নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
১৬ কোটি মানুষ! হোসেন জিল্লুরের আক্কাস আলীরা হিসাবে থাকেন তো?
তারিক চয়ন
৫ ডিসেম্বর ২০২২, সোমবারবিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি জরিপ বলছে, বাংলাদেশের প্রায় ৮ থেকে ১০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার। সুতরাং, বিবিএস’র জনশুমারির প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ধরলে, ১ কোটি ২৮ লাখ থেকে ১ কোটি ৬০ লাখ পর্যন্ত মানুষ কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার, যা দুই সরকারি সংস্থা- বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবের কয়েকগুণ বেশি! প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সত্যিকার উন্নয়ন চাইলে সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের গণনার আওতায় আনতে হবে
৩রা ডিসেম্বর ছিল জাতিসংঘ ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’। ১৯৯২ সাল থেকে শুরু ধরলে এবারেরটি ছিল ৩১তম ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’। সেইসঙ্গে ওই তারিখটি ২৪তম ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস’ও ছিল বটে। প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাদের বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।’ পৃথক বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষ গুণের অধিকারী প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সার্বিক সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়।’
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সেগুলোর বাস্তবায়ন করতে হলে তাদের সঠিক হিসাব থাকাটা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু, ভাবতে অবাক লাগে যে, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ’ বলা হলেও তাদের প্রকৃত সংখ্যাটি পর্যন্ত সরকারিভাবে সঠিকভাবে নিরুপণ করা হয়নি! বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ২৩ লাখ ৬১ হাজার ৬০৪। আর, সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ২৯ লাখ ৪৩ হাজার ৫৩০। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং সমাজসেবা অধিদপ্তর, দুটোই সরকারি সংস্থা। কিন্তু, এই দুই সংস্থার হিসাবে দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংখ্যায় ৫ লাখ ৮১ হাজার ৯২৬ জনের তফাত দেখা যাচ্ছে।
দেশের সরকারি সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যান না হয় বাদ দিলাম। এবার দেখি, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কী বলছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, বিশ্বে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা এক বিলিয়নেরও (১০০ কোটি) বেশি, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ। ওই ১০০ কোটির মধ্যে ৭৮ কোটি ৫০ লাখের বয়স ১৫ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ তারা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অংশ। আর, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বিশ্বের বৃহত্তম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এবং এই জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮০ শতাংশ (বাংলাদেশের মতো) উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বসবাস করে।
সবমিলিয়ে বোঝাই যাচ্ছে, দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একটা বড় অংশ হিসাবের বাইরেই রয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি হয়তো নাড়া দিয়েছে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারপার্সন ড. হোসেন জিল্লুর রহমানকেও। আর সেজন্যই তিনি বুঝি ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত প্রতিবন্ধী আক্কাস আলীর সঙ্গে নিজের একটি পুরনো ছবি (প্রতিবন্ধী দিবসে) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করে লিখেছেন, ‘বাইনজুরী, বরমা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রামের আক্কাস আলী। প্রতিবন্ধী। কিন্তু এই পরিচয়ে থেমে থাকেনি। ভ্যানে সওদা ফেরি করে স্বাবলম্বী থাকার চেষ্টা। একটু সহানুভূতি, একটু সহমর্মিতা- এটুকুই চাওয়া। আজ আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে ওর কথা মনে পড়লো। গত ১লা নভেম্বর হঠাৎ দেখা। কতো আক্কাস আলী যে ছড়িয়ে আছে গ্রামে, শহরে! এসব ভাই ও বোনের কথা মনে জাগ্রত রাখা দরকার। সঠিক সেবা, সঠিক সহায়তা পেলে প্রতিবন্ধীরা সমাজকে বহু কিছু দিতে পারে। সমাজও মানবিকতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।’
হোসেন জিল্লুর রহমান ঠিকই বলেছেন, ‘কতো আক্কাস আলী যে ছড়িয়ে আছে গ্রামে, শহরে!’ কিন্তু, সব আক্কাস আলীরা হিসাবের মধ্যে নেই। পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) হয়তো সব আক্কাস আলীকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে অথবা খোঁজার চেষ্টাই করেনি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পরিসংখ্যান ব্যবস্থা চালু থাকলেও সেগুলোতে প্রায়ই ভুল-ত্রুটি পরিলক্ষিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৪ সালে পূর্ববর্তী বৃহত্তর চারটি পরিসংখ্যান সংস্থার (পরিসংখ্যান ব্যুরো, কৃষি পরিসংখ্যান ব্যুরো, কৃষি শুমারি কমিশন এবং আদমশুমারি কমিশন) অবলুপ্তি ঘটিয়ে ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু, প্রতিষ্ঠার প্রায় ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও বড় ধরনের ভুল-ত্রুটি থেকে বিবিএস নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি। বিবিএস’র ওপর জনমনে আস্থা এতটাই কম যে, এ বছর প্রকাশিত তাদের জনশুমারির ‘সত্যতা’ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) স্বাধীনভাবে যাচাই করবে জানিয়ে স্বয়ং পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গেল অক্টোবরে শুমারি পরবর্তী যাচাই (পিইসি) জরিপের তথ্য সংগ্রহকারী, সুপারভাইজার ও সুপারভাইজিং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘জরিপ পরিচালনা কার্যক্রম নিয়ে বিবিএস সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন ছিল। এটাকে চূড়ান্ত মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার একটা প্রচেষ্টা আমাদের আছে। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে আমিও চাই তারা যেন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। কোনোভাবে যেন কোনো মহল থেকে কিছু না আসে।’ উল্লেখ্য, বিবিএস পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনেই কাজ করে থাকে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংখ্যার মতোই দেশের জনসংখ্যা নিয়ে বিবিএস’র হিসাব নিয়ে চলতি বছর দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বিবিএস’র ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ প্রাথমিক প্রতিবেদন’ এর তথ্য অনুযায়ী দেশে জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। বিবিএস ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ করে এবং দ্রুততম সময়ে (শুমারি পরবর্তী এক মাসের মধ্যেই) গত ২৭শে জুলাই উক্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। দেশের জনসংখ্যা এখন সাড়ে ১৬ কোটি, এমন তথ্য প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সব জায়গায় এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। সমালোচনাকারীদের যুক্তিগুলোও অকাট্য। যেমন: দেশের জনসংখ্যা যে ১৬ কোটি তা অনেক বছর আগে থেকে শোনা যাচ্ছিল, তাহলে এত বছরে জনসংখ্যা কি বাড়েনি? বিভিন্ন সভা-সমাবেশে, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বক্তব্য-বিবৃতিতে, সংবাদ-বিশ্লেষণেও এতদিন অনেকে বলেছেন- দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি বা ১৮ কোটি, সেক্ষেত্রে জনসংখ্যা কি বাড়েনি, বরং কমেছে? অনেকেই দাবি করেছেন, তাদের কাছে কোনো গণনাকারী যাননি, তাহলে তাদের হিসাবটা কোথায় গেল? অবশ্য পরিকল্পনামন্ত্রী নিজেও বলেছেন, ‘সাত দিনব্যাপী চলা এই কর্মযজ্ঞে অনেকের মধ্যে দায়িত্বহীনতা পরিলক্ষিত হয়েছে। এ কারণে অনেকে গণনা থেকে বাদ পড়েছেন।’ এবারের মানুষ গণনার কাজে অবহেলা হয়েছে বলেও তিনি স্বীকার করেন (সূত্র: প্রথম আলো)।
সমালোচনাকারীদের অনেকেই আবার প্রশ্ন তুলেছেন, মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে দেখানোর জন্যই কি জনসংখ্যা কমিয়ে দেখানো হয়েছে? নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাও এমন প্রশ্ন করেছিলেন। গত ২রা আগস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় মান্না জানান তার নিজের কাছেও জনশুমারির লোক যায়নি। তিনি বলেন, ‘তারা জনশুমারি করলো কিন্তু আমার কাছেই আসেনি। এখানে উপস্থিত অনেকের কাছেই যায়নি জনশুমারির টিম। ২ কোটি মানুষকে বাদ দেয়ার কারণ কি হতে পারে? মাথাপিছু আয় বেশি দেখানো? তাছাড়া তো আর কোনো কারণ দেখছি না।’
মান্নার বক্তব্যকে নিছক ‘রাজনৈতিক বক্তব্য বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। এই লেখকের পরিচিত অনেকের কাছেই এমনকি, নিজের বাসাতেও জনশুমারির কেউ আসেননি! জনশুমারিতে আমাদের মতো আমজনতার বাদ পড়াটা না হয় মেনে নেয়া যায়। কিন্তু, আক্কাস আলীর মতো প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যারা সরকারি ভাষায় ‘সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ’ সরকারি হিসাবের মধ্যে তাদের না থাকাটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি জরিপ বলছে, বাংলাদেশের প্রায় ৮ থেকে ১০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার। সুতরাং, বিবিএস’র জনশুমারির প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ধরলে, ১ কোটি ২৮ লাখ থেকে ১ কোটি ৬০ লাখ পর্যন্ত মানুষ কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার, যা দুই সরকারি সংস্থা- বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবের কয়েকগুণ বেশি! প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সত্যিকার উন্নয়ন চাইলে সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের গণনার আওতায় আনতে হবে। একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিও যেন এই গণনা থেকে বাদ না পড়েন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। হোসেন জিল্লুরের ভাষায় লিখি- সঠিক সেবা, সঠিক সহায়তা পেলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজকে বহু কিছু দিতে পারেন। আর সেক্ষেত্রে সমাজও মানবিকতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।