ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

বেহুদা প্যাঁচাল

যুগপৎ আন্দোলন, আওয়ামী লীগের সম্মেলন এবং বিএনপি শূন্য সংসদ

শামীমুল হক
১৪ ডিসেম্বর ২০২২, বুধবার
mzamin

যাদের কর্মসূচিকে ঘিরে এতকিছুর আয়োজন করা হয় তারা কি অন্যের কর্মসূচি কিংবা সম্মেলনের দিকে তাকাবে? স্বাভাবিক প্রশ্ন এটি। তারপরও কথা থেকে যায়- তুমি অধম, তাই বলে আমি উত্তম হইবো না কেন- বলে একটি কথা রয়েছে। এ কথার সমর্থনে বিএনপি’র একই দিনে কর্মসূচি না দেয়াই উত্তম ছিল। একই দিনে কর্মসূচি দিয়ে তারা নিজেকে উত্তম প্রমাণ করতে পারেনি। এখনো সময় আছে গণমিছিল কর্মসূচি পিছিয়ে দিয়ে নিজেরা প্রমাণ করতে পারে ‘আমরা উত্তম’

যত গর্জে তত বর্ষে না। সব সময়ের একটি বচন। সাম্প্রতিক সময়ে এ বচনটি মনে ঘুরপাঁক খাচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপি’র গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে সারা ঢাকায় যে প্রশাসনের রণপ্রস্তুতি, গণগ্রেপ্তার, তল্লাশি এক আতঙ্কময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ৭ই ডিসেম্বর বিএনপি অফিসে পুলিশের অভিযানের পর এগার তারিখে প্রথম বিএনপি নেতারা অফিসে প্রবেশ করেন। তারপর বেরিয়ে তারা যে অভিযোগ করেন তা ভয়াবহ।

বিজ্ঞাপন
তাদের অভিযোগ এ অফিসের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে সুনামি। আর এ সুনামির তাণ্ডবের চিহ্ন তারা দেখে এসে বর্ণনা করেছেন মিডিয়ার কাছে। মনে হয়েছে পুলিশ প্রশাসনের যত রাগ তা মিটিয়েছে অফিসের ইট, পাথর আর কাঠের সঙ্গে। বিভিন্ন নথিপত্র থেকে শুরু করে কম্পিউটার, ক্যাশবাক্স ভাঙচুর নাকি হয়েছে সেখানে। রাস্তা দখল করে সভা-সমাবেশ করলে জনদুর্ভোগ বাড়বে- এ অভিযোগে নয়াপল্টনে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি। অথচ প্রশাসন নিজেই কমপক্ষে তিন দিন ওই রাস্তা নিজেরাই ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ রেখেছে। এমনকি ওই এলাকায় বসবাসকারী লোকজনকেও নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই যে ধরপাকড়, অফিসে অভিযান- এসব করে কি সমাবেশ বন্ধ করা গেছে? হ্যাঁ, নয়াপল্টনে হয়নি, হয়েছে গোলাপবাগে। লাভের লাভ কি হয়েছে? বিএনপি’র যে মেসেজ দেয়ার তা দেয়া হয়ে গেছে। আগামী ২৪শে ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হচ্ছে। 


দুই: গোলাপবাগের সমাবেশ থেকে বিএনপি’র এমপিরা সংসদ থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন। পরদিন বিএনপি’র পাঁচ এমপি সশরীরে স্পিকারের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে তারা পদত্যাগপত্র জমা দেন। অবশ্য আগের দিন এ পদত্যাগপত্র তারা ই-মেইলে পাঠিয়েছেন বলে গণসমাবেশে জানিয়েছিলেন। যাই হোক পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার পর ওইদিনই তা গৃহীত হয় এবং স্পিকার ওই আসনগুলো শূন্য ঘোষণা করেন। পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সামনে বিএনপি’র সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেছেন, আমরা যে সংসদকে বাতিল করতে দাবি রেখেছি, সে সংসদে আমরা থাকি কি করে? ওদিকে পদত্যাগের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মন্তব্য করেন- বিএনপি’র এমপিদের পদত্যাগে সংসদ অচল হবে না। সুন্দর কথা বলেছেন ওবায়দুল কাদের। বিজ্ঞজন হিসেবে পরিচিত ওবায়দুল কাদের যে মন্তব্য করেছেন তা শতভাগ সঠিক। কিন্তু তিনি কী ভেবে দেখেছেন সংখ্যায় সাতজন হোক এ পদত্যাগ বিশ্ব দরবারে কি  মেসেজ গেল? আগামীতে সংসদ অধিবেশনে ওবায়দুল কাদের কি স্বস্তি নিয়ে বসতে পারবেন? নাকি তিনি কিংবা তার দল আগে থেকেই চেয়েছিলেন ওই সাতজন এমপি সংসদ ছেড়ে চলে গেলেই ভালো। তারা চলে গেলে নির্বিঘ্নে সংসদ চালাতে পারবেন। কেউ আর বিরোধিতা করার থাকবে না। এমনটি যদি ভেবে থাকেন তাহলে তার কথা ঠিকই আছে। কিন্তু সংখ্যায় সাতজন হলেও তারা ছিলেন সংসদের সৌন্দর্য। তাদের পদত্যাগে সংসদের সৌন্দর্য হারিয়ে গেছে বলে কি মনে হয় না? 

তিন: আগামী ২৪শে ডিসেম্বর যুগপৎ আন্দোলনের শুরু হওয়ার কথা। ওই দিন সমমনাদের নিয়ে গণমিছিল কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল বিএনপি। গোলাপবাগের গণসমাবেশে এ কর্মসূচি ঘোষণার পর সমমনা দলগুলোও এর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বিবৃতি দেয়। সমস্যা হলো- ওই দিন রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এ সম্মেলনের ঘোষণা আগে থেকেই দেয়া। অন্যদিকে একই দিনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর গণমিছিল কর্মসূচি ঘোষণা করা কি যৌক্তিক? দু’টি বৃহৎ দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিস্থিতি কি ঘোলাটে করবে না? ওই দিন সারা দেশ থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাদের সম্মেলনে হাজির হবেন। রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে মিছিল নিয়ে তারা হাজির হবেন সম্মেলন ময়দানে। অন্যদিকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো তাদের গণমিছিল কর্মসূচি নিয়ে হাজির থাকবেন রাজপথে। ফলে অনিবার্য সংঘাতের আশঙ্কা করা কি অমূলক হবে? 

এমন সব নানা প্রশ্নের মুখে সোমবার রাতে বিএনপি তাদের নীতিনির্ধারণী এক বৈঠকে ২৪শে ডিসেম্বর গণমিছিল কর্মসূচি পেছানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী তারিখ ঘোষণা করবে তারা। বিএনপির এ উদারতা রাজনীতির জন্য এক দৃষ্টান্ত।
চার: দেশবাসী দেখেছে বিএনপি’র বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে প্রতি পদে পদে বাধা দেয়া হয়েছে। পরিবহন ধর্মঘট, লঞ্চ ধর্মঘট ডেকে এমন এক পরিস্থিতি করা হয়েছে যাতে বিএনপি’র গণসমাবেশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। তারপরও মানুষজন এসেছে। তিন দিন আগে এসে বিভাগীয় সমাবেশস্থলে অবস্থান নিয়েছে। চিঁড়া, গুড় নিয়ে এসে তা খেয়েছে। আবার কেউ কেউ জনসভার মাঠে খিচুড়ি রান্না করে সবাইকে নিয়ে খেয়েছে। তারপরও তারা সমাবেশ করেছে। ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে কি হয়েছে তার বর্ণনা এখনো পাওয়া যাচ্ছে। সবই করা হয়েছে বিএনপি’র গণসমাবেশ যেন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন না হয়। বিএনপি নেতারা এমনটিই অভিযোগ করে আসছেন। এমনকি ১০ই ডিসেম্বর গোলাপবাগের সমাবেশেও এ অভিযোগ করা হয়েছে। ওই সমাবেশের প্রধান অতিথি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গভীর রাতে নিজ বাড়ি থেকে তুলে আনা হয়। পরদিন ডিবি’র পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের গ্রেপ্তার কিংবা আটক করা হয়নি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছে। কিন্তু পরে দেখা গেল মির্জা ফখরুল ও বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তার মানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাহলে কেন সকালে তাদের গ্রেপ্তার কিংবা আটক করা হয়নি- এমন বক্তব্য দেয়া হলো? এসব কেন করা হয়েছে? এর উত্তর সবারই জানা। যাদের কর্মসূচিকে ঘিরে এতকিছুর আয়োজন করা হয় তারা কি অন্যের কর্মসূচি কিংবা সম্মেলনের দিকে তাকাবে? স্বাভাবিক প্রশ্ন এটি। তারপরও কথা থেকে যায়- তুমি অধম, তাই বলে আমি উত্তম হইবো না কেন- বলে একটি কথা রয়েছে। এ কথার সমর্থনে বিএনপি’র একই দিনে কর্মসূচি না দেয়াই উত্তম ছিল। একই দিনে কর্মসূচি দিয়ে তারা নিজেকে উত্তম প্রমাণ করতে পারেনি। এখনো সময় আছে গণমিছিল কর্মসূচি পিছিয়ে দিয়ে নিজেরা প্রমাণ করতে পারে ‘আমরা উত্তম’। 

পাঁচ: বাংলাদেশে রাজনৈতিক শিষ্টাচার বলে কিছু আছে- এমনটা কখনোই মনে হয়নি। সরকারে যারা থাকেন তারা সবসময়ই বিরোধীদের পাত্তা দেন না। আবার বিরোধীরা কখনোই সরকারের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন না। অবশ্য সরকার সহযোগিতা চেয়েছে এমনটিও দেখা যায়নি। এখানে কে কাকে কীভাবে ঘায়েল করতে পারবে সে চিন্তায় সময় পার করে। কূটচালই যেন রাজনীতির অলংকার। অথচ রাজনীতি কেন করা হয়? উত্তর একটাই দেশ ও দেশের মানুষের জন্য। দেশের উন্নয়ন। দেশের মানুষ যেন ভালো থাকে সেই চেষ্টা করা। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি দেশ ও দেশের মানুষের মঙ্গলের চেয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার প্রয়াস থাকে বেশি। আর তা করতে গিয়ে রাজনীতির প্রতি মানুষের আগ্রহ দিন দিন দূরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দিকে তাকালে কি দেখা যায়? সরকার আর বিরোধী দল গলায় গলায় মিলে দেশের জন্য কাজ করে। দেশের মানুষের জন্য কাজ করে। দেশের কোনো ক্রান্তিকালে হাতে হাত ধরে এক টেবিলে বসে সমাধান খোঁজে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন সমস্যা সমাধানে আলোচনা চালিয়ে যায়। বাংলাদেশে তা একেবারেই অকল্পনীয়। এ ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখা যায় কোনো ব্যর্থতার জন্য কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করছেন। আবার নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ হচ্ছেন। তিনিও কোনো কারণে মানুষের মন জয়ে ব্যর্থ হলে পদত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে বৃটেন এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। অথচ এই বৃটিশরাই আমাদের শাসন করেছে প্রায় দুইশ’ বছর। বৃটিশের করা বেশির ভাগ আইনেই চলছে এখনো দেশ। অথচ বৃটিশদের উদার রাজনীতি আমরা গ্রহণ করতে পারছি না। ক্ষমতা যে তুচ্ছ, সে বিষয়টি আমরা মনে লালন করি না। ধারণ করি না। আমরা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত। তবুও ক্ষমতা ছাড়া যাবে না। বরং ক্ষমতায় থাকতে যত কৌশল আছে তা রপ্ত করতে ব্যস্ত। কথার লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করতে ছাড়ি না। তাই মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগেÑ এজন্যই কী দেশ স্বাধীন করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু জেল জীবনকে সঙ্গী করেই হাঁটতেন। মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিয়েছেন আমরা পারি। বিশ্বের দরবারে বঙ্গবন্ধু মহান নেতা। যে নেতার সঙ্গে তুলনা চলে না কারও। আজ বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে দেশের রাজনীতির বর্তমান অবস্থা দেখলে নিজেই হয়তো লজ্জা পেতেন।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status