ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সাম্প্রতিক

জিনিয়াস, সহনশীলতা সরলতার সৌন্দর্য

অ্যান্ড্রু মিত্রোভিকা
২৪ ডিসেম্বর ২০২২, শনিবার
mzamin

ট্যাটু এবং দাড়ি থাকা সত্ত্বেও লিওনেল মেসিকে এখনও একটি ছোট বালকের মতো দেখায়, যে কিনা ফুটবল নিয়ে খেলতে পছন্দ করে। এই সরলতা এবং সৌন্দর্যের মধ্য দিয়েই আজীবন মেসি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ভবিষ্যতে মানুষ মেসিকে মনে রাখবেন ফুটবল হাতে একটি ছেলে হিসেবে, যে তার বিস্ময়কর দক্ষতা ও নম্রতা দিয়ে বিশ্বকে অবাক করেছিল।

প্রতিভাবান সতীর্থ এবং একটি কৃতজ্ঞ জাতিকে সঙ্গে নিয়ে মেসির বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্নপূরণ দেখতে পারা বড় সৌভাগ্যের বিষয়। মেসির এই জয় যেন অনিবার্য ছিল। প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের বিপক্ষে হেরে যাওয়ার পর আর্জেন্টিনা দলটি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিল যাতে আর কোনো পরাজয়ের মুখে তাদের পড়তে না হয়। এরপর বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচেই মেসি ফুটবলটিকে নিজের করে নিয়েছিলেন এবং তার দুর্দান্ত পা এবং ভাবনাকে একত্র করে একের পর এক গোল করে গিয়েছেন। প্রতিটি গোলের পরে পরিচিত এবং স্পর্শকাতর রীতিতে মেসি তার প্রয়াত দাদির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি চুম্বন দিয়ে আকাশের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। তার দাদি জানতেন, সুযোগ দেয়া হলে মেসি একটি বলকে জাদুকরী বস্তুতে রূপান্তর করতে পারে। মেসিকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা এক কোচকে তার দাদি বলেছিলেন, ওকে খেলতে দিন, তাহলে আপনি দেখতে পাবেন ছোট ছেলেটি কত ভালো খেলে। 
সেই ‘ছোট ছেলে’ বহু বছর ধরে আর্জেন্টিনার রোজারিও থেকে, বার্সেলোনা এবং সবশেষ প্যারিসে তার প্রতি দাদির বিশ্বাসের প্রতিদান দিয়েছে। তিনি ধনী ও বিখ্যাত হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন
সম্ভবত তিনি মোহাম্মদ আলীর মতোই বিখ্যাত এবং মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। তবে মেসি ভুলে যাননি যে, সবকিছু শুরু হয়েছিল একটি মাঠ, একটি বল এবং তার দাদির দেখানো স্বপ্ন থেকে। তার সমসাময়িক অনেক তারকার মতো খ্যাতি, সম্পদ এবং ভালোবাসার কারণে মেসি কোনো গর্বিত প্রিমা ডোনাতে পরিণত হননি। মেসি মানুষের সঙ্গে তার আনন্দগুলো ভাগ করে নিয়েছেন। তিনি দুই হাত প্রসারিত করে তার ভক্তদের বিশ্বকাপ উদ্যাপনে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি চান যে, আমরা সেই আদিম মুহূর্তগুলো অনুভব করি। কাতারে তিনি সেটি বারবার করেছেন। তাই মেসিও তার উদারতার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আমরা যখন ছোট ছিলাম ফুটবল খেলার মধ্যে এক অসাধারণ আনন্দ ছিল। মেসি আমাদের সেই সময়ের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। 

 

 

বিশ্বকাপ জেতার পর মেসি ট্রফি উত্তোলনের অপেক্ষায় সাদা মঞ্চে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কাতারের আমীর মেসিকে একটি ‘বিশত’ উপহার দিয়েছেন। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী কালো এবং সোনার রিমযুক্ত আরব পোশাক। মেসি সেই পোশাকটি পেয়েছিলেন তার প্রতি সম্মানের চিহ্ন হিসেবে। 
বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা। দুই গোলে এগিয়ে থাকলেও দ্রুতই সমতায় ফিরে আসে নেদারল্যান্ডস। এরপর শ্বাসরুদ্ধকর পেনাল্টি শ্যুটআউটে জয়ী হয় আর্জেন্টিনা। পরবর্তী ম্যাচে তাদের সামনে পড়ে একগুঁয়ে ক্রোয়েশিয়া। সেখানে মেসি যেন তার সব প্রতিভা ঢেলে দিয়েছিলেন। মাঝমাঠের কাছ থেকে বল নিয়ে ঐতিহাসিক এক দৌড়। তিনি বলটি এগিয়ে নিয়ে যান যখন ক্রোয়েশিয়ার একজন ডিফেন্ডার তাকে থামানোর নিরর্থক চেষ্টা করছিলেন। যখন মেসি গোল পোস্টের কাছাকাছি পৌঁছালেন তিনি বলটিকে বিভ্রান্ত ডিফেন্ডারের পাশ দিয়ে পিছনে থাকা সতীর্থের পায়ে ঠেলে দিলেন। এবং গোল। 

গোলের পর বিস্ময় এবং প্রশংসায় গোটা গ্যালারি উৎসবে মেতে উঠলো। মেসি যা করেছেন তা অল্প কয়েকজন ফুটবলারই করতে পারেন। গোল নিশ্চিত হওয়ার পরই মেসি ঘুরে দাঁড়ালেন, হাত উঁচু করে স্পন্দিত স্ট্যান্ডের দিকে দাঁড়িয়ে থাকলেন। গোটা স্টেডিয়াম থেকে তখন শুধু ‘মেসি, মেসি, মেসি’ চিৎকার শোনা যাচ্ছে। এটাই ছিল টুর্নামেন্টের সেরা মুহূর্ত। একজন কিংবদন্তি অ্যাথলেট তার শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত করেছেন এবং গ্যালারিতে থাকা দর্শকদের সঙ্গে তা ভাগ করে নিচ্ছেন। 

ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে জয়ের পর বাকি থাকলো শুধু শক্তিশালী ফ্রান্স। মেসি ও ইতিহাসের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলেন অসাধারণ স্ট্রাইকার কিলিয়ান এমবাপ্পে। ফ্রান্সের বিরুদ্ধেও ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। মনেই হচ্ছিল বিশ্বকাপ শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনাই পাচ্ছে। কিন্তু এমবাপ্পের পর পর দুই গোলে খেলা চলে গেল অতিরিক্ত সময়ে। মেসিকে আরও একবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়। অতিরিক্ত সময়ের খেলায় এক গোল দিয়ে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে নিয়ে যান মেসি। তবে দ্রুতই এমবাপ্পে ফ্রান্সকে সমতায় নিয়ে আসেন। খেলা গড়ায় পেনাল্টিতে। 
পেনাল্টির নাটক শেষে জয় নিশ্চিত হলে স্বস্তিতে মেসি হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন। তার সতীর্থ এবং কোচ তাকে ঘিরে ধরেন। তার ভক্তরাও মনেপ্রাণে সেই সময় মেসির সঙ্গেই ছিল। তার মতো একজন অতুলনীয় খেলোয়াড়কে ধন্যবাদ। যে ট্রফি বারবার তার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল, অবশেষে রোজারিওর সেই ‘ছোট ছেলে’ সেই বিশ্বকাপ জয় করলো। মেসির দাদি বেঁচে থাকলে আজ অনেক গর্ব অনুভব করতেন। শুধু তার বিশ্বকাপ জয়ের জন্যই নয়, কাতার থেকে তিনি যে সম্মান পেয়েছেন তার জন্যেও। গায়ে পরে থাকা বিশত এবং হাতে থাকা বিশ্বকাপ নিয়ে মেসি আনন্দে চিৎকার করছিলেন। তার ভক্তরাও তার সঙ্গে আনন্দে চিৎকার করছিল। 

রোজারিও থেকে মেসির এই দীর্ঘ যাত্রা দেশের সীমানা এবং জাতীয়তাবাদকে অতিক্রম করেছে। মেসি প্রমাণ করেছেন, সাফল্যের চূড়ায় ওঠার পরেও একজন মানুষ কতখানি বিনম্র থাকতে পারেন। মেসির মধ্যে তার দাদি যে নম্রতার বীজ বপন করেছিলেন তা তিনি শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে এসেছেন। ফুটবল বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় একটি খেলা আর মেসি হচ্ছেন তার গ্লোবাল অ্যাম্বাসেডর। বল পায়ে তার অলৌকিক নৃত্য সরাসরি দেখতে পেরে আমরা সৌভাগ্যবান। 
(আল-জাজিরায় প্রকাশিত টরন্টোভিত্তিক কলামিস্ট অ্যান্ড্রু মিত্রোভিকার লেখা থেকে অনূদিত)

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status