ঢাকা, ২৮ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

কাওরান বাজারের চিঠি

রাজনীতিতে স্নায়ুযুদ্ধ

সাজেদুল হক
৪ ডিসেম্বর ২০২২, রবিবার
mzamin

জীবন হরেক রকম দৃশ্য তৈরি করে। রাজনীতিও তাই। সামনের দিনে রাজনীতিতে নানা রকম দৃশ্য তৈরি হবে। এরইমধ্যে তার আলামত স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। তবে সেটি টাইব্রেকার বা শ্বাসরুদ্ধকর পর্যায়ে চলে গেছে তা বলা যায় না। সোশ্যাল মিডিয়ায় তৈরি হওয়া নানা রকম খবরকে বড় জোর গুজবই বলা যায়। তবে ১০ই ডিসেম্বর, ২০২২ সম্ভবত রাজনীতি একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করবে। সব পক্ষের জন্যই বিষয়টি চ্যালেঞ্জের

৩০শে নভেম্বর, ২০২২। মধ্যদুপুর। পঙ্গু হাসপাতাল।

বিজ্ঞাপন
নিচতলার অপারেশন থিয়েটারের সামনে তখনো অনেকে অপেক্ষায়। তীব্র ব্যথায় এক কিশোরীর আর্তনাদ পরিবেশকে ভারী করে তুলেছে। আশপাশে অনেকেই কাতরাচ্ছেন যন্ত্রণায়। এ পরিবেশে দীর্ঘ সময় থাকা কঠিন। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকলাম।  এক তরুণী তার বন্ধুকে আইসক্রিম খাইয়ে দিচ্ছেন। কিছুদূর এগুতে দেখলাম যান্ত্রিক ত্রুটিতে অচল হয়ে পড়া একটি পিকআপ। দড়িতে বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অন্য আরেকটি পিকআপ। আর্জেন্টিনার পতাকা লাগানো। একপর্যায়ে রিকশায় ওঠলাম। ফেসবুকে দেখলাম দুটি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা ১. বিশ্বকাপ ফুটবল তথা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা। ২. ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা কৌশলে সরিয়ে নেয়ার খবর। দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনার কথা বললেও অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি নিয়ে আলোচনা তুলনামূলক কম। তাহলে এসব কেলেঙ্কারি কি আমাদের দেশের মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়! এটি চটজলদি আলোচনা করা কঠিন।  

এই যখন অবস্থা তখন দেশের রাজনীতিতে রীতিমতো স্নায়ুযুদ্ধ চলছে একটি সমাবেশ ঘিরে। ডেটলাইন ১০ই ডিসেম্বর। সর্বশেষ পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই সমাবেশ করবে- এমনটাই তারা আশা করেন। এ ছাড়া, সমাবেশের আগের দিন এবং সমাবেশের দিন নয়াপল্টন এলাকা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এমন খবরও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভাব্য এই সমাবেশ ঘিরে রাজনীতিতে বাহাস চলে আসছে বেশ কিছুদিন ধরে। শুরুটা অবশ্য করেছিলেন বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান। তখন তিনি বলে বসেন, ১০ই ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথা অনুযায়ী। পরে অবশ্য বিএনপি’র পক্ষ থেকে বারবার এটা পরিষ্কার করা হয়েছে যে, ওই দিন ঢাকায় বিএনপি’র ভিন্ন কোনো কর্মসূচি নেই। কেবল একটি সমাবেশই করতে চান তারা। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবিশ্বাসের ইতিহাস দীর্ঘ। বিশ্বাসের সংকটের কারণেই তো নির্বাচন ব্যবস্থায় নিরপেক্ষ রেফারির ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তা টিকেনি। সে আলোচনা জটিল। কিন্তু রাজনীতিবিদদের পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস কাটেনি। বরং দিনে দিনে তা আরও বেড়েছে। সমাবেশ ঘিরে তা এখন নতুন রূপ পেয়েছে।

 সর্বশেষ জটিলতা তৈরি হয়েছে স্থান ঘিরে। পুলিশের পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এজন্য ২৬টি শর্ত দেয়া হয়েছে। এসব শর্ত কি আদৌ মানা সম্ভব? তা নিয়েও চলছে নানা আলোচনা। কিছু শর্ত তো বেশ জটিলই। কেউ কেউ বলছেন, এসব শর্ত মানলে আর সমাবেশ হবে না। বড় জোর গোলটেবিল বৈঠক হতে পারে। তবে এটিই বোধকরি প্রধান সংকট নয়। প্রধান সংকট হচ্ছে স্থান। বিএনপি এখন পর্যন্ত নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে অনড়। বিএনপি কেন নয়াপল্টনে অনড়? আর সরকার কেন সোহরাওয়ার্দীতেই সমাবেশ করতে দিতে চায়? এ নিয়েই আসলে তৈরি হয়েছে অবিশ্বাস। প্রথম আলো’তে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, অঘটনের আশঙ্কা থেকে  সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে অনিরাপদ ভাবছেন বিএনপি’র নীতিনির্ধারকেরা। এ কারণে ১০ই ডিসেম্বর ঢাকায় গণসমাবেশ করতে পল্টন এলাকার বাইরে যেতে চায় না দলটি। বিএনপি’র দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, এই মুহূর্তে সমাবেশ করার ক্ষেত্রে রাজধানীর  সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে অনিরাপদ ভাবছেন দলটির নীতিনির্ধারকেরা। তারা মনে করেন,  সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অনেকটাই খাঁচার মতো। 

 

 

সেখানে সমাবেশে কোনো মহল ‘অঘটন’ ঘটিয়ে এর দায় বিএনপি’র ওপর চাপাতে পারে সরকার। এ ছাড়া ১১ দিন আগেই সোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশ করতে পুলিশের লিখিত অনুমতি, তার আগে থেকে এখানেই সমাবেশ করার জন্য সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্য এবং বিএনপি’র সুবিধার কথা বলে ছাত্রলীগের সম্মেলন দুই দিন এগিয়ে আনার ঘটনা বিএনপি’র সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে দলীয় সূত্রগুলোর দাবি। অন্যদিকে, শুক্রবার মানবজমিনে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও  সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ফখরুলের মুখে মধু, অন্তরে বিষ। অন্তরে বিষ ছাড়া আর কিছু আছে? ফখরুল সাহেব, অনুমতি চেয়েছেন, অনুমতি দিয়েছে, আপনাদের মিটিংয়ে কেউ ডিস্টার্ব (বিরক্ত) করবে না। আমরা রাজশাহীতেও বলে দিয়েছি, পরিবহন ধর্মঘট যেন না করে। ঢাকাতেও পরিবহন ধর্মঘট হবে না, নেত্রী বলে দিয়েছেন। ঠিক আছে খেলা হবে। এরপরও যদি বাড়াবাড়ি করেন, লাফালাফি করেন, আগুন নিয়ে নামেন, এরপরও যদি লাঠির সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা লাগিয়ে মাঠে নামেন, তাহলে খবর আছে।’ গতকাল দুপুরে গোপালগঞ্জে জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের এসব কথা বলেন। 

আগেই বলেছি, ১০ই ডিসেম্বরের সমাবেশ ঘিরে অনেকদিন ধরেই রাজনীতিতে বাহাস চলছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিদিনই কথা বলছেন এ নিয়ে। দুই দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রায় সবাই এ ইস্যুতে জড়াচ্ছেন বিতর্কে। সরকারের পক্ষ থেকে মন্ত্রীরা হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করছেন। বলছেন, ভিন্ন কিছু হলে পরিণতি হবে হেফাজতের মতো। অন্যদিকে, বিএনপি নেতারা বলছেন, বিএনপি ও হেফাজত এক নয়। ১০ই ডিসেম্বর ঘিরে সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তৈরি হয়েছে নানা গুজব। কেন এত গুজব উত্তর পাওয়া কঠিন। বিএনপি’র অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বলছে, ওই দিন শুধু সমাবেশের কর্মসূচিই রয়েছে তাদের। ঢাকার রাজপথে অবস্থান নেয়ার মতো কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে সরকার পক্ষ সম্ভবত বিএনপি’র মুখের এই কথায় পুরো আস্থা স্থাপন করতে পারেনি। বিএনপি’র নেতাকর্মীরা রাজপথে অবস্থান নেয় কি-না এ ধরনের একটি আলোচনা রয়েছে। যেকারণে নানা রকম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। যদিও আওয়ামী লীগ সেদিন কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করেনি। তবে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নেতাকর্মীদের সতর্ক অবস্থানে রাখার কথা বলা হয়েছে। ঘোষণা দেয়া হয়েছে, সারা দেশেই পাহারায় থাকবেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। 

 সমাবেশ ঘিরে নতুন করে আলোচনায় এসেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তির পর থেকে তিনি গুলশানের বাসায় রয়েছেন। কয়েক দফায় হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাও নিয়েছেন। তার বিদেশ যাওয়ার আবেদনে সরকার অবশ্য সাড়া দেয়নি। খালেদা জিয়া ১০ই ডিসেম্বর সমাবেশে যোগ দেন কি-না এমন একটি গুঞ্জন রয়েছে। তবে বিএনপি’র সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এ ধরনের কোনো সম্ভাবনা নেই। খালেদা জিয়া নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। এ প্রসঙ্গে তথ্য ও সমপ্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ১০ই ডিসেম্বর বিএনপি’র জনসভায়  বেগম খালেদা জিয়ার যাওয়া না যাওয়ার আলোচনা অবাস্তব এবং এটি উদ্ভট অলীক চিন্তা। শুক্রবার (২রা ডিসেম্বর) চট্টগ্রামের  নেভি কনভেনশন সেন্টারে সরকারি হাজী  মোহাম্মদ মহসীন কলেজের পুনর্মিলনী উৎসবে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধান অতিথির বক্তৃতা শেষে ঢাকায় বিএনপি’র সমাবেশে বেগম জিয়ার অংশ নেয়া নিয়ে দলটির নেতাদের আলোচনার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তথ্যমন্ত্রী। ড. হাছান বলেন, বেগম খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত আসামি, আদালত  থেকে কোনো জামিন পাননি উনি। নিজের জন্মের তারিখ বদলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে  যেদিন হত্যা করা হয়, সেদিন জন্মদিনের  কেক কাটেন।

 এরপরও বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বদান্যতায় কারাগারের বাইরে আছেন বেগম জিয়া। এখন যদি তারা এরকম চিন্তা করে, তাহলে সরকার তাকে কারাগারে পাঠাতে বাধ্য হবে। (সূত্র: চ্যানেল ২৪) একই দিনে এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও কথা বলেন। জীবন হরেক রকম দৃশ্য তৈরি করে। রাজনীতিও তাই। সামনের দিনে রাজনীতিতে নানা রকম দৃশ্য তৈরি হবে। এরইমধ্যে তার আলামত স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। তবে সেটি টাইব্রেকার বা শ্বাসরুদ্ধকর পর্যায়ে চলে গেছে তা বলা যায় না। সোশ্যাল মিডিয়ায় তৈরি হওয়া নানা রকম খবরকে বড় জোর গুজবই বলা যায়। তবে ১০ই ডিসেম্বর, ২০২২ সম্ভবত রাজনীতি একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করবে। সব পক্ষের জন্যই বিষয়টি চ্যালেঞ্জের। 

লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, মানবজমিন  

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status