেয়ার চেষ্টা করেন। কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়া তাদের ওই কর্মসূচির কারণে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পূর্ব-নির্ধারিত মায়ের ডাকের অনুষ্ঠান শেষ না করেই রাষ্ট্রদূত শাহীনবাগ ত্যাগ করতে চাইলে, বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেও তারা তাকে ঘিরে ধরেন। তার গাড়ির গতিরোধ করেন। বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে নিরাপদে বেরিয়ে পিটার হাস সোজা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে জরুরি সাক্ষাৎ করে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এরপর থেকে এ পর্যন্ত বাইডেন প্রশাসনের মন্ত্রী থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের কাছে নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ঘটনা-২: ২০শে ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকাস্থ রাশিয়ান দূতাবাসের স্বপ্রণোদিত এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, মস্কো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণ করেছে। বিবৃতিতে কারও নাম উল্লেখ না করে বলা হয়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার অজুহাতে যারা নিজেদেরকে ‘বিশ্বের শাসক’ বলে মনে করে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার কাজ চলছে যা স্পষ্টতই বিশ্বব্যবস্থার স্থায়িত্বকে হ্রাস করে, বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় ডেকে আনে।
২৪ ঘণ্টা না যেতেই (২১শে ডিসেম্বর) রাশিয়ান দূতাবাসের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এক টুইটে প্রশ্ন করে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে রাশিয়া, এটা (এই নীতি) কি ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? এখানেই শেষ নয়। ওইদিন রাতেই রাশিয়া দূতাবাস পাখির ছবি দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বকে কটাক্ষ করে টুইটারে একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে। এসবের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি দেশের মধ্যেকার বিরোধ প্রকাশ্যে চলে এসেছে বলে অনেকের ধারণা। কূটনীতির খেলা রাজনীতির মাঠের খেলার মতো দেখতে ভয়াবহ না হলেও তার প্রভাব যে ক্ষেত্রবিশেষে কতোটা বিধ্বংসী, ভয়াবহ, সুদূরপ্রসারী হতে পারে তা নিশ্চয়ই সবাই বুঝতে সক্ষম। পরিশেষে লিখি, আমরা জমজমাট খেলা দেখতে চাই। অনেকে তো দাবি করছেন পরপর দুটি বিশ্বকাপের মধ্যে সময়ের ব্যবধান চার বছর থেকে কমিয়ে তিন বা দুই বছরে নিয়ে আসা হোক। তাদের মতো, আমরাও নিয়মিত খেলা দেখতে চাই। তবে, সেটা প্রিয় স্বদেশকে নিয়ে কখনোই নয়।