ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ

ফুটবল আছে ফুটবল নেই

সামন হোসেন
২ ডিসেম্বর ২০২২, শুক্রবার
mzamin

দেশের মানুষ ফুটবল কতোটা ভালোবাসেন, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। মানুষ বিশ্বকাপ এলেই কেবল ফুটবল দেখেন না, বরং সারা বছর ধরে ইউরোপের বিভিন্ন লীগের খেলাগুলোও তারা মনোযোগ দিয়ে দেখেন। আর এসব দেখতে দেখতেই তারা দেশের ফুটবল নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের ব্যবধানটা যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের মানুষের এই ফুটবল ভালোবাসা, ফুটবল উন্মাদনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের ফুটবলের উন্নয়নের জন্য সক্রিয় হতে হবে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে। আমরা চিরকাল শুধু বিশ্বকাপের দর্শক হয়েই থাকবো, কোনোদিন খেলবো না- এ তো হতে পারে না


ফুটবল সারা বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় খেলা। বাংলাদেশে জনপ্রিয় তো বটেই। তবে জনপ্রিয়তার মাত্রা যে কত, তার প্রমাণ অন্তত পাওয়া গেছে চলমান বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডে। কাতারের বিশ্বকাপ নিয়ে মধুর লড়াই চলছে আমাদের দেশেও। এখানে প্রতিযোগিতা করে পতাকা টাঙানো হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন
ক্ষণে ক্ষণে মেপে দেখা হচ্ছে কার পতাকা কত বড়! ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মুদি দোকান, রেস্তোরাঁর সামনে টাঙানো প্রিয় দলের পতাকা। দেখে মনে হতে পারে, বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশটির নাম বাংলাদেশ! বিশ্বকাপ নিয়ে এদেশের মানুষের উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব মিডিয়াতেও। বিস্ময় প্রকাশ করেছে আর্জেন্টাইন সংবাদপত্র ‘ওলে’। তারা বলছে, ১৭ হাজার কিলোমিটার দূরের দেশে কীভাবে এত জনপ্রিয়তা পেলো আর্জেন্টিনা? মেসিদের নিয়ে কেন এত আবেগ বাংলাদেশিদের মাঝে! কারণ উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করেছেন ওলে’র প্রতিবেদক মাতিয়াস মানকুসো। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের মাঠে জায়ান্ট স্ক্রিনে খেলা দেখার ছবি ভাইরাল হয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। তারা জানিয়েছে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সের ‘ফুটবল জোন’ খ্যাত ওবেলিস্ক, পার্ক চাকাবুকো, আভেয়ানেদা, প্লাজা মুন্দিয়ালিস্তাস স্পটগুলোতেও এত দর্শক দেখা যায়নি, যতটা না দেখা গেছে ঢাকায়। অথচ এই দেশেই ফুটবল নেই। আছে শুধু ফুটবল নিয়ে দীর্ঘশ্বাস। 

এত এত সমর্থন থাকা সত্ত্বেও আমাদের কোনো অবস্থান নেই বিশ্ব ফুটবলের মানচিত্রে। মাত্র তিন লাখ মানুষের দেশ আইসল্যান্ড এখন ইউরোপের উঠতি ফুটবল শক্তি। এবারের বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে না খেললেও ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে তারা। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে গ্রুপ পর্বের শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলে খেলেছে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপও। মাত্র ৪০ লাখ জনসংখ্যার ক্রোয়েশিয়া ২০১৮ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছে। চলতি বিশ্বকাপেও দারুণ খেলছে দেশটি। কাতার বিশ্বকাপে আমেরিকা ব্রাজিলের জনসংখ্যাই বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। বাকিরা বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে। সরকারি হিসাবে, ১৮ কোটির দেশ হয়েও আমরা কিছু করতে পারি না! আমাদের র‌্যাঙ্কিং ১৯২।  ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের পরে যেসব দেশ আছে, সেগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদ দিলে অন্যরা আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলা ছেড়ে দিয়েছে, অথবা তাদের কোনো জাতীয় দল নেই। মোট কথা, ফুটবলে বাংলাদেশের অবস্থান এখন যতটা নিচে, এর চেয়ে নামা হয়তো সম্ভব নয় কোনো দেশের পক্ষেই। আমাদের পাশের দেশ ভারতও ১০৬। আর মিয়ানমার এত ঝামেলা নিয়েও আমাদের থেকে এগিয়ে। এমনকি সাফের বাকি সব দেশও এগিয়ে যাচ্ছে, পিছিয়ে শুধু আমরা।  ২০০৮ সালে কাজী মোহাম্মদ সাালাউদ্দিন যখন দেশের ফুটবলের দায়িত্ব নেন, তখন আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কারণ, তার মতো ফুটবলবোদ্ধা আসলেই দেশে বিরল। তিনিই বাংলাদেশের ফুটবলের স্বর্ণ যুগের বরপুত্র। 

 

 

মাঠে খেলতে নামলে গ্যালারি থেকে ভেসে আসতো তার নাম ধরে ভক্তদের চিৎকার। তিনি দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। তার হাত ধরেই সেই সোনালী অতীতে রোমন্থন করার স্বপ্ন দেখেছিল দেশের ফুটবলপ্রেমীরা। দায়িত্ব নিয়েই কোটি টাকার সুপার কাপ করে দর্শকদের মাঠমুখী করেছিলেন সালাউদ্দিন। ২০১২ সালে ঘোষণা দিয়েছিলেন ২০২২ বিশ্বকাপ খেলার। শুনেছি কামান চাইলে পিস্তল মেলে। সালাউদ্দিনের ওই দিনের কথা তখন তেমনই মনে হয়েছিল। ভেবেছিলাম বাফুফে সভাপতি যেহেতু বিশ্বকাপের কথা বলেছেন, বিশ্বকাপ না হোক বাংলাদেশ ২০২২ সালের মধ্যে এশিয়ান কাপে কোয়ালিফাই করবে। সেটা না হলেও সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা তো জিতবে! কিন্তু সেটা আর হলো কই। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে বাফুফের মসনদে আছেন সালাউদ্দিন। তার এই ১৪ বছরে ৯৮টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। যার মধ্যে ম্যাচ জিতেছে মোটে ২২টি। ড্র করেছে ২৪টি, হেরেছে ৩৭টি ম্যাচে। ভারতের সঙ্গে কোনো জয় নেই। যা হয়তো আশাব্যঞ্জক নয়। তার থেকেও দুঃস্বপ্নের কথা হলো চার বছর আগে ভুটানের কাছে হেরে ১২ মাস আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে নির্বাসনে ছিল বাংলাদেশের ফুটবল।  

অথচ এক সময়ে বাংলাদেশের এক নম্বর জনপ্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। এখন যেমন ঘরে ঘরে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের পতাকা উড়ছে। সত্তুর- আশির দশকে উড়তো আবাহনী-মোহামেডানের পতাকা। এদেশের মোনেম মুন্না, কায়সার হামিদ, গোলাম গাউসরা কলকাতার লীগ মাতিয়েছেন। ঢাকার জমজমাট লীগে খেলে গেছেন এমেকা ইউজিগো, সামির শাকির, নাসির হেজাজীর মতো বিশ্বকাপ তারকারা। একটা সময় দেশের সবচেয়ে ধনী ফেডারেশন ছিল ফুটবলেরটি। তখনকার সময়ে ফুটবলের টাকা দিয়েই চলতো দেশের ক্রিকেট। সেই ফুটবল রঙ হারিয়ে এখন রুগ্‌ণ, মলিন। ঢাকার মাঠে দর্শক হয় না। এক প্রকার খালি মাঠেই অনুষ্ঠিত হয় লীগ। জাতীয় দলের সফলতা না থাকায় মানুষও দেশের ফুটবলের খুব একটা খবর রাখে না। তবে দেশের ফুটবলের জনপ্রিয়তা যে একেবারে শেষ হয়ে গেছে- তাও বলা যাবে না। ফুটবলে একটু সফলতা এলেই মানুষ মাঠমুখী হচ্ছে। সবশেষ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ বড় উদাহরণ। নেপালের কাঠমান্ডুতে নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জেতায় সাবিনা-কৃষ্ণাদের নিয়ে কম উন্মাদনা দেখায়নি এদেশের জনগণ। রাষ্ট্রও তাদের যথেষ্ট সম্মানিত করেছে। দেয়া হয়েছে ছাদ খোলা বাসের সংবর্ধনা। 

নানা জায়গায় সংবর্ধিত হয়েছে মেয়েরা। আর্থিক সফলতাও এসেছে মেয়েদের।  মেয়েদের এই সাফল্যই প্রমাণ করে সফলতা এলেই ঘুরে দাঁড়াবে এদেশের ফুটবল।  কিন্তু ফুটবলের হারানো ঐতিহ্য ফেরাতে কী উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে যাদের দায়িত্বে পরিচালিত হচ্ছে দেশের ফুটবল তারা কী করেছেন? গত ১৪ বছরে দেশে মানসম্পন্ন একটি ফুটবল একাডেমি গড়ে তুলতে পারেনি কাজী সালাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিটি।  যে একাডেমির মাধ্যমেই ফুটবলে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে নেপাল, মালদ্বীপ। অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনও ১২০টি একাডেমি চালাচ্ছে। একাডেমি করার দায়িত্ব ফেডারেশনের নয়, ক্লাবের- এমন যুক্তি দিয়েই এতোদিন একাডেমি করা থেকে দূরে ছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। তবে সম্প্রতি বাধ্য হয়ে একাডেমি গড়েছে তারা। তবে মন্দের ভালো গত ১৪ বছরে বাংলাদেশে লীগ হয়েছে নিয়মিত। যদিও পেশাদার লীগসহ অন্যসব লীগগুলোতেও পাতানো ম্যাচের তিলক লেগেছে। যা দেশের ফুটবল উন্নয়নে বড় অন্তরায়। ২০০৯ সাল থেকে ফুটবল সাংবাদিকতা করছি, সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলি, যদি ৮০ শতাংশ সততা আর গোছালো প্ল্যানিং করা যায়, তাহলে দেশের ফুটবল আমাদের সেরা র‌্যাঙ্কিং (১১০, ’৯৯ সালে) এবং এশিয়ার ২৪টি দেশের মধ্য থেকে অন্তত এশিয়া কাপ খেলতে পারে। লক্ষ্য ছাড়া কোনো কাজ সম্ভব নয়।

 দলীয় খেলা ফুটবল। এখানে উন্নতির জন্যও দরকার সমন্বিত চেষ্টা। ফেডারেশন চেষ্টা করলেই একজন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তৈরি করতে পারবে না। আবার ক্লাব না দেখলেও ‘রোনালদো’ তৈরি হবে না। এখানে ফুটবলারদের সদিচ্ছা আর কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতাও দরকার। ফেডারেশন আর ক্লাব যার যার জায়গা থেকে নিজেদের কাজটা করলেও কেউ ‘বড়’ খেলোয়াড় হতে পারবেন না, যতক্ষণ না তিনি ‘বড়’ ফুটবলার হতে চান। আরাম-আয়েশ ফেলে যতক্ষণ না ত্যাগ-তিতিক্ষার পথ বেছে নেয়। তাই উন্নতির জন্য চাই সব পক্ষের সমন্বিত প্রচেষ্টা। আর এই বাফুফে এবং ক্লাবগুলোর কোনো ভিশন নেই। কিন্তু মূল কথা, আমরা যেমন স্বপ্ন দেখি সেই স্বপ্ন সবাইকে দেখতে হবে। এসব নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভের শেষ নেই। 

এ দেশের মানুষ ফুটবল কতোটা ভালোবাসেন, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। মানুষ বিশ্বকাপ এলেই কেবল ফুটবল দেখেন না, বরং সারা বছর ধরে ইউরোপের বিভিন্ন লীগের খেলাগুলোও তারা মনোযোগ দিয়ে দেখেন। আর এসব দেখতে দেখতেই তারা দেশের ফুটবল নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের ব্যবধানটা যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের মানুষের এই ফুটবল ভালোবাসা, ফুটবল উন্মাদনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের ফুটবলের উন্নয়নের জন্য সক্রিয় হতে হবে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে। আমরা চিরকাল শুধু বিশ্বকাপের দর্শক হয়েই থাকবো, কোনোদিন খেলবো না- এ তো হতে পারে না। অন্তত স্বপ্ন দেখা, পরিকল্পনা করা এবং সে পরিকল্পনা নিয়ে স্বপ্নের পেছনে ছোটার উদ্যোগ নেয়া তো দরকার। 

লেখক: স্পোর্টস ইনচার্জ, মানবজমিন [email protected]

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status