ঢাকা, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

বেহুদা প্যাঁচাল

২৭ দফা রূপরেখা এবং কিছু কথা

শামীমুল হক
২১ ডিসেম্বর ২০২২, বুধবার
mzamin

বিএনপি রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতে ২৭ দফা রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরার পর দেশজুড়ে এই আলোচনা। কেউ পক্ষে বলছেন, কেউবা বিপক্ষে। এই পক্ষে-বিপক্ষে থাকার নামই হলো গণতন্ত্র। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ পর্যন্ত গণতন্ত্রের নামে গণমানুষ কী দেখেছে তা সবারই জানা। যে বিএনপি আজ রূপরেখা দিয়েছে সেই বিএনপি’র আমলও জাতি দেখেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রবণতাই দেখা গেছে বেশির ভাগ সময়। বিএনপিও এর বাইরে নয়। কিন্তু দীর্ঘদিন পর হলেও বিএনপি এ থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস ব্যক্ত করেছে এ রূপরেখার মাধ্যমে

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতে রূপরেখার কেন প্রয়োজন হলো? কেনইবা সংবিধান সংস্কারে কমিশন গঠনে বিএনপিকে জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি দিতে হচ্ছে? এর কি কোনো দরকার আছে? সোমবার বিএনপি রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতে ২৭ দফা রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরার পর দেশজুড়ে এই আলোচনা। কেউ পক্ষে বলছেন, কেউবা বিপক্ষে। এই পক্ষে-বিপক্ষে থাকার নামই হলো গণতন্ত্র।

বিজ্ঞাপন
কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ পর্যন্ত গণতন্ত্রের নামে গণমানুষ কী দেখেছে তা সবারই জানা। যে বিএনপি আজ রূপরেখা দিয়েছে সেই বিএনপি’র আমলও জাতি দেখেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রবণতাই দেখা গেছে বেশির ভাগ সময়। বিএনপিও এর বাইরে নয়। কিন্তু দীর্ঘদিন পর হলেও বিএনপি এ থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস ব্যক্ত করেছে এ রূপরেখার মাধ্যমে। বিশেষ করে তাদের সাতাশ দফার চার ও পাঁচ দফায় বলা হয়েছে- প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনয়ন করা হবে। পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। এই যে পর পর দুই টার্ম বিষয়টি যদি বাস্তবায়ন হয় তাহলে বোধ হয় দেশের গণতন্ত্র অনেকখানি এগিয়ে যাবে। এ রূপরেখায় উচ্চ কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের কথাও বলা হয়েছে।

 এ ছাড়া দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথাও বলা হয়েছে। বিএনপি’র দেয়া এ রূপরেখার সঙ্গে কেউ কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। সেই অধিকার তাদের রয়েছে। দেশের দুটি প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। একটি দল এ রূপরেখা দিয়েছে। আরেকটি দল আওয়ামী লীগ। যারা এখন সরকারে। বিএনপি’র সঙ্গে রয়েছে মাঠের আরও বেশক’টি জোট ও দল। তারা বিএনপি’র এ রূপরেখার সঙ্গে একমত। আওয়ামী লীগও এক নয়। তাদের সঙ্গে জোটে আছে জাতীয় পার্টি এবং একাধিক বাম দল। এই রূপরেখা নিয়েও তাই দুটি ধারা স্পষ্ট।  ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপি’র দেয়া ২৭ দফা রূপরেখা নিয়ে বলেছেন, যারা দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল, যাদের হাতে রক্তের দাগ, তারা রাষ্ট্রকে মেরামত করবে, এটা হাস্যকর। তিনি বলেন, যে রাষ্ট্র বিশ্বের বিস্ময়। ১৪ বছর আগের বাংলাদেশ, আর আজকের বাংলাদেশে উন্নয়ন-অর্জনের যে দৃশ্যপট, এই বাংলাদেশকে চেনাই যায় না। 

অথচ এই রাষ্ট্রকে তারা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। গতকাল আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল উপলক্ষে গঠিত খাদ্য উপ-কমিটির প্রস্তুতি সভায় তিনি এসব কথা বলেন। ওদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ রূপরেখা নিয়ে বলেছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলে বিএনপি জিয়াউর রহমানের মার্শাল ল’ ডেমোক্রেসি ফিরিয়ে আনতে চায়। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন,  আজকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের মহাসচিব, মার্কিন প্রেসিডেন্ট, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে পৃথিবীর সব নেতারা বাংলাদেশের প্রশংসা করছেন। সমপ্রতি বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেছেন, এই সংকটময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যেভাবে উন্নয়ন অগ্রগতি করেছে সেটা অন্য দেশের জন্য উদাহরণ। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন যদি এ সরকার না চান তাহলে নির্বাচনে আসেন। তখন বোঝা যাবে জনগণ এই সরকারকে চায় না, তাদেরকে চায়।  সে যাই হোক বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা হবেই। তবে কোনটি মঙ্গল আর কোনটি অমঙ্গল এটি দেশবাসী বুঝতে পারেন। সমস্যা হলো, দেশবাসীর এ বুঝতে পারার বিষয়টি রাজনীতিকরা মানতে চান না। মনে করেন তারা যা করছেন বা বলছেন সবই জনগণ লুফে নিচ্ছেন।

 

 

 আসলে যে তা নয়, সেটি কখনই রাজনীতিকরা বুঝতে চান না। যুগে যুগে এমনটাই হয়েছে।  বিএনপি’র রাষ্ট্র কাঠামো রূপরেখায় আরও যেসব রয়েছে তা হলো- উচ্চ কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠন, শিক্ষিত বেকারদের বেকার-ভাতা প্রদান, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি বিবেচনার আশ্বাস, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টিও রয়েছে রূপরেখায়।  বিএনপি’র কথা হলো- বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে, সেই রাষ্ট্রের মালিকানা আজ তাদের হাতে নাই। বর্তমানে রাষ্ট্র কাঠামোকে ভেঙে চুরমার করা হয়েছে। নতুন করে এই রাষ্ট্রকে মেরামত ও পুনর্গঠন করতে হবে। দেশের জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রয়োজন। নির্বাচনে জয়লাভের পর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহের সমন্বয়ে একটি জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। জাতীয় সরকারই ঘোষিত ২৭টি রাষ্ট্র রূপান্তরমূলক সংস্কার নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

  রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখার মধ্যে আরও  রয়েছে- বর্তমান সরকার কর্তৃক গৃহীত সকল অযৌক্তিক, বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনসমূহ রহিত ও সংশোধন করা। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য একটি ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করা হবে। সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে বলেও রূপরেখায় বলা হয়েছে। বর্তমান ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’ সংশোধন করা হবে।  সকল রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন করা হবে। শুনানির মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির ভেটিং সাপেক্ষে এই সকল প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক ও গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে নিয়োগ প্রদান করা হবে। বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। বর্তমান বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একটি ‘জুডিশিয়াল কমিশন’ গঠন করা হবে। একটি ‘প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন’ গঠন করে প্রশাসন পুনর্গঠন করা হবে। মিডিয়ার সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে একটি ‘মিডিয়া কমিশন’ গঠন করা হবে। দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোনো আপস করা হবে না। অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে। সংবিধান অনুযায়ী ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ করা হবে। 

সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। মানবিক মূল্যবোধ ও মানুষের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং অমানবিক নিষ্ঠুর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো হবে। বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে একটি ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন’ গঠন করা হবে। ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ এই মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার ভোগ করবেন। মুদ্রাস্ফীতির আলোকে শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা হবে।  বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ সকল কালাকানুন বাতিল করা হবে। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া হবে। বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডের মধ্যে কোনো প্রকার সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত করা হবে না এবং কোনো সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না। ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর স্বাধীন, শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান করা হবে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হবে এবং তাদের যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এই নীতির ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের ‘এনএইচএস’-এর আদলে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন করা হবে।

  রূপরেখায় বলা হয়, পরবর্তীতে যথাসময়ে অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক সংস্কার প্রস্তাব ও উন্নয়ন কর্মসূচি প্রকাশ করা হবে। তার মানে হলো এ রূপরেখায় আরও বেশ কিছু বিষয় সংযুক্ত হবে। সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে তা ঠিক করা হবে। একটি গণতান্ত্রিক দেশ পরিচালনার জন্য বিএনপি’র এ রূপরেখার অধিকাংশই বাস্তবসম্মত। এ নিয়ে সকল রাজনৈতিক দলসমূহ আলোচনার টেবিলে বসে সংযোজন, বিয়োজন করতে পারেন। এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে দিনের পর দিন। তারপর একমতে পৌঁছাতে পারে দলগুলো। এমনটি হলে দেশ এক মহাসংকট থেকে রক্ষা পাবে। আর প্রধান দুটি দল যদি দু’দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে তাহলে কী হবে, ভবিষ্যৎই জানে।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status