নির্বাচিত কলাম
সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ
বিশ্ব নাচানো মহাকাব্যে শত্রুতা রাজনীতি ও যুদ্ধ
মোহাম্মদ আবুল হোসেন
৭ ডিসেম্বর ২০২২, বুধবারবিশ্বকাপ ফুটবল। বিশ্ব নাচানো এক মহাকাব্য। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ নেই। সবাইকে একসুতোয় গেঁথেছে সৃষ্টিজগতে সবচেয়ে সৌন্দর্যের এই খেলা। শত শত কোটি মানুষ একটি মাস টিভি পর্দায় আঠার মতো লেগে আছেন। পাছে কোনো একটি ইভেন্ট মিস হয়ে যায়। একটি নান্দনিক গোল দৃশ্য মিস হয়ে যায়! হোক সেটা আর্জেন্টিনার সুপারস্টার লিওনেল মেসি, ব্রাজিলের নেইমার জুনিয়র, রিচার্লিসন বা পর্তুগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর। টাটকা গোল দেখার মজাই আলাদা। বাসি হওয়া হাইলাইটসে দেখা যায় খেলা। কিন্তু তাতে টাটকা স্বাদ থাকে না।
নিষিদ্ধ থাকলেও চলমান বিশ্বকাপে বিশ্বের অনেক কণ্টকিত ইভেন্ট উঠে এসেছে। বিভিন্ন দেশ, তাদের বিরোধ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ইস্যু যুক্ত হয়েছে। বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র কয়েকদিন আগে নভেম্বরের শুরুর দিকে ফিফা কর্মকর্তারা সব ফুটবল টিমের কাছে অনুরোধ জানিয়ে একটি চিঠি লিখেছেন। তাতে ফুটবলকেই সেন্টার স্টেজে রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে। অর্থাৎ, ফুটবলকে ফুটবলের জায়গায় রাখার কথা বলা হয়েছে। এর সঙ্গে রাজনীতি, জাতিভেদ, সহিংসতা সহ বিভিন্ন বিতর্কিত ইস্যু জড়িয়ে না ফেলার আহ্বান জানানো হয়। ফুটবল বিশ্বকাপ শুরুর আগে কাতারের মানবাধিকার নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছে পশ্চিমা দেশসহ বিভিন্ন দেশ। তাদের অভিযোগ, কাতার বিশ্বকাপের স্টেডিয়াম বানাতে গিয়ে বহু অভিবাসী শ্রমিক মারা গেছেন। তাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করা হয়েছে। রাখা হয়েছে মানবেতর অবস্থায়। এ ছাড়া এলজিবিটিকিউ বা সমকামী ইস্যুতে কঠোরতা আরোপ করেছে কাতার। এর সমালোচনায় মুখর পশ্চিমা বিশ্ব।
উদ্বোধনী ম্যাচের প্রাক্কালে এসব সমালোচনার বিরুদ্ধে এক ঘণ্টার ক্ষোভ ঝেরে বক্তব্য রাখেন ফিফা সভাপতি গিয়ান্নি ইনফান্তিনো। আয়োজকরা ফুটবলকে ‘সেন্টার স্টেজে’ রাখার যে আহ্বান জানায়, তা ফুটবলভক্তদের কাছে এক এক রকম অর্থ প্রকাশ করে। কাতার বিশ্বকাপে যোগ দেয়া ইরানিদের সবাই না হলেও তাদের অনেকে নিজেদের দেশে নৈতিকতা বিষয়ক পুলিশের হাতে মাহশা আমিনি নামের ২২ বছর বয়সী যুবতী হত্যার প্রতিবাদ করার পক্ষে শামিল হয়। তাদের প্রত্যাশা বিশ্বকাপে যোগ দেয়া ইরানি টিমও একই কাজ করবে। এক্ষেত্রে তারা ভূমিকাও রেখেছে। ফলে ইরানি টিমের সদস্যদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বোদ্ধারা। তারা দেশে ফিরে গেলে কি আচরণ করা হবে, তা কেউ বলতে পারেন না। এ ছাড়া অন্য রাজনৈতিক ইস্যু প্রায়দিনই দ্রুত এবং ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বকাপের আবহের বাইরে বিভিন্ন খণ্ডিত ঘটনার মধ্যে বাঁক নিয়েছে বিশ্ব। তার মধ্যে কোনো কোনো ঘটনা বিস্ময়কর। কোনোটি অপরিহার্য। এর মধ্যে আছে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন।
যুক্তরাষ্ট্রে গুলি করে মানুষ হত্যা। করোনা মহামারির প্রেক্ষিতে দেয়া লকডাউনের প্রতিবাদে চীনে আকস্মিক প্রতিবাদ বিক্ষোভ। চীন সরকারের বিরুদ্ধে এমন প্রতিবাদ বিরল। খেলাধুলার উৎসাহকে সামনে নিয়ে ইংলিশ উপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও সমালোচক জর্জ অরওয়েল লিখেছিলেন- যখন জনগণ বলাবলি করে যে, বিভিন্ন দেশের মধ্যে সৌহার্দ্য সৃষ্টি করে স্পোর্টস, তখন আমি বিস্মিত হই। যদি বিশ্বের সাধারণ মানুষগুলো ফুটবল বা ক্রিকেটে একে অন্যের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পায়, তাহলে তাদের আর যুদ্ধক্ষেত্রে মুখোমুখি হওয়ার আগ্রহ থাকবে না। ২০১৮ সালে বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল রাশিয়া। কিন্তু তারা বিশ্ব জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়েছে। এ কারণে রাশিয়া ও এর নেতাদের রাখা হয়েছে একঘরে করে। তাই এবারের বিশ্বকাপে নিষিদ্ধ হয়েছে রাশিয়া। অন্যদিকে বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের শেষ বাধায় পড়ে ইউক্রেন।
দল যখন এমন প্রতিবন্ধকতার মুখে, তখন দেশের ভেতরে যেসব আতঙ্কিত মানুষ বেঁচে আছেন, তাদের মধ্যে আরও ভয়। আরও ভীতি বোমা হামলার। তারা বিদ্যুৎ ও পানি ছাড়া কীভাবে বেঁচে থাকবেন- তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মুখে। এখানে তাদের জীবন বাঁচানোই কঠিন হয়ে উঠেছে। ফলে কাতার বিশ্বকাপে কি হচ্ছে সেই দৃশ্য দেখা বা জানার চেয়ে তাদের কাছে কঠিন হয়ে উঠেছে নিজেদের জীবন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে দশকের পর দশক ধরে চলছে শত্রুতা। এমনই এক প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার অতি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে মুখোমুখি হয় এই দুই দেশ। যুদ্ধক্ষেত্রের যুদ্ধ যেন এদিন ফুটবল মাঠে নেমে এসেছিল। এই যুদ্ধে কোনো অস্ত্র নেই। ছিল শুধু কৌশল, দক্ষতা আর বুদ্ধির পরীক্ষা। তাতে ইরান হেরে গেছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও রাজনীতি এসে ভর করেছে। দুই দেশের শত্রুতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস সকার ফেডারেশন সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ইরানের জাতীয় পতাকা প্রদর্শন করেছে। কিন্তু তা থেকে মুছে দেয়া হয় ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ বা ইসলামিক প্রজাতন্ত্র শব্দ দুটি। বলা হয়, ইরানের ভেতরে যারা প্রতিবাদ বিক্ষোভ করছেন, তাদের প্রতি সমর্থন দিতে এ পদক্ষেপ নিয়েছে তারা।
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়েছে ইরান সরকার। তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনার বাণ নিক্ষেপ করে। ইরান বলেছে, তাদের জাতীয় পতাকা থেকে আল্লাহর নাম মুছে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শতাব্দী ধরে চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ। এর মধ্যে ফিলিস্তিনের যে ভূমি দখল করেছে ইসরাইল, তা নিজেদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায় ফিলিস্তিনিরা। এই যুদ্ধ, এই শত্রুতা উঠে এসেছে কাতার বিশ্বকাপে। অথচ এই বিশ্বকাপে ফিলিস্তিন বা ইসরাইল কোনো দেশই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে না। বিশ্বকাপে ফিলিস্তিনের পতাকা এবং ফিলিস্তিনপন্থি ভক্তদের সংখ্যা ছিল বেশি। অন্যদিকে আরব দেশগুলোতে ইসরাইলি মিডিয়া ও তাদের ভক্তদের কমই স্বাগত জানানো হয়। বিশেষ করে যেসব আরব দেশ ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেনি, তারা তো নয়ই।
রোববার উচ্চ র্যাংকিংয়ের বেলজিয়ামকে হারিয়ে বিশ্বকাপে বিখ্যাত বিজয় অর্জন করে মরক্কো। এ কষ্ট সহ্য করতে পারেননি বেলজিয়ামের সাধারণ জনগণ। তারা সঙ্গে সঙ্গে দেশের ভেতরে বিভিন্ন শহরে অসন্তোষ সৃষ্টি করেন। নেদারল্যান্ডসেও একই অবস্থা। এসব দেশে দীর্ঘদিন ধরে একপেশে করে রাখা হয়েছে উত্তর আফ্রিকার অভিবাসী সম্প্রদায়কে। দাঙ্গাকারীদের বিষয়ে ব্রাসেলসের মেয়র বলেছেন- দাঙ্গাকারীরা ফুটবলের ভক্ত নন। তারা দাঙ্গাকারী। মরক্কোর ভক্তরা সেলিব্রেট করছিলেন। তাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। কাতার বিশ্বকাপে নিষিদ্ধ থাকলেও উঠে এসেছে এলজিবিটিকিউ অধিকার। সেখানকার মানবাধিকার রেকর্ড রয়েছে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে। আইন করা হয়েছে সমকামিতাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে। অন্যদিকে বিশ্বকাপ থেকে আউট হয়ে যাওয়া জার্মানি খেলার মাঠে অভিনব প্রতিবাদ প্রকাশ করেছে। তাদের বাহুতে ‘ওয়ান লাভ’ আর্মব্যান্ড নিষিদ্ধ করেছে ফিফা’র পরিচালনা পরিষদ। এর প্রতিবাদে জার্মান টিম তাদের উদ্বোধনী ম্যাচের আগে টিম হিসেবে যে ছবি তুলেছে, তাতে খেলোয়াড়দের সবারই মুখ ঢাকা। আর্মব্যান্ড হিসেবে যে রঙধনু রং ব্যবহার করা হয়, তা হলো এলজিবিটিকিউ অধিকারের একটি প্রতীক।
অন্য ইস্যুর মতোই এটাকে কাতার বিশ্বকাপে গুরুত্বপূর্ণ এক বিতর্কিত ইস্যু হিসেবে দেখা হয়। ইউরোপের অনেক কর্মকর্তা এই রঙের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বিশ্বকাপে ‘ওয়ান লাভ’ আর্মব্যান্ড নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ জার্মানি যেভাবে দিয়েছে, তার পাল্টা জবাব দিয়েছেন কাতারের ফুটবল ভক্তরা। তারাও নিজেদের মুখ ঢেকে জার্মানির সাবেক তারকা খেলোয়াড় মেসুত ওজিলের ছবি প্রদর্শন করেছেন। মেসুত ওজিল তুর্কি বংশোদ্ভূত একজন জার্মান। ২০১৮ সালে বিশ্বকাপ থেকে আগেভাগেই ছিটকে পড়ে জার্মানি। এর জন্য তাকে বর্ণবাদের টার্গেট হিসেবে বেছে নেয়া হয়। জার্মানির ওই পরাজয়ের জন্য তাকে বানানো হয় বলির পাঁঠা। এরপরই জার্মানির জাতীয় দল থেকে পদত্যাগ করেন মেসুত ওজিল। তখন তিনি বলেছিলেন, যখন আমরা বিজয়ী হই, তখন আমাকে জার্মান হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু যখন আমরা ম্যাচে হেরে যাই তখন আমাকে দেখা হয় একজন অভিবাসী হিসেবে।
বিশ্বকাপ হিসেবে এই টুর্নামেন্ট, বিগত সময়ের বিশ্বকাপ ও অলিম্পিক আয়োজন এটা দেখিয়েছে যে, শুভবুদ্ধির উদয় অসম্ভব। এ কথা বিশেষভাবে সত্য একটি অতিমাত্রায় সংযুক্ত বিশ্বে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, প্রতিটি উদ্যাপন অথবা প্রতিটি হতাশার বহিঃপ্রকাশ বিস্তৃত হয় বৈশ্বিক পর্যায়ে। যখন এসব ম্যাচ দেখা হয় এবং দেশগুলোর স্নায়ু সংবেদনশীলতা কাপড় শুকানো মেশিনের মতো অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়- তখন ফুটবল আসলেই সেন্টার স্টেজ দাবি করতে পারে। কিন্তু প্রতিদিন যেসব জটিল ইস্যু সামনে আসছে, তা কখনো পিছু ছাড়ে না। সব সময়ই এসব ইস্যু বিস্ফোরিত হয়ে আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রস্তুত থাকে। যখন ফুটবল শুরু হয়, তখন বাকি বিশ্বের সমস্যাগুলোর শেষ হয় না। (তথ্য সূত্র: ইন্টারনেট)