মত-মতান্তর
আধুনিক রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দল: একটি বিশ্লেষণ
ইফতেখার আহমেদ খান
(১ বছর আগে) ২০ এপ্রিল ২০২২, বুধবার, ১২:৫৪ অপরাহ্ন

রাষ্ট্রের উৎপত্তি তাত্ত্বিকদের মধ্যে রাষ্ট্রের উদ্ভব নিয়ে বিস্তর মত ভিন্নতা কিংবা মত দ্বৈততা থাকা সত্ত্বেও আদিম সমাজের বিবর্তনের পথ ধরে বর্তমান আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্ভবের ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণে চিন্তাবিদদের চিন্তায় অনেক ক্ষেত্রেই মত ভিন্নতার সাথে সাথে বিশদ মাত্রায় মতৈক্যও পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে মার্ক্সস ও এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট মেন্যুফেস্টু নামক সনদটি ব্যতিক্রম। বস্তুতপক্ষে বস্তুর সংঘর্ষে সংঘর্ষে রাষ্ট্রের উদ্ভবের বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যখ্যাটি আমার কাছে কোথায় যেন ধাক্কা খায়। মার্ক্সস রাষ্ট্রের উদ্ভবের ব্যাখ্যায় মানুষের সমবায়ভিত্তিক সমষ্টির কল্যাণবিষয়ক ব্যাপারটিকে একেবারেই অস্বীকার করে রেখেছেন। আদিম প্রকৃতির রাজ্যে ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন অসহায়ত্ব অবস্থা দূর করার মানসে সমষ্টি বিষয়ক ধারণা ও ব্যবহারের সূত্রপাত। এটিই মূলত রাষ্ট্রের উদ্ভবের ভিত রচনা করেছে এবং এইখানেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ক চিন্তায় চিন্তাবিদদের মধ্যে ঐক্য পরিলক্ষিত হয়। এই নিবন্ধে মার্ক্সসের রাষ্ট্রচিন্তা একটু তফাতে রাখা হলো। কেননা রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ক যেকোন বর্ণনায় কার্ল মার্ক্সস চলে আসলে রাষ্ট্রের পক্ষে ইতিবাচক কিছু লেখার পথ থাকে না।
আধুনিক রাষ্ট্র ধারাণাটি একটি ব্যাপক ও বিস্তর প্রপষ্ণ। এই একটা শব্দ আধুনিক যা জড়িয়ে রয়েছে ছড়িয়ে রয়েছে সারা পরিবেশে সকল চিন্তায় সকল কিছুতে। যেমন, আধুনিক মানুষ, আধুনিক নাটক, আধুনিক কবিতা, আধুনিক জীবন, আধুনিক ভাবনা, আধুনিক সমাজ সর্বোপরি আধুনিক রাষ্ট্র।
প্রসঙ্গত, আধুনিকতা বিষয়টি আসলে কী? ধারণা হিসেবে মর্ডান শব্দটি আবির্ভাব ১৬ শতকের শেষ দিকে তাত্ত্বিক রেমন্ড উইলিয়াম তার ‘কি ওয়ার্ডস’ গ্রন্থে।
একটি বিষয় প্রথমে উল্লেখ করা জরুরি- ইংল্যান্ড রাজা-রানী শাসিত দেশ যা আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্র তথাপি ইংল্যান্ড আধুনিক রাজনীতির দেশ। শুধু তাই নয়, আধুনিক রাজনীতির জন্মও ইংল্যান্ডে। এটা কিভাবে হল, সে এক বিস্তর আলোচনা, এখানে এটা থাক। আধুনিকতা বিশ্বব্যবস্থার ক্রমবিকাশের একটি পর্ব যার শুরু মোটামুটিভাবে ১৮ শতক থেকে ইংল্যান্ডে। সমগ্র আধুনিকতাকে বলা যেতে পারে শিল্পবিপ্লবের পুত্র কিংবা কন্যা। কিংবা বলা যেতে পারে শিল্প বিপ্লব জন্ম দিয়েছে আধুনিকতা। বিশ্বসভ্যতার ক্রম বিকাশে পূর্বের বহু সময়ের সঙ্গে ১৮ শতকের পরবর্তী জীবন ধারার তুলনায় ব্যাপক পরিবর্তন এনে দিয়েছে এই শিল্পবিপ্লব। উল্লেখ্য, প্রযুক্তির চৌম্বকীয় বিকাশ ও প্রকাশের নমুনাটিই আধুনিকতা হিসেবে মূল্যায়িত। বিষয়টি একটি বড় ভুল।
প্রযুক্তি আধুনিকতার একটি উপাদান হতে পারে। একটি সমাজ প্রযুক্তির তুমুল ব্যবহার করলেই সেই সমাজকে আধুনিক সমাজ বলা যাবে না যদি সেখানে গণতান্ত্রিক শাসন না থাকে। আধুনিকতার একটি মৌল উপাদান ব্যক্তি স্বাতন্দ্রতাবাদ (Individualism)। এই ব্যক্তিস্বাতন্দ্রতাবাদ হলো গণতন্ত্রের বীজ। অর্থাৎ ব্যক্তি তার চিন্তার ব্যাপারে স্বতন্দ্র ও স্বাধীন। ব্যক্তি তার চিন্তার ভিত্তিতে ‘কে’ শাসক হবে তার রায় দিবে। এভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যক্তির রায় যার পক্ষে যাবে সেই হবে সেই কমিউনিটির শাসক। আর এজন্য প্রয়োজন হয় একটি প্রক্রিয়া-রাজনৈতিক দল হলো সেই প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক দল এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে একদল লোক নির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে একত্রিত হয়ে সমাজের বৃহৎ অংশের স্বার্থ একত্রিত করে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় শাসন ক্ষমতায় যেতে চায় বা যায়। এটিই মূলত রাজনৈতিক আধুনিকতা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়েছে। এটি একটি আধুনিক রাজনৈতিক দল। সমাজের বৃহৎ অংশের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে দলটি ১৯৭০ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়। ক্ষমতায় গিয়ে দল গঠন আধুনিক রাজনৈতিক দল নয়। সামরিক শাসন পূর্বের সামন্ত শাসনের প্রতিনিধি স্বরূপ। যেমন, রাজার ছেলে রাজা হতো, সেই ছেলে কী চরিত্রবান নাকি চরিত্রহীন তা বিবেচনার প্রয়োজন পড়ত না কিংবা রাজার ছেলে রাজা হওয়ার জন্য জনগণের মতামতের প্রয়োজন হতো না।
কোন একটি নির্দিষ্ট ধর্ম নিয়ে দল গঠন করলে সেটা আধুনিক রাজনৈতিক দল নয়, কেননা সেই দলটি শুধুু একটি নির্দিষ্ট ধর্মের লোকের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু রাজনৈতিক দল হতে হলে তাকে সমাজের সকল শ্রেণির, সকল পেশার, সকল বর্ণ-গোত্রের সকল অংশের নির্বিশেষে সকল ধরণের লোকের স্বার্থের সমবায়ে হতে হবে। সামাজিক পরিবর্তন সমাজের এক নিয়ত ধারা যেকোন ভৌগোলিক অবস্থানে। শিল্পবিপ্লব বিশ্ব পরিমন্ডলে বয়ে এনেছে বিস্তর সামাজিক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনই প্রতিষ্ঠা করেছে- আধুনিক ভাবনা, আধুনিক জীবন, আধুনিক নির্মাণ সর্বোপরি আধুনিক রাষ্ট্র। আধুনিক শাসন মানে দলভিত্তিক শাসন। দল গঠিত হলেই সেটাকে রাজনৈতিক দল বলা যাবে না।
লেখক: উন্নয়নকর্মী, কথাশিল্পি