ঢাকা, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ

সমালোচনা এক পাশে রেখে মাঠের ফুটবল জমে উঠছে

তালহা বিন নজরুল
২৭ নভেম্বর ২০২২, রবিবারmzamin

সাগরবেষ্টিত মরুভূমির দেশ, আয়তনে অনেক ছোট, তাপমাত্রা চরম ভাবাপন্ন। মানবাধিকার নিয়ে অভিযোগ, বিশেষ করে সমকামীদের  স্বাধীনতা প্রশ্ন, প্রকাশ্যে মদ পান করতে না দেয়া নিয়ে ইউরোপিয়ান অনেক দেশের নানা বৈরী মন্তব্য। লাখো ফুটবলপ্রেমীর আবাসন নিয়ে সংশয়। অনেক প্রতীক্ষার পর, এ রকম অনেক শঙ্কা আর সংশয় নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে কিন্তু ঠিক সময়েই মাঠে গড়িয়েছে বিশ্বকাপ ফুটবল- গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। একজন দর্শক, একজন ফুটবলপ্রেমী হিসেবে আপনি কী বলবেন? বিশ্বকাপের খেলায় সে রকম কোনো সমস্যা কি হচ্ছে? যদি তেমন কোনো সমস্যা হতোই তবে পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম কিন্তু তুলাধুনো করে ছাড়তো। ব্রাজিল বিশ্বকাপের সময় কিন্তু গরমের মাত্রা এর চেয়ে অনেক বেশি ছিল। সেবার ফোরলাজোতে স্টেডিয়ামে নেদারল্যান্ডস আর মেক্সিকোর খেলায় পর্তুগালের রেফারি কুলিং ব্রেক দিতে বাধ্য হন, যাতে খেলোয়াড়রা একটু জিরিয়ে নিতে পারে। তখন তাপমাত্রা ছিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিরতি ছিল পাঁচ মিনিটের। ফিফা’র নিয়ম বলছে, তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রির বেশি হলে খেলোয়াড়রা যদি চান তবে তিন মিনিটের বিরতি দেয়া যেতে পারে।

বিজ্ঞাপন
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ২০২০ ইউরোপিয়ান কাপের সময়ও কোনো কোনো খেলায় কুলিং ব্রেক দেয়া হয়। গেল গ্রীষ্মে ইংল্যান্ডেরও কোনো কোনো এলাকায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। অন্যদিকে এই সময়ে কাতারে গড় তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রির নিচেই থাকে। 

ছোট দেশ হওয়ায় বিভিন্ন দেশের ফুটবল সমর্থকেরা স্বল্প খরচেই বিভিন্ন স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা উপভোগ করতে পারছেন। আর সাগরের বুকে প্রমোদতরীতে রাত যাপনের সুযোগ করে দেয়ায় অনেকেই দ্বিগুণ মাত্রায় আনন্দ উপভোগ করছেন। আমাদের দেশ থেকে যে সংখ্যক সংবাদকর্মী এবার বিশ্বকাপের খেলা উপলক্ষে কাতার গেছেন এর আগে কখনো এর অর্ধেকও যেতে পারেন নি। এমন করে পৃথিবীর সব দেশ থেকেই অনেক বেশি সংবাদকর্মী এবার বিশ্বকাপ দেখতে গেছেন। তারা স্বাধীনভাবেই তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারছেন। আমরা যারা দেশে বসে আছি তারা কেমন দেখছি বিশ্বকাপ ফুটবল? অবশ্যই নানা জনের উত্তর নানা রকম হবে। বয়সের ভিন্নতা, আর্থসামাজিক অবস্থানগত ভিন্নতার কারণে নানা রকম মানুষের স্বাদ আহ্লাদ একই রকম হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবে অবশ্যই অধিকাংশের মতোই তো প্রাধান্য পায়- মেজরিটি মাস্ট বি গ্রানটেড। সেদিক থেকে যদি বলি বাংলাদেশের মানুষ এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল ভালোই উপভোগ করছে তবে কী তা বাড়িয়ে বলা হবে? বিশেষ করে রাজধানীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তা এবং মাঠে বিশাল আকারের পর্দা টানিয়ে খেলা দেখার যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তাতে ওই সব এলাকায় আলাদা এক উৎসবের আমেজ এনে দিয়েছে। এখন ঘরে ঘরে টেলিভিশন সেট, হাতে হাতে মোবাইল ফোন সেটে খেলা দেখার সুযোগ থাকার পরেও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ একাকার হয়ে খেলা উপভোগ করছেন।

 

 

 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক গত বুধবার রাত জেগে হাজারো ছাত্রের পাশে বসে ব্রাজিলের খেলা উপভোগ করেছেন বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানাতেও কার্পণ্য করেন নি। ঢাকার আরেকজন প্রতিথযশা সাংবাদিক তার ফেসবুক পেজে খেলার প্রতি সাধারণের আকর্ষণের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন গুলশান ২ নং এলাকায় আর্জেন্টিনার হারের পর দেখি রাস্তার পাশে একজন অটোরিকশা চালকের চোখে পানি। জিজ্ঞাসা করলে জানান যে, তিনি গাড়ি চালানো বাদ দিয়ে দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে এই খেলা দেখেছেন। জানতে চাইলে তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানীর নামও বলতে পারেন নি। কিন্তু মেসির তিনি দারুণ ভক্ত। এরই নাম আবেগ। এখানেই হয়তো সেরা ফুটবলারদের জীবনের সার্থকতা।  মাত্রই ক’দিন আগে শেষ হয়েছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপ। এর রেশ কাটানোর সুযোগই পান নি এদেশের ক্রীড়ামোদিরা। এরই মধ্যে চলে এসেছে ফুটবল বিশ্বকাপ। নিজের দেশ না খেললেও এর জনপ্রিয়তা ক্রিকেট বিশ্বকাপের চেয়েও বেশি। ক্রিকেটের মতো ফুটবলে হয়তো পরতে পরতে রহস্য আর উত্তেজনা লুকিয়ে থাকে না কিন্তু এতে রয়েছে অন্যরকম এক উত্তেজনা আর শিহরণ। স্বল্প সময়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা যায়। আর তাই বাংলাদেশের পতাকা গুটিয়ে রেখে খেলাপাগল মানুষ নেমে পড়েন ভিনদেশের পতাকা নিয়ে। কারও পছন্দ আর্জেন্টিনা, কারও পছন্দ ব্রাজিল, কারও জার্মানি। অনেকের পছন্দের দেশ ইতালি এবার বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলার যোগ্যতাই অর্জন করতে পারে নি। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না। অন্য কোনো দেশের সমর্থক হয়েই তারা বসবেন বিশ্বকাপের খেলা দেখতে এবং নিজেদের মাতিয়ে রাখবেন পুরো ৯০ মিনিট। বাংলাদেশে বিশ্বকাপের হাওয়া খুব বেশি আগে লাগেনি। 

এদেশে চার দশক আগে ক’জনের ঘরেই বা টেলিভিশন সেট ছিল। আর আমাদের দেশে রঙিন টেলিভিশনের সম্প্রচারই শুরু হয় ১৯৮১ সালে। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপের খেলাই প্রথম বাংলাদেশের টেলিভিশনে দেখা যায়। স্পেনে অনুষ্ঠিত ওই আসরের সব খেলা সরাসরি বিটিভিতে দেখায় নি। রাতের খেলা ধারণ করে পরের দিন দেখানো হতো। সেমিফাইনাল আর ফাইনাল সরাসরি দেখিয়েছিল যতদূর মনে পড়ে- সেবার ইতালি চ্যাম্পিয়ন হয়। এর আগের বারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। পরের বারেও ১৯৮৬তেও আর্জেন্টনা। ১৯৯০তেও ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে রানার্সআপ আর্জেন্টিনা। দুর্দান্ত ফর্মে দাপটে খেলেছেন ম্যারাডোনা। তখন থেকেই এ দেশে আর্জেন্টিনার সমর্থক বাড়তে থাকে।  এদেশের মানুষের হৃদয় ব্রাজিল জয় করে আরও আগে। কালো মানিক পেলের জাদুতে ষাটের দশকে ব্রাজিল ছিল দুর্দান্ত ফর্মে। ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৭০’র মধ্যে তিনবার চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। তিন ফাইনালে গোল পেলের। অমরত্ব লাভের জন্য আর কী চাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর স্কুলের পাঠ্যবইতে স্থান পায় পেলের জীবনী। এর পর ১৯৯৪ ও ২০০২তেও চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। মাঝে ১৯৯৮তেও রানার্স আপ।

 

 

 রোমারিও, রোনালদো, দুঙ্গা, কাফু, বেবেতোরা ফের ব্রাজিলকে বিশ্বমঞ্চে উদ্ভাসিত করেন। আর এতে নতুন প্রজন্মের মধ্যে আর্জেন্টিনা বিরোধী ব্রাজিল শিবির গড়ে ওঠে। গত শতকের সত্তর, আশি এমনকি নব্বইয়ের দশকে এদেশের ফুটবলপ্রেমীরা বিভক্ত ছিলেন আবাহনী-মোহামেডান এই দুই শিবিরে। আর এখন তারা বিভক্ত বহু দূরের দেশ ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা এই দুই শিবিরে। ফুটবল ছাড়া অন্য কোনো বিষয়েই আর তারা আলোচনায় আসে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চরম উৎকর্ষতার যুগে দুই শিবিরের চরম বৈরী ভাব আরও প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। কেউ কাউকে নাহি ছাড়ে সমানে সমান। কী তীক্ষ্ন খোঁচা, তীব্র বাক্যবাণ। দারুণ উপভোগ্য।  পরের প্রশ্নটা স্বাভাবিক ভাবেই আসছে, কেমন দেখছেন এবারের আসর। এক কথায় বলতে গেলে অবশ্যই মন্দ নয়। জমেই তো উঠেছে। কে ভেবেছিল শিরোপার অন্যতম দাবিদার দুটি দল তাদের প্রথম খেলায় হেরে যাবে। তাও আবার এশিয়ার দুটি দলের কাছে এবং দু’দলই আগে গোল করে পরে দু’গোল হজম করে। সময়ের সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসির দল তার গোলেই এগিয়ে গিয়েছিল। তিনটি গোল বাতিল হয় অফসাইডের কারণে। 

এরপরে মাত্র ৫ মিনিটের ব্যবধানে দুটি গোল করে প্রথম অঘটন ঘটায় সৌদি আরব। এ জয় তাদের বিশ্বকাপ জয়ের মতোই। যে কারণে দুই খেলা বাকি থাকতেই সৌদি রাজপরিবার দলের প্রত্যেকের জন্য রোলস রয়েস গাড়ি উপহারের ঘোষণা দিয়েছে।  আরেক খেলায় জার্মানিকে হারায় জাপান। এটাও ছিল অপ্রত্যাশিত। জার্মানি মানেই বিশ্বকাপের অটো ফেভারিট। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের দলে রয়েছে বিশ্বের কয়েকজন সেরা খেলোয়াড়। তাই তাদের হারে হতাশ অনেকে। তবে গত বুধবার রাতে আর্জেন্টিনা আর জার্মানির সমর্থকদের হতাশার মাত্রা বাড়িয়ে জয় তুলে নিয়েছে আরেক ফেভারিট ব্রাজিল। নেইমার তেমন সুবিধা করতে না পারলেও চার্লিসন যে গোলটি করেছেন তা এবারের অন্যতম সেরা গোল হবে নিঃসন্দেহে বলা যায়। সাবেক চ্যাম্পিয়নদের মধ্যে  স্পেন আর ইংল্যান্ড অবশ্য বেশ দাপুটে জয়ে শুরু করেছে। স্পেন ৭-০ গোলে হারায় কোস্টারিকাকে আর ইংল্যান্ড ৬-২ গোলে হারায় ইরানকে। ফ্রান্স জয় পেলেও করিম বেনজেমার অভাব তাদের ভোগাতে পারে। বেলজিয়াম র‌্যাংকিংয়ে দুই নাম্বারে খাকলেও কানাডার বিপক্ষে তারা খুব ভালো খেলতে পারে নি। এশিয়ার দলগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া মেক্সিকোর সঙ্গে ড্র করে একটি পয়েন্ট তুলে নিয়েছে। শুক্রবার সব আলোচনা সমালোচনাকে একপাশে রেখে শেষ মুহূর্তের নাটকে ওয়েলসের কাছ থেকে ছয় ছিনিয়ে এনেছে ইরান।  এভাবেই দিন যত গড়াবে খেলা আরও জমবে বলেই আশাবাদী সকল ফুটবলপ্রেমী।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

১০

স্বপ্নের স্বদেশের সন্ধানে/ তফসিল ঘোষণা- এরপর কি সব সমাধানের সুযোগ শেষ?

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2023
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status