নির্বাচিত কলাম
সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ
রাজনৈতিক বিরোধেও ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা সমর্থন এখানে বিভাজন সৃষ্টি করে না
এম জাকির হোসেন খান
১৩ ডিসেম্বর ২০২২, মঙ্গলবার
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো বুঝতে পারে, চীনের অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিপরীতে দিল্লি সামান্য ভূমিকা রাখতে পারছে। ফলে, এ অঞ্চলে চীন একক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে ভারতনির্ভরতার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র এবং সহযোগী দেশগুলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সরাসরি এনগেজড হতে শুরু করে। দিল্লি ও ঢাকার ক্ষমতাসীন দলের রাশিয়ামুখিতার কারণে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শাপেবর হয়েছে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতিকদের জন্য। আর ঐতিহাসিকভাবে দিল্লির সব আম এক ঝুড়িতে (আওয়ামী লীগ) রাখার পরিণতিতে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বা অন্যান্য দল ন্যাটোভুক্ত দেশের সঙ্গে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ফাংশনাল সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশ বিষয়ে বর্তমানে ন্যাটোভুক্ত দেশ এবং জাতিসংঘ এর অবস্থান এটার প্রতিফলন ঘটছে। এ চাপ আরও বাড়বে, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিতে চীনের প্রভাব ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে এলে রাজনৈতিক চাপ আরও বাড়বে
বাংলাদেশে অতি ভালো বা খারাপ কোনোটাই টিকে না, এ সমাজ কখনো স্থায়ীভাবে বিভক্ত হয়নি, যারা সেটা করতে চেয়েছে তারাই সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। এদেশের মানুষের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যই হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক। এখানে যতই রাজনৈতিক বিরোধ থাকুক আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল সমর্থনে রাজনীতি কোনো বিভাজন তৈরি করতে পারে না। ২০১৩-১৪ সালে যে পরিমাণ বিরোধী রাজনীতিক হত্যাকাণ্ড বা নির্যাতনের শিকার হয়েছে তারপরও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে মাওবাদী বা তালেবান হয়ে যায়নি।

বৃটিশ বা পাকিস্তান সময়কালে বাংলাদেশে বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করলেও শাসকগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের কাছ থেকেই। বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ, স্থল যোগাযোগ বাড়ানো সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরশাদ সরকারের সময়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও ক্ষমতা চিরস্থায়ী হয়নি। রাষ্ট্র পরিচালনায় সুচিন্তার পরিবর্তে অনবরত পেশী শক্তিনির্ভর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সাময়িক সাফল্য পেয়ে তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে একের পর এক অযৌক্তিক পদক্ষেপের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে ভুলের ফাঁদে পড়ে অনিবার্য পতনের দিকে এগিয়ে যায়। যেকোনো কর্তৃত্ববাদী শাসনের পরিণতি শুধু সে গোষ্ঠী বা দলকে না বরং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ায়। ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া সহ আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশ তার অন্যতম উদাহরণ।
সম্পদ ও ক্ষমতা যদি স্থায়ী হতো তাহলে পৃথিবীর সব ক্ষমতাবান ও তাদের উত্তরসূরিরাই একমাত্র রাষ্ট্র চালাতো। বৈশ্বিক গভর্নেন্স যেমনÑ জাতিসংঘ, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত সহ অনেক পরিপূরক প্রতিষ্ঠান ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর করায়ত্ত থাকায় এবং বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় অর্থনৈতিক বা সামরিক শক্তির বলে গড়ে ওঠা চীন-রাশিয়া জুটি কোনো দেশকে রাজনৌতিক বা সামরিক সমর্থনের মাধ্যমে সাময়িক সুবিধা প্রদান করলেও ক্ষমতায় থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারে না বা সুরক্ষাও দিতে পারে না। ফলে দিল্লির প্রভাবমুক্ত হতে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের সমর্থনে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে পারেনি শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তান, মালদ্বীপের শাসকগোষ্ঠী। একসময়ের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর সরকার ক্রমেই পতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা আছে?
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় চীন-রাশিয়ার সর্বশেষ কৌশলগত দেশ, এখানে প্রভাব হারালে শুধু এ অঞ্চল না এশিয়াতেই প্রভাব হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে। তাই যেকোনো মূল্যে তাদের প্রভাব ধরে রাখতে চাইলেও বাস্তবে, রেজিমেন্টেড চিন্তা দিয়ে গণতান্ত্রিক সমাজকে প্রভাবিত করা সম্ভব না। সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখার মাধ্যমে প্রভাব ধরে রাখার পরিবর্তে একটা গোষ্ঠীকে সাময়িক সুবিধা প্রধানের মাধ্যমে পুরো সম্পদ করায়ত্ত করার একমুখী (এক ঝুড়িতে সব আম) নীতির কারণে চীন স্থায়ীভাবে কোনো সরকারকেই প্রটেকশন দিতে সক্ষম হয় না। সর্বশেষ তিস্তা চুক্তির মাধ্যমে চীন বাংলাদেশে তাদের কৌশলগত বা বাণিজ্যিক সুবিধা অর্জনকেই সুসংহত করতে সচেষ্ট।
সমুদ্র তীরবর্তী দেশ হওয়ায় ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের মানুষ বৈশ্বিকভাবে অনেক বেশি কানেক্টেড ছিল এবং বর্তমানে সেটা আরও বেড়েছে। তাছাড়া, ঔপনিবেশিক সময় থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংযোগ যতটা জোরালো চীনের সঙ্গে শুধু বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। একজন রাজনীতিক, আমলা বা বুদ্ধিজীবী যতই ‘সুবিধা’ চীনের কাছ থেকে গ্রহণ করুন সন্তানকে পড়ানোর জন্য বা সেকেন্ড হোম বা সেটেল্ড করার জন্য পাশ্চাত্য দেশগুলো অগ্রাধিকার পায়। সেজন্যই বেগমপাড়া হংকং বা সাংহাইয়ে না হয়ে কানাডায় গড়ে ওঠে। সিংগাপুর বা দুবাই অবৈধ অর্থের বিনিয়োগ কেন্দ্র হলেও বসবাস বা পাচারের জন্য পাশ্চাত্য এর দেশগুলো প্রধান লক্ষ্য। ঔপনিবেশিক মানসিকতার কারণেই চীনের একনিষ্ঠ সমর্থক বাংলাদেশি অনেক বিশ্লেষক পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে বসবাস করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন। এসব দেশকে পছন্দ করার ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষার পাশাপাশি চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাও অন্যতম কারণ। তাই চীন যতই আর্থিক বিনিয়োগ করুক ‘অপরচুনিস্টিক’ নীতির কারণে বাংলাদেশের সরকারকে এককভাবে ক্ষমতায় রাখার ঝুঁকি নেবে বলে মনে হয় না।
অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করলেও তা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। রাশিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সহ বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ ভারতে সঙ্গে সমন্বিত করে চালাচ্ছে। এ অঞ্চলে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে রাশিয়া। তাই বাংলাদেশ বিষয়ে তাদের অবস্থান আগ্রাসী হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশের বিষয়ে দিল্লির অবস্থান কি? ভারত-চীন-রাশিয়া ত্রয়ী ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অব্যাহতভাবে ক্ষমতায় রাখার যে সমন্বিত সমীকরণ তৈরি করেছিল তা মূলত: নষ্ট হতে শুরু করে ২০১৮ এর নির্বাচনে চীনের একক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কারণে। যদিও ভারতের বৃহৎ কর্পোরেট আদানি, রিলায়েন্স এনার্জি খাতে বড় বড় ব্যবসা ভাগাতে সক্ষম হয়েছে কিন্তু কৌশলগতভাবে পিছিয়ে পড়ে। বাংলাদেশে চীনের অর্থায়নে ট্রানজিটের অবকাঠামো নির্মাণ যেমন পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভারত ব্যাপক অর্থনৈতিক সুবিধা পেলেও গত কয়েক বছরে চীনের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কৌশলগত সুবিধা প্রদান করায় বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিয়েও খুব একটা লাভ হয়নি। উল্টো তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের (যদিও তিস্তা চুক্তি না হওয়ার পেছনে প্রধান ব্যর্থতা দিল্লির) মাধ্যমে চীন এককভাবে যে কৌশলগত সুবিধা অর্জন করতে চাইছে তাতে দিল্লির ভূ-রাজনীতির লিভারেজের জায়গায় সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থায় পড়েছে। বর্তমান প্রেক্ষিতে না পারছে এখানকার ক্ষমতাসীন সরকারকে একচেটিয়া সমর্থন দিতে, না পারছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক পুনস্থাপনে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষিতে কোয়াডের সদস্য হয়েও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের পাশাপাশি মানবাধিকার বিষয়ে মোদি সরকার পাশ্চাত্য দেশগুলোর চাপে থাকায় বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে এতদিনকার ভারতকেন্দ্রিক যে সমঝোতা ছিল তাও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান দিল্লি বিরোধী মনোভাবকে ক্রমাগত অবজ্ঞা করলে একমসয়ের নেপালের মতো ভারতের সব অর্জন যে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে সেটাও আমলে নিয়েই বিভিন্ন মন্তব্যের মাধ্যমে ভারতীয় হাইকমিশনার বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ভারত বাংলাদেশে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সমর্থনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির ঝুঁকি নেবে না। বরং বাংলাদেশে গত ১৪ বছরে দিল্লি যা অর্জন করেছে সেটা সুসংহত করতে নীরবে রাজনৈতিক ও সামরিক সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণকেই অগ্রাধিকার দেবে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো বুঝতে পারে, চীনের অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিপরীতে দিল্লি সামান্য ভূমিকা রাখতে পারছে। ফলে, এ অঞ্চলে চীন একক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে ভারতনির্ভরতার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র এবং সহযোগী দেশগুলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সরাসরি এনগেজড হতে শুরু করে। দিল্লি ও ঢাকার ক্ষমতাসীন দলের রাশিয়ামুখিতার কারণে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শাপেবর হয়েছে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতিকদের জন্য। আর ঐতিহাসিকভাবে দিল্লির সব আম এক ঝুড়িতে (আওয়ামী লীগ) রাখার পরিণতিতে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বা অন্যান্য দল ন্যাটোভুক্ত দেশের সঙ্গে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ফাংশনাল সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশ বিষয়ে বর্তমানে ন্যাটোভুক্ত দেশ এবং জাতিসংঘ এর অবস্থান এটার প্রতিফলন ঘটছে। এ চাপ আরও বাড়বে, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিতে চীনের প্রভাব ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে এলে রাজনৈতিক চাপ আরও বাড়বে। যদি বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষমতাসীন দল রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ধরে রাখতে চায় তাহলে সে সক্ষমতা নেই। চীন যদি ৯-১০ বিলিয়ন ডলার দেয় তা প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য হবে। তাই বাস্তবতা হলো, রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া ক্ষমতায় থাকার সুযোগ সীমিত।
এ দেশের মানুষের নৃতাত্ত্বি¡ক বৈশিষ্ট্যই হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক। এখানে যতই রাজনৈতিক বিরোধ থাকুক আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল সমর্থনে রাজনীতি কোনো বিভাজন তৈরি করতে পারে না। এ দেশের মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমেই শুধু বশ্যতায় আনা যায়, হুমকি- ধমকি বা কূটকৌশল দিয়ে বশে রাখতে পারে না। ভালোবেসে সে নিঃস্ব হয়ে যাবে, কিন্তু কেউ জোর করলে প্রতিবাদ করে। আর ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক ট্রাম্পকার্ড সবগুলো খেলে ফেলেছে, নিষ্পেষণের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকতে চাইলে তার পরিণতিতে স্থায়ী সংঘাতের পথ উন্মুক্ত হতে পারে।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ
(লেখকের নিজস্ব মতামত, কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়)