মত-মতান্তর
স্যার ওয়াল্টারের কবিতা এবং ড. মোমেনের বচন
আলী রাবাত তারেক
(১ বছর আগে) ১৯ এপ্রিল ২০২২, মঙ্গলবার, ৩:৩২ অপরাহ্ন

'গৃহহীন, 'বেকার' এবং রাষ্ট্রহীন' থাকাকালীন তাকে একটি বাড়ি এবং একটি চাকরি প্রদানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তিনি চিরকাল ঋণী হয়ে থাকবেন। ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনের সাথে আনুষ্ঠানিক আলোচনার সময় একথা জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন ।মন্ত্রীর কথাগুলি অনেকটা স্যার ওয়াল্টারের কবিতার মতো। যিনি স্বেচ্ছায় তার "দেশীয় জমি" ছেড়ে দিয়েছিলেন । বাংলাদেশের মন্ত্রীর বক্তব্যটি অগ্রহণযোগ্য ছিল, কারণ তিনি কখনই রাষ্ট্রহীন, গৃহহীন বা বেকার ছিলেন না। তিনি বাংলাদেশের একজন সরকারী কর্মচারী হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। তিনি তার পিএইচডি সম্পূর্ণ করতে এবং আমেরিকান নাগরিকত্ব অর্জনের জন্য সরকারীভাবে অনুমোদিত ছুটি ব্যয় করেছিলেন। একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে 'বেকার, গৃহহীন, রাষ্ট্রহীন' এই কথাগুলি মানায় না !
তবুও মন্ত্রী এই বিবৃতিটি দিয়েছেন সম্ভবত চাপের মুখে পড়ে। কারণ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এবং খোদ র্যাবের উপর অধিদপ্তর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল তা প্রত্যাহারের জন্য সেক্রেটারি ব্লিঙ্কেনকে এবং তার মাধ্যমে মার্কিন ট্রেজারিকে বোঝানোর জন্য স্বদেশ থেকে ক্রমাগত চাপ আসছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর। এদিকে ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞাগুলি সম্পর্কে তার অজ্ঞতা মন্ত্রীর কাজটিকে আরও কঠিন করে তুলেছিল। ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞাগুলি মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে কার্যকর হয় যখন ওয়াশিংটন তার বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। ট্রেজারি নিষেধাজ্ঞাগুলি এই বিভাগের শক্তিশালী অফিস অফ ফরেন অ্যাসেট কন্ট্রোল (OFAC) দ্বারা মোকাবেলা করা হয়।
বাংলাদেশ এখন OFAC নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত দেশের তালিকায় বেলারুশ, মায়ানমার, আইভরি কোস্ট, কিউবা, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো, ইরান, ইরাক, লাইবেরিয়া, উত্তর কোরিয়া, সুদান, সিরিয়া এবং জিম্বাবুয়ের সাথে স্থান পেয়েছে। র্যাবের উপর ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞাগুলি গুরুতর উদ্দেশ্যের স্বার্থে আরোপ করা হয়েছে। মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের মূল বিষয়গুলির উদ্দেশ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এগুলি তুলে নেওয়া হবে না এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের মন্ত্রী মার্কিন সেক্রেটারিকে তার দুর্দশার কথা বলে বাংলাদেশের অবস্থা আরও খারাপ করে দিয়েছেন। পাশাপাশি ওয়াশিংটনকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে বলে তিনি পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলেছেন। বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) উৎসাহিত করতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আর্জি জানান। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা নিয়ে যখন নাটক চলছে তখন মন্ত্রী ওয়াশিংটনে ছিলেন। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট তার সরকারের পতন ঘটাতে পাকিস্তানের বিরোধীদের কাছে একটি চিঠি দিয়েছিল বলে অভিযোগ করে ইমরান খান রাজনৈতিক বিজয় প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছিলেন। কিন্তু পরে অনাস্থা ভোটে হেরে যান ইমরান। এইসময়ে বাংলাদেশের মন্ত্রীর ওয়াশিংটনকে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার অনুরোধ করার বিষয়টা ছিল অদ্ভুত। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল মন্ত্রীকে মনে করিয়ে দেওয়া যে তিনি ভুল পথে হাঁটছেন। ইসলামাবাদে ওয়াশিংটনের সাথে জড়িত সাম্প্রতিক রাজনৈতিক নাটক সম্পর্কে জ্ঞানসম্পন্ন যে কোনো বিবেকবান ব্যক্তি এই প্রশ্ন করবেন যে মন্ত্রী এটা কীভাবে করতে পারলেন ?
মন্ত্রীর ভাগ্যও তার সহায় হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডের ঢাকা সফরের শেষাংশ সুখকর ছিলো না। তিনি ঢাকা থেকে নয়াদিল্লি গিয়েছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর জয়শঙ্করের সঙ্গে দেখা করতে। গত ফেব্রুয়ারিতে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের সাইডলাইনে মেগা অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বাংলাদেশে চীনের বিশাল উপস্থিতির বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী। বাংলাদেশের এই পদক্ষেপের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত কেউই খুব একটা সন্তুষ্ট নয়।
স্যার ওয়াল্টারের কবিতা থেকে ড. মোমেনের নিজের এবং দেশের জন্য শেখার অনেক কিছু রয়েছে। তার ভুল পদক্ষেপগুলি প্রমাণ করে যে, তিনি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার বাইরে ছিলেন। বাংলাদেশে ২০২৩ সালের নির্বাচন ভিন্ন পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হবে , এর আগে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইসলামী মৌলবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ ছিল একমাত্র বিষয়। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং জাতিসংঘ তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ,যে কোনও মূল্যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরতে হবে, তখন গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নির্বাচনের ইস্যুগুলোকে কোনো গুরুত্বই দেয়া হয়নি। কিন্তু এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং জাতিসংঘ এই বিশ্বাসে একত্রিত হয়েছে যে, বাংলাদেশে আগামী সাধারণ নির্বাচন অবশ্যই অবাধ ও সুষ্ঠু হতে হবে যা ভোটারদের অধিকারকে সম্মান করবে। চীনের কারণে ভারতও আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে গেছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করার জন্য ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং জাতিসংঘের ইস্যু ছিল ইসলামিক মৌলবাদ এবং ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ, কিন্তু এখন এই ইস্যুটি তার তাৎপর্য হারিয়েছে। তাই ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো ক্ষমতায় ফিরতে ফ্রি পাস পাওয়ার সম্ভাবনা কম আওয়ামী লীগ-এর কাছে। আওয়ামী লীগকে ভোটের শক্তির মাধ্যমে টানা চতুর্থ মেয়াদে জয়লাভ করতে হবে, যে শক্তি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ তৈরি করেছিল।
দ্য ইকোনমিস্ট ২৯শে জানুয়ারী বাংলাদেশের উপর একটি নিবন্ধে "How Sanctions Improve Respect for Human Rights" শিরোনামে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের উপর ট্রেজারি নিষেধাজ্ঞার ইতিবাচক প্রভাবের কথা জানিয়েছে।