নির্বাচিত কলাম
চলতি পথে
আপনার পানে চাহি
শুভ কিবরিয়া
১৭ ডিসেম্বর ২০২২, শনিবার
কিন্তু মনের মধ্যে কতগুলো প্রশ্নও জাগলো? এই রিকশাওয়ালা বন্ধুটিকে যেভাবে আমরা তার ব্যক্তিগত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলাম, সেটা আমাদেরকেও করলে আমরা কি সহজে নিতে পারতাম? উনি যেভাবে হাসিতে-খুশিতে আমাদের জিজ্ঞাসা করা ব্যক্তিগত সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন, নিজ জীবনের অনেক গল্প করলেন, তা কী আমরা করতে পারতাম? এই যে অভিগম্যতার পার্থক্য, কিংবা একজনকে বিশ্বাস করে অবলীলায় নিজের মন খুলে কথা বলার স্বভাবজাত ক্ষমতা, তা তথাকথিত শিক্ষিত নাগরিক মানুষের জীবনে এত কম কেন? তাহলে কি জীবনকে আমরা খুব কঠিন করে ফেলছি, আমাদের জীবনের ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতার কারণে? আমাদের জীবনের ক্রমাগত চাহিদাই কি আমাদের জীবনকে এত জটিল-কুটিল করে ফেলেছে?
খাগান থেকে অবশেষে টেম্পু ছাড়লো নানান নাটক শেষে। মিরপুর শাহ আলী মাজার থেকে সাভারের বিরুলিয়ার খাগান অবধি যে টেম্পুগুলো চলে, মিরপুর থেকে যাবার সময় তারা সিরিয়াল মেনেই যাত্রী ওঠায়। আসার সময়, বিকালে যখন প্যাসেঞ্জার কমে যায়, তখন তারা কেউ সিরিয়াল মানতে চায় না। হুড়োহুড়ি করে, পাল্লা দিয়ে বেপরোয়া চালায়। নতুন যাত্রী হলে এই চক্রে পড়ে ভীষণ বিপত্তিকর অবস্থা। যা হোক শেষ অবধি আমাদের টেম্পুটা ছাড়লো। খেয়াল করলাম সকালে যে চালকের গাড়িতে গিয়েছিলাম ফিরতি পথে তাকেই পেলাম। আগে এসব টেম্পুতে কমবয়সী শিশুশ্রমিকরা হেলপার হিসাবে কাজ করতো। এই রুটে তার বালাই নাই। হেলপারকে যে দিনমজুরি দিতে হয় সেটা না দেবার উদ্যোগই এর কারণ।
আমি আর সাংবাদিক কাজল রশিদ শাহীন গিয়েছিলাম সাভারে ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাসে একটা বিশেষ প্রয়োজনে। সেখান থেকেই ফিরছি। কাজলের ব্যতিক্রমী সব অবলোকন ও জিজ্ঞাসু মনে নানান প্রশ্ন। এখানকার জায়গাগুলোর নাম ‘খাগান’, ‘আক্রান বাজার’ ইত্যাদি কেমন করে হলো, কী তার প্রেক্ষাপট, ঐতিহাসিক ব্যাকগ্রাউন্ডই বা কী, কাজলের এসব ভাবনা আমাকেও ছুঁয়ে গেল। যেকোনো জায়গার নৃতাত্ত্বিক, পুরাতাত্ত্বিক ইতিহাস জানলে একটা ভূখণ্ডের মানুষের বহুবিচিত্র বৃত্তান্ত জানার দ্বার উন্মোচিত হয়। এসব যখন ভাবছি চলন্ত টেম্পুতে তখন কাজলই খেয়াল করলো, টেম্পুর চাকায় কেমন যেন শব্দ। তার ধারণা চাকায় বাতাস কমে গেছে। সে কথা চালককেও বললো। কিন্তু এসবে পাত্তা দেবার সময় চালকের নেই। সে তখন ছুটছে অনেকটাই বেপরোয়া গতিতে। টেম্পুর যাত্রীদের এপথে যারা অনিয়মিত তাদের অনেকেই দেখলাম উদ্বিগ্ন। যারা এ পথের নিয়মিত যাত্রী তারা অবশ্য নিরুদ্বিগ্ন। এসবে যে তারা অভ্যস্ত তা তাদের নিশ্চিন্ত ভাব দেখেই বোঝা যায়।
খাগান-বিরুলিয়া-দিয়াবাড়ি পথের দিয়াবাড়ি মোড়ে এসেই টেম্পু হঠাৎ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। এবার টেম্পুর চালক জানালেন, নেমে পড়ুন, আর যাবে না। কারণ, টেম্পুর একটি চাকার বাতাস একেবারেই ফুরিয়ে গেছে। চাকায় বাতাস না দেয়া অবধি এটা আর চলবে না। কাজল তখন চালকের কাছে যেয়ে জানাল, এটা তো আমরা আগেই বলেছিলাম। চালক নিরুদ্বেগ, উদাসীন চোখে নীরবে তাকিয়ে রইলেন। তার কোনো উত্তর নেই। উত্তর দেবার প্রয়োজনটুকুও অনুভব করছে বলে মনে হয় না। কিশোর চালকের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। মায়াই হলো। মুখ শুকনা। সারাদিনের নানান ঝক্কির ছাপ অবয়বে সুস্পষ্ট। আহারে জীবন! এই বয়সে তার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে থাকার কথা। অথচ তাকে জীবিকার তাগিদে পথে নামতে হয়েছে। একটা বিপদসংকুল, ঝক্কিময়, অস্বস্তিকর পেশায় নামতে হয়েছে!
শাহ আলী মাজার বা মিরপুর-১নম্বর গোলচক্কর আমাদের যেতে হবে। হাঁটা পথে মাইল দুয়েক। আমরা অন্য কোনো টেম্পুর জন্য দাঁড়ালাম। পেলাম না। একটা রিকশা খুঁজছি। কিছুদূরে রাস্তার পাশে হালকা-পাতলা গড়নের এক রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে। সন্ধ্যা নেমেছে কেবল। আধো আলোছায়ায় রিকশাওয়ালার চেহারা দূর থেকে স্পষ্টও নয়। আশপাশে কোনো রিকশাও নেই। তার কাছে গেলাম। মিরপুর-১ নম্বর গোলচক্কর যেতে রাজি হলো। ভাড়া যা চাইলো তাতে, এ পথে চলার অভিজ্ঞতা থেকে ন্যায্য ভাড়াই মনে হলো।
অবাক হলাম কিছুটা। কেননা, স্বভাবত এরকম পরিবেশে যাত্রী পেলে আমাদের রিকশা-সিএনজির চালকেরা দুটো কাজ করেনÑ এক. যাবেন না এটা বেশ জোরেসোরেই জানিয়ে দেন। দুই. এমন ভাড়া চান যেটা ন্যায্যতার সীমা অতিক্রম করে। বাধ্য হয়েই যাত্রীদের সে ভাড়া মেনে নিতে হয়। এই রিকশাওয়ালারও সেটা করার সুযোগ ছিল। তিনি সেটা করলেন না। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাড়া আর কমানো যায় না। রিকশাওয়ালা খুব হাসিমুখেই জানালেন তিনি মোটেই ভাড়া বেশি চান নাই।
আমরা রিকশায় উঠে তার সাথে আলাপ জুড়ে দিলাম। জানালেন বছর পঁয়ত্রিশ আগে তিনি ঢাকায় এসেছেন। তারপর হাসিমুখেই বলে চললেন, রাস্তার আশপাশে সেইসময় কি কি ছিল। খাল-বিল, আর ভাগাড়ের সেসব পুরনো বয়ান শুনে কাজল প্রশ্ন করলো, পঁয়ত্রিশ বছর আগে ঢাকায় আসলে, আপনার এখন বয়স কত? উনি বললেন, পঞ্চাশের ওপরে। আমাদের বিশ্বাস হলো না। আমরা অনুমান করলাম বড়জোর চল্লিশের কাছাকাছি। কেননা তার চুল এখনো মিশমিশে কালো। চেহারা দেখে মনে হয় না এত বয়স হয়েছে। কাজলের ধারণা উনি হিসাবের গড়মিল করছেন। সেটা শুনে উনি জানালেন, আমার জাতীয় পরিচয়পত্র দেখলে বুঝবেন। এবার আমি তার পারিবারিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি যে উত্তর দিলেন তাতে আমরা ‘থ’ বনে গেলাম। তার দুই ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়েছে, নাতি-নাতনি আছে। প্রশ্ন করে জানলাম তার বাড়ি শেরপুর জেলায়। বহুবছর ধরেই রিকশা চালানো তার পেশা। রিকশাটির মালিকও তিনি। সংসারে তিনি সুখী মানুষ। তার শরীরে কোনো রোগশোক নেই। সম্পূর্ণ সুস্থ। যথেষ্ট পরিশ্রম করেন। আনন্দেই থাকেন। সোৎসাহে জানালেন শেরপুরে গ্রামের বাড়িতে একতলা বাড়িও করেছেন নিজস্ব জমিতে। আমি একসময় কিছুটা কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলাম, পরিবার (স্ত্রী) নিশ্চয়ই আপনার মতোই সুস্থ-সবল, ফিট। উনি তখন পেছন ফিরে তাকিয়ে আমার পাশে বসা কাজলকে দেখিয়ে বললেন, না না উনি আমার মতো না। এই যে এই ভাইয়ের মতোই। বোঝা গেল কাজলের মতোই মোটাসোটা। কাজল তখন হাসতে হাসতে বলেই ফেললেন, আপনি আর উপমা পেলেন না! পরিস্থিতিকে একটু হালকা করতে নাম জানতে চাইলাম। বললেন, মহির। জিজ্ঞাসা করলাম, বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখেন কিনা? হাসতে হাসতে বললেন, আর্জেন্টিনার খেলা দেখেন। কেননা মেসি তার প্রিয় খেলোয়াড়। একসময় ম্যারাডোনাকে ভালো লাগতো। সেই থেকেই আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের প্রতি সমর্থন, ভালোবাসা।

এভাবে চলতে চলতে আমরা পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। ততক্ষণে অবশ্য কাজল আবিষ্কার করে ফেলেছেন, আমাদের রিকশাওয়ালা বন্ধুটি চুলে নিয়মিত কলপ ব্যবহার করেন। একটু আধটু সৌখিনতাও আছে তার। একটা সুখী, পরিশ্রমী, আনন্দময় মানুষের সান্নিধ্য আমাদের খুব আপ্লুত করলো। সুখী থাকতে, আনন্দময় জীবনযাপন করতে কী দরকার- তার একটা দার্শনিক জবাবও হয়তো আমরা পেলাম এই রিকশাওয়ালা ভাইয়ের কল্যাণে।
কিন্তু মনের মধ্যে কতগুলো প্রশ্নও জাগলো? এই রিকশাওয়ালা বন্ধুটিকে যেভাবে আমরা তার ব্যক্তিগত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলাম, সেটা আমাদেরকেও করলে আমরা কি সহজে নিতে পারতাম? উনি যেভাবে হাসিতে-খুশিতে আমাদের জিজ্ঞাসা করা ব্যক্তিগত সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন, নিজ জীবনের অনেক গল্প করলেন, তা কী আমরা করতে পারতাম? এই যে অভিগম্যতার পার্থক্য, কিংবা একজনকে বিশ্বাস করে অবলীলায় নিজের মন খুলে কথা বলার স্বভাবজাত ক্ষমতা, তা তথাকথিত শিক্ষিত নাগরিক মানুষের জীবনে এত কম কেন? তাহলে কি জীবনকে আমরা খুব কঠিন করে ফেলছি, আমাদের জীবনের ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতার কারণে? আমাদের জীবনের ক্রমাগত চাহিদাই কি আমাদের জীবনকে এত জটিল-কুটিল করে ফেলেছে?
পুনশ্চঃ মনে পড়লো, স্কুলে পড়া, গ্রিক দার্শনিক ডায়াজিনিসের কথা। এই দার্শনিকের নাম-ডাক শুনে একবার বীররাজা আলেকজান্ডার তাকে দেখতে গেলেন। খুঁজে পেলেন এক পুকুরের পাশে। দেখলেন হাতের গ্লাস পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে, দুই হাতের আজলায় করে পানি খাচ্ছেন। আর বিড়বিড় করে বলছেন, এভাবেই যদি পানি খাওয়া যায় তবে গ্লাসের মতো একটা সম্পদ নামের বোঝা বহনের দরকারই বা কী! পানি খেয়ে তিনি পুকুরের পাড়ে রোদ পোহাচ্ছেন। আলেকজান্ডার ডায়াজিনিসের সামনে দাঁড়ালেন। বললেন, আমি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। আপনার কি উপকার করতে পারি? ডায়াজিনিস একটু হাসলেন। উপহাস ছলে তাকালেন। বললেন, কোনো উপকারের দরকার নেই। আমি রোদ পোহাচ্ছি। আপনি এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছেন তাতে রোদটা আড়াল হয়ে যাচ্ছে। দয়া করে যদি একটু সরে দাঁড়ান তবে আমি ভালোভাবে রোদ পোহাতে পারি। ডায়াজিনিসের এই বক্তব্য শোনার পর আলেকজান্ডার ফিরে এলেন নিজের রাজশকটে। সেখানে থাকা সেনাপ্রধানকে বললেন, আমি যদি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট না হতাম তাহলে কী হতে চাইতাম জানেন? আমি ডায়াজিনিসের মতো দার্শনিক হয়েই বেঁচে থাকতে চাইতাম।
শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, [email protected]