ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সময় অসময়

বাংলাদেশই বাংলা সিনেমার এক নম্বর জায়গা হবে আমরা কী এই কথাটা জোর দিয়ে বলতে পারবো?

রেজানুর রহমান
২৩ ডিসেম্বর ২০২২, শুক্রবার
mzamin

কারও সঙ্গে তুলনা করতে চাই না। তুলনা করাও সাজে না। শুধু একটা কথা বলতে চাই, চলচ্চিত্রের প্রতি ওদের যে মায়া আর শ্রদ্ধা সেটা আমরা কেন দেখাতে পারছি না। মতপার্থক্য থাকতেই পারে। তাই বলে আমরা মশারির ভেতরে মশারি টাঙ্গিয়ে রাখবো। আমরা কথায় কথায় বলি- চলচ্চিত্রের বৃহৎ পরিবার। সেই বৃহৎ পরিবারটা কি বাস্তবে দৃশ্যমান? যারা চলচ্চিত্র নিয়ে ভাবি, ভাবনার জায়গাটা ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু পরিবারতো একটাই- চলচ্চিত্র পরিবার। আছে কি তার কোনো অস্তিত্ব? আমরা কি সাহস করে বলতে পারি- বাংলাদেশই বাংলা সিনেমার এক নম্বর জায়গা হবে? আওয়াজ শুনতে পারছি। কিন্তু আওয়াজটা স্পষ্ট নয়।

বিজ্ঞাপন
আওয়াজ বাড়াতে হবে। এই শক্তি আমাদের আছে। হ্যাঁ, এটাই সত্যি


ভারতীয় সিনেমার এক নম্বর জায়গা দখল করে নিবে কলকাতা। এই উক্তি স্বয়ং অমিতাভ বচ্চনের। ২৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনকালে ভারতের জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন দৃঢ়তার সঙ্গে একথা বলেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার এই বক্তব্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। কয়েকবার অমিতাভ বচ্চনের এই বক্তব্য শুনলাম। অজান্তে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন মাথায় এলো। কেউ যেন কানের কাছে বলছে, ওই যে দেখো পাশের বাড়ি কলকাতা। ওরা কতো কি পারে। তোমরা পারো না কেন? কলকাতা তো পাশের বাড়িই। সাংস্কৃতিক জীবনাচারণ তো প্রায় একই রকম। মানুষগুলোও একই চেহারার। ভিড়ের মাঝে একসঙ্গে দাঁড়ালে কাউকেই আলাদা করা যাবে না। অথচ ওরা যা পারে আমরা তা পারি না। কেন পারি না? এই প্রশ্নটাই বার বার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে।  কলকাতা ভারতীয় সিনেমার এক নম্বর জায়গা দখল করে নিবে, হ্যাঁ এটাই সত্য। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়? বাংলাদেশ কি এই মুহূর্তে সাহস করে বলতে পারবে বাংলা সিনেমার এক নম্বর জায়গা হবে বাংলাদেশ? আমি জানি একথা বলার সাহস ও যোগ্যতা আমাদের এখনো তৈরি হয়নি। অথচ এটাই তো হওয়ার কথা। বাংলাদেশই বাংলা সিনেমার এক নম্বর জায়গা হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাহস করে কথাটা তো বলা যাচ্ছে না।

  আবারো কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের প্রসঙ্গে আসি। কতো সুশৃঙ্খল আয়োজন। সিনেমার জীবন্ত কিংবদন্তি তারকা অমিতাভ বচ্চন, তার স্ত্রী বিশিষ্ট অভিনেত্রী জয়া বচ্চন, বলিউড বাদশা খ্যাত শাহরুখ খানের পাশাপাশি আমাদের চঞ্চল চৌধুরীও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের অতিথি ছিলেন। কলকাতায় এ রকম একটি বর্ণাঢ্য আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আমাদের প্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর অংশ নেয়া দেশের জন্য অনেক মর্যাদার। চঞ্চল চৌধুরী মূলত বাংলাদেশেরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, এই যে এতবড় একটা আয়োজনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করলেন, আপনার অনুভূতি কি? স্বভাব সুলভ মৃদু হেসে চঞ্চল বললেন, অনুভূতি অনেক ভালো। যাদের সঙ্গে মঞ্চে পাশাপাশি বসার সুযোগ হয়েছে তাদের অনেকেই পৃথিবীর সমগ্র সিনেমা জগতের আইডল। অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খানের সঙ্গে পাশাপাশি বসার সুযোগ হয়েছে। একজন অভিনেতা হিসেবে এই স্মৃতি আমার জীবনের অনন্য হয়ে থাকবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে চঞ্চল চৌধুরী বললেন, আমি কোনো প্রকার তুলনায় যাবো না। শুধু একটা কথাই বলবো ওরা সিনেমাকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়, সিনেমাকে যেভাবে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে সেই তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। চঞ্চল বললেন, ভালোবাসা ছাড়া স্বপ্ন টিকে থাকে না।

 আমরা স্বপ্ন দেখি। কিন্তু সেই স্বপ্নে ভালোবাসা নাই। সৃষ্টিশীল, সৃজনশীল কাজে ভালোবাসাটা অনেক জরুরি।  চঞ্চল চৌধুরী অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। ঠিকই তো ভালোবাসা ছাড়া কোনো মহৎ কাজ সম্ভব নয়। পরিবার থেকেই যদি শুরু করি- ভালোবাসাই একটি পরিবারকে আদর্শ পরিবার হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও ভালোবাসার শক্তিটাই আসল। সিনেমাও ভালোবাসা চায়। অথচ আমাদের সিনেমায় ভালোবাসার শক্তিটাই এখন সবচেয়ে দুর্বল।  অনেকে মনে করেন, আমাদের সিনেমায় যেদিন থেকে রাজনৈতিক দলাদলি শুরু হয়েছে সেদিন থেকে ভালোবাসার শক্তিও কমতে শুরু করে। কথায় আছে দশের লাঠি একের বোঝা। সেই দশটা লাঠি এখন আর একসঙ্গে নাই। কাজেই সিনেমার দুর্বল জায়গাটা আরও স্পষ্ট। বোধকরি সে কারণেই আমরা সাহস করে বলতে পারি না- বাংলাদেশই বাংলা সিনেমার এক নম্বর জায়গা হবে। 

 

 

একটা সময় আমাদের দেশে ভালো সিনেমার বিতর্ক উঠেছিল। ভালো সিনেমার অভাবে দেশের বিভাগীয় শহরের সিনেমা হলও বন্ধ হয়ে যায়। এক কালের নামকরা সিনেমা হল এখন আধুনিক ঝলমলে মার্কেট। গুলিস্তানের কথাই যদি ধরি। একটি সিনেমা হলের নামেই একটি এলাকার পরিচিতি বেড়ে গেল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এলাকার নাম ঠিকই আছে। অথচ সিনেমা হলটি আর নাই। কেন নাই এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের কাউকেই কোনো প্রশ্ন তুলতে দেখিনি।  ভালো সিনেমার অভাবের কথা বলে এই যে দেশের সিনেমা হলগুলো একের পর এক বন্ধ করে দিয়ে মার্কেট বানানো হলো এক্ষেত্রেও কার্যত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিনি। অথচ এখন তো ভালো সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। গত একবছরে কমপক্ষে ১০/১২টি ভালো সিনেমা নির্মিত হয়েছে।

 শুধু বাংলাদেশে নয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই সিনেমাগুলো প্রদর্শিত হচ্ছে। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মেজবাউর রহমান সুমনের হাওয়া নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। দেশের বাইরে আমাদের সিনেমা বেশ কদর পাচ্ছে। সেই তুলনায় দেশের ভেতরের অবস্থা কি? ঢাকার বাইরে ভালো সিনেমা হলই তো নাই। তাহলে ভালো সিনেমা বানিয়ে দেখাবো কোথায়? এই প্রশ্ন করলেন একজন তরুণ চিত্র পরিচালক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করে বললেন, আমি মনে করি এই দেশে সিনেমা বানানো এক ধরনের অপরাধ। ঘাটে ঘাটে প্রতিবন্ধকতা। মূলধারা, বিকল্পধারা, এফডিসিকেন্দ্রিক, এফডিসি’র বাইরের মানুষ ইত্যাদি বিভাজনে আমাদের চলচ্চিত্র সত্যিকার অর্থে দিশা হারিয়েছে। আলোর পথ খুঁজে পাচ্ছে না। 

 হ্যা, কথাটা সত্য। আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গনে অলিখিত, অদৃশ্য একটা বিভাজন স্পষ্ট। এই মুহূর্তে যাদের সিনেমা বেশ আলোচিত তারা অনেকে এফডিসি ঘরানার নির্মাতা নন। ফলে একটু যেন ঈর্ষার জায়গা তৈরি হয়েছে। এফডিসি ঘরানার অনেকে মনে করেন বাইরের নির্মাতারা নির্মাতাই নন। আবার একইভাবে বাইরের ঘরানার অনেক তরুণ নির্মাতা ভাবেন এফডিসি ঘারানার নির্মাতারা ব্যাকডেটেড। তাদের দিয়ে আর কিছুই হবে না। ফলে অদৃশ্য ঈর্ষার বলি হচ্ছে আমাদের প্রিয় চলচ্চিত্রাঙ্গন।  আমাদের চলচ্চিত্রের উন্মেষের স্বার্থে অদৃশ্য এই বিভাজন দূর করা প্রয়োজন। অদৃশ্য বিভাজন অনেকটা তুষের আগুনের মতো। প্রকাশ্যে দেখা যায় না। কিন্তু একদিন দেখা যায় সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অদৃশ্য বিভাজন, অদৃশ্য ঘাতকও বটে।  আবারো কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের কথায় আসি। কারও সঙ্গে তুলনা করতে চাই না। তুলনা করাও সাজে না। 

শুধু একটা কথা বলতে চাই, চলচ্চিত্রের প্রতি ওদের যে মায়া আর শ্রদ্ধা সেটা আমরা কেন দেখাতে পারছি না। মতপার্থক্য থাকতেই পারে। তাই বলে আমরা মশারির ভেতরে মশারি টাঙ্গিয়ে রাখবো। আমরা কথায় কথায় বলি- চলচ্চিত্রের বৃহৎ পরিবার। সেই বৃহৎ পরিবারটা কি বাস্তবে দৃশ্যমান? যারা চলচ্চিত্র নিয়ে ভাবি, ভাবনার জায়গাটা ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু পরিবারতো একটাই- চলচ্চিত্র পরিবার। আছে কি তার কোনো অস্তিত্ব? আমরা কী সাহস করে বলতে পারি- বাংলাদেশই বাংলা সিনেমার এক নম্বর জায়গা হবে? আওয়াজ শুনতে পারছি। কিন্তু আওয়াজটা স্পষ্ট নয়। আওয়াজ বাড়াতে হবে। এই শক্তি আমাদের আছে। হ্যাঁ, এটাই সত্যি।  

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।    

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status