ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

মেসিময় বিশ্ব

মোহাম্মদ আবুল হোসেন
১৫ ডিসেম্বর ২০২২, বৃহস্পতিবার
mzamin

আর্জেন্টিনাকে অসাধারণ জয় এনে দেয়ার জন্য বুধবার বিশ্বের পত্রপত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিলেন মেসি, আলভারেজরা। পশ্চিমা বেশির ভাগ পত্রিকা প্রথম পৃষ্ঠায় মেসির অথবা মেসি ও আলভারেজের পূর্ণপৃষ্ঠা জুড়ে ছবি প্রকাশ করেছে। স্পেনের পত্রিকা এএস মেসিকে প্রশ্ন করেছে- ডে কুই প্লানেটা ভিনিস্তে? যার বাংলা হলো- আপনি কোন গ্রহ থেকে এসেছেন? অর্থাৎ এই শিরোনামের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, মেসি যা করেছেন তা এই গ্রহের মানুষের পক্ষে খুব কমই সম্ভব। তাই বিস্ময়ভরা প্রশ্ন নিয়ে তাদের সংবাদ শিরোনাম


ভূমিকম্প নয়। তার চেয়ে প্রবল, অমিত এক ভালোবাসার আবেগ পৃথিবী নামের গ্রহকে আনন্দে ভাসিয়েছে। উদ্বেলিত, উল্লসিত, বাঁধভাঙা মানুষের আর্তনাদে বিশ্ব কেঁপে উঠেছে। পটোম্যাক থেকে পদ্মা। উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু। সর্বত্রই আলবিসেলেস্তেদের জয়গান। শেষ রাতে ঢাকার আকাশে যখন আতশবাজির উৎসব, গলিতে গলিতে মিছিল, তখন আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্সআয়ারসের অবেলিস্কে মানুষের মহাসমুদ্র।

বিজ্ঞাপন
কত লাখ মানুষ সেখানে উল্লাস করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। যারা এবার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে নিয়ে হাসি তামাশা, উপহাস করেছেন তারাও হা হয়ে দেখেছেন ফুটবলের জাদু। রাস্তার পাশের ভুখানাঙ্গা ছেলেটিও যোগ দিয়েছে এই উল্লাসে। যুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশ, পেটে ভাত নেই, রাস্তায় সহিংসতা, রাজনীতিতে হানাহানি- এসবকে উপেক্ষা করে মানুষ একমঞ্চে এসেছেন ফুটবলকে ভালোবেসে। ক্রোয়েশিয়াকে পরাজিত করে বিশ্বকাপের শেষ দৌড়ে পৌঁছে গেছেন ম্যারাডোনার মেসি। ম্যারাডোনার সেই আর্জেন্টিনা। এখন স্বপ্ন একেবারেই হাতের কাছে। 

এই আনন্দে মঙ্গলবার আর্জেন্টিনা যেন আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়েছিল। মানুষ যেন লাভার মতো তা থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসছিলেন সেই অবেলিস্কে। সমস্ত কাজকে উপেক্ষা করেছেন তারা। রাতারাতি নিজেদের জার্সির ঘাটতি পড়েছে দোকানে দোকানে। এই জয়গানের সঙ্গে তাদের মুখে উঠে এসেছে কমপক্ষে ১০ হাজার কিলোমিটার দূরের ছোট্ট সবুজ এই বাংলাদেশ। অফুরান ভালোবাসা জানিয়েছেন তারা বাংলাদেশিদের, যারা হৃদয় দিয়ে আর্জেন্টিনার, ম্যারাডোনার, মেসির ফুটবলকে লালন করেন। ভালোবাসেন। বিশ্বের কোথাও নেই আর্জেন্টিনার এই জয়গান!

 

 

  জনতার মহাসমুদ্র অবেলিস্ক স্কয়ার: বুয়েন্সআয়ার টাইমস লিখেছে, আর্জেন্টিনায় এদিন আনন্দ পরিণত হয়েছে আর্তনাদে। মানুষ আনন্দে কাঁদে। স্টেডিয়ামের গ্যালারিতেও আনন্দে কাঁদতে দেখা গেছে এক মধ্যবয়সী আর্জেন্টাইনকে। আর্জেন্টিনার ঘরে ঘরে এদিন শুধুই ফুটবলের জয়গান। তারা গান বাজিয়ে, নেচে গেয়ে উদ্‌যাপন করেছেন নিজেদের সুন্দরের, শৈল্পিক ফুটবলের কবিতাকে। জেতার পর পুরো দেশকে গ্রাস করে ফুটবল। মানুষ সব কাজ ফেলে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। যেন উন্মাতাল পার্টিতে মেতে ওঠেন তারা। সারা দেশ পরিণত হয় সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো মানুষের ঢেউয়ে। তারা পায়ে হেঁটে, গাড়িতে করে, আন্ডারগ্রাউন্ড ‘সাবতে’ গাদাগাদি করে, বাসে করে সমবেত হতে থাকেন শহরগুলোতে। এতে বিখ্যাত অবেলিস্ক পরিণত হয় উৎসবে। এর নাম দেয়া হয় ‘অ্যাভেনিদা ৯ ডি জুলিও’। ২৩ বছরের এক যুবক রামিরো মন্টেইরো বলেছেন, এর আগে কোনোদিন আমরা এমন করে বিশ্বকাপকে অনুভব করিনি। আমাদের ফুটবলের কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনা (২০২০ সালে) মারা গেছেন।

 আর এই বিশ্বকাপটা হতে যাচ্ছে এখনকার জীবন্ত কিংবদন্তি লিওনেল মেসির শেষ বিশ্বকাপ। ৭৪ বছর বয়সী পেনশনার পাবলো কারডোজো আনন্দে কেঁদে ফেলেছেন। কোনোমতে কান্না থামিয়ে তিনি বলেন- আমরা জিতেছি। ভালোবাসি আর্জেন্টিনা। বুয়েন্সআয়ারসের এক ক্যাফেতে খেলা উপভোগ করছিলেন তিনি। উপস্থিত তরুণ, যুবক সবাই আসন ছেড়ে চিৎকার করে গাইতে শুরু করেন আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপের গান- ‘মুচাচোস, আহোরা নোস ভোলভিমোস এ ইলুসিওনার’। এর অর্থ- হে যুবক আমরা আবার উৎফুল্ল। ক্লারা সারডেইরা (২০) নামের একজন শিক্ষার্থী বলেন, এই খেলাটাকে কঠিন খেলা হিসেবে দেখা হয়েছিল। অন্য সময়ের চেয়ে ম্যাচটা ছিল হাইভোল্টেজের। কারণ, এই ম্যাচটা ছিল বাঁচা-মরার লড়াই। 

 

 

এই ক্রোয়েশিয়াই এবার অন্যতম ফেভারিট ব্রাজিলকে ফেরত পাঠিয়েছে দেশে। নিকো ওটামেন্ডি এবং ক্রিস্টিয়ান রোমেরোকে দুটি সিংহ হিসেবে অভিহিত করছেন সুপারমার্কেট কর্মচারী রড্রিগো সারসিনো (২৪)।  দক্ষিণে মার ডেল প্লাটা সমুদ্র সৈকতের অবকাশযাপনে পুন্টা মোগোটেসে সমবেত হয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। এটা হলো আর্জেন্টিনা দলের বাজপাখি হিসেবে পরিচিত গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্টিনেজের নিজের এলাকা। এখানেই তার বাড়ি। আরও চমক অপেক্ষা করছে। সাতবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী মেসির জন্য আরও ভালোবাসা অপেক্ষা করছে। তিনি যদি সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন, অতি আদরে ম্যারাডোনা যে জন্য মেসির মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন- তখন আর্জেন্টিনায় কি হবে, বিশ্বে কোথায় কি হবে, তা আগাম বলা যায় না। ইতিহাসবেত্তা ফেলিপে পিগনা বলেন, কোটি কোটি ভক্তের হৃদয়ে ঢুকে গেছেন মেসি। তিনি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য একজন ব্যক্তি। তিনি নেতৃত্ব দেখিয়েছেন। আর্জেন্টাইন টিমকে তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছেন।  

দারিদ্র্য, সহিংসতা ভুলে ফুটবলে পাকিস্তান: পাকিস্তানের করাচি। এর আশপাশের এলাকাগুলো গ্যাং সহিংসতা এবং দারিদ্র্যে ভরা বলে পরিচিত। কিন্তু তারাও সব ভুলে গিয়েছিলেন এদিন। তারাও আর্জেন্টিনার ফুটবলের জাদুতে মুগ্ধতা নিয়ে বসে ছিলেন টিভির সামনে। বুধবার আগেভাগে লিয়ারি সড়কে মানুষ গিয়ে জমায়েত হতে থাকেন। তাদের পরনে আর্জেন্টিনার টি-শার্ট। আর্জেন্টিনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছার পর তারা নাচলেন। গাইলেন। ৪০ বছর বয়সী ফুটবল কোচ তাহির খান বলেছেন, আর্জেন্টিনার ফুটবল দ্বারা অনুপ্রাণিত বেশির ভাগ যুবক। মেসিই ফেভারিট। এটা অনস্বীকার্য। অনেকে মেসির পুরো মাত্রার ছবি পেইন্ট করেছেন। ৪৫ বছর বয়সী শাহিদ সালেম বলেন, আমার প্রিয় দল আর্জেন্টিনা। আমার দুই ছেলে ব্রাজিলের কট্টর ভক্ত। তারা এ নিয়ে আমার সঙ্গে প্রতিদিনই বচসা লাগিয়ে রাখে। 

বার্সেলোনায় ঘুমহীন রাত: যে বার্সেলোনা লিওনেল মেসিকে নতুন জীবন দিয়েছে, সেই বার্সেলোনা তাদের হৃদয়ের কাছের মেসির আনন্দে ঘুমহীন ছিল মঙ্গলবার দিবাগত রাত। মেসির হরমোনজনিত জটিলতায় তাকে নিয়ে চিকিৎসা করায় বার্সেলোনা। তিনিও প্রতিদান দেন। বার বার বার্সেলোনা ক্লাবকে জয় এনে দিয়ে এই ক্লাবকে ইউরোপের অন্যতম ক্লাবে পরিণত করেন। বার্সেলোনাবাসী খুব কাছ থেকে দেখেছেন মেসির দুই পায়ের ছন্দ। তারা তাকে হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই দিয়েছেন। মেসি এখন আর বার্সেলোনায় নেই। কিন্তু বার্সেলোনা তাকে ভুলে যায়নি। তার বিজয়ে মঙ্গলবার রাতে আরকো ডেল ত্রিউনফো’তে ছিল মানুষ আর মানুষ। তারা মেসির জয়ে উল্লাস করেছেন। ফুটবল স্প্যানা সেই দৃশ্যের ভিডিও টুইট করেছেন। তাতে মনে হয়েছে ওই সময় আরকো ডেল ত্রিউনফো হয়ে উঠেছিল ছোট্ট এক টুকরো আর্জেন্টিনা। তারা পতাকা দুলিয়ে, নেচে গেয়ে সেলিব্রেট করেছেন মেসিকে, আর্জেন্টিনার ফুটবলকে।  

বিশ্বমিডিয়ায় মেসি: আর্জেন্টিনাকে অসাধারণ জয় এনে দেয়ার জন্য বুধবার বিশ্বের পত্রপত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিলেন মেসি, আলভারেজরা। পশ্চিমা বেশির ভাগ পত্রিকা প্রথম পৃষ্ঠায় মেসির অথবা মেসি ও আলভারেজের পূর্ণপৃষ্ঠা জুড়ে ছবি প্রকাশ করেছে। স্পেনের পত্রিকা এএস মেসিকে প্রশ্ন করেছে- ডে কুই প্লানেটা ভিনিস্তে? যার বাংলা হলো- আপনি কোন গ্রহ থেকে এসেছেন? অর্থাৎ এই শিরোনামের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, মেসি যা করেছেন তা এই গ্রহের মানুষের পক্ষে খুব কমই সম্ভব। তাই বিস্ময়ভরা প্রশ্ন নিয়ে তাদের সংবাদ শিরোনাম। গেটেটা ডেলো স্পোর্ট-এর শিরোনাম- ম্যারামেসি। কিংবদন্তি ম্যারাডোনার নামের প্রথম দুই অক্ষর এবং মেসির নাম একসঙ্গে যুক্ত করে এই শিরোনাম করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ১৯৮৬ সালে দিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে তার। অন্যদিকে কোরিয়েরে ডেলো স্পোর্টস শিরোনাম করেছে- দ্য অল্টার দিয়েগো।

 এতে আলভারেজের মাথায় হাত বুলিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মেসি ও আলভারেজের ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। টটোস্পোর্ট বর্ণনা করেছে মেসির ‘ফেয়ারি টেল’ বা মেসির রূপকথা। তাদের শিরোনাম- গ্লোরিয়া ফিনালে। মারকার শিরোনাম- লিও আহি লা টিনেস। এর অর্থ- লিও, এখন এটা তোমার কাছে। এতে তারা মেসির অসাধারণ পারফরমেন্স বর্ণনা করেছে। ব্যবহার করেছে কোরিয়েরে ডেলো স্পোর্টসের মতোই একই ছবি। স্পোর্ট-এর প্রথম পৃষ্ঠায় অন্যদের মতোই মেসি ও জুলিয়ান আলভারেজের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। শিরোনাম- আইআলা ফিনালে। অর্থ ‘ফাইনালে’ আমরা। মান্ডো ডেপোরটিভোর শিরোনাম- ম্যাকানুডোস। আর্জেন্টিনার ওলে পত্রিকার শিরোনাম- আর্জেন্টিনা ফাইনালিস্তা। ব্যবহার করা হয়েছে মেসি, আলভারেজের ছবি। এতে মেসিকে আনন্দে শূন্যে তুলে ধরেছেন আলভারেজ।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status