ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মত-মতান্তর

সনাতন সমাজের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও একজন শফিকুল ইসলামের মন

ইফতেখার আহমেদ খান

(১ বছর আগে) ১৫ মে ২০২২, রবিবার, ৮:৫৩ অপরাহ্ন

mzamin

বাংলাদেশ একটি সনাতন সমাজ। এই বক্তব্যের শত প্রতি-মত দাঁড় করানো যাবে আমি তা জানি। বিষয়টিকে এইভাবে বললে বোধহয় বক্তব্যটির জোরদার প্রতি-মত দাঁড় করানো যাবে না। সেটি হলো- বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক আচরণটি সনাতন সমাজের বৈশিষ্ট্যের প্রতিনিধিত্ব করে। এরূপ সমাজের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক দিকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সেখানে রাজনৈতিক কার্যকলাপকে সামাজিক ও ব্যক্তিগত কার্যকলাপ হতে সম্পূর্ণ পৃথক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয় না। আর এ কারণেই প্রশাসনিক আচরণটি ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের ঘেরাটোপ হতে মুক্তি পায় না। যার ফল দাঁড়ায় দেশগুলোতে বিশুদ্ধ রাজনীতির পটভূমির অনুপস্থিতি। গতানুগতিক সমাজের মতো অধিকাংশ অপাশ্চাত্য দেশে রাজনৈতিক সম্পর্কের গঠন সামাজিক এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের গঠন দ্বারা নির্ধারিত হয়। শক্তি, ক্ষমতা, পদমর্যাদা ও প্রভাব প্রভৃতি সামাজিক মর্যাদার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। যারা এলিট বলে গণ্য হন, তারাই এই সকল দেশে জাতীয় রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন।

বিজ্ঞাপন
এখানেই চলে আসে রাজনৈতিক সংস্কৃতি নামক ধারণাটি। বলা প্রয়োজন, অপরিপক্ক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রজাতন্ত্রের কাজে প্রশাসন বা আমলাতন্ত্র-ই মূল ভূমিকা নেয় এবং এই প্রক্রিয়ায় প্রশাসন ক্রমান্বয়ে স্বেচ্ছাচারি হয়ে ওঠে। তাছাড়াও বাংলাদেশের মতো উপনিবেশত্তোর দেশগুলোর বাস্তবতায় দেখা যায়, এর প্রশাসনযন্ত্রটি উপনিবেশিক প্রশাসনের অযৌক্তিক অহং থেকে মুক্ত হয়নি। বস্তুত: নিয়মের কাঠামোকে ডিঙিয়ে ব্যক্তিপরিচয়ের মাধ্যমে কার্যসিদ্ধির প্রচেষ্টাটি একটি দেশের শাসন প্রক্রিয়ার গুণগত মানকে একেবারেই তলানিতে ফেলে দেয়। সাম্প্রতিক রেলমন্ত্রীর আত্মীয়ের কাণ্ডটি তার-ই একটি নমুনা উদাহরণ।

রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে বিনা টিকিেিট রেলভ্রমণ সিস্টেমের একটি ব্যত্যয় যা প্রশ্নবিদ্ধ করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কার্যপ্রণালীর ধারাকে। দেখা যাচ্ছে মন্ত্রী প্রথমে একবাক্যেই না করে দেন ব্যক্তিসমূহকে তিনি চেনেন না। পরবর্তীতে দেখা গেল না তিনি চেনেন। বিষ্ময়কর ব্যাপার হলো, অপরাধী ব্যক্তি ও ব্যক্তিসমষ্টি সাদাকাগজে টিটির বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দায়ের করে। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে মুহুর্তে টিটিকে বরখাস্ত করে দেয় তার দপ্তর। এটি একটি সামন্ত-প্রহসন। দাপ্তরিক বাস্তবতায় একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ হলে তার নামে একটি কারণ দর্শানো নোটিশ জারি হয়, সেই নোটিশের উত্তর অভিযুক্তকে লিখিত আকারে পেশ করতে হয়। শুধু তাই নয়, লিখিত নোটিশ গ্রহণ বা বর্জন যা-ই হোক তাকে একটি প্যানেলের সামনে বসে মৌখিক ব্যখ্যাও দিতে হয়। এরপর সিন্ধান্ত গৃহীত হয়। মূল কথা হলো, প্রক্রিয়াগতভাবে প্রমাণ হতে হয়। এই প্রক্রিয়াতেই যে শুধু প্রশাসনিক শাস্তি হয় তা নয়, এরকমই একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিষয়ের সুরহা দাপ্তরিক ব্যবস্থপনার একটি প্রতিষ্ঠিত রীতিধারা। এখানে কী ঘটল, প্রশাসন কিন্তু অপরাধী বক্তির পক্ষে চলে গেল।

সেই তিন অপরাধী যদি মন্ত্রীর আত্মীয় না হয়ে একজন সাধারণ নাগরিক হতেন তবে কি সেই অভিযোগ রেলদপ্তর আমলে নিতো? নাকি এতা দ্রুত সুরহা করতো? টিটি শফিকুল ইসলামের মনে তখন কী বিরাজ করছিল যখন তার-ই দপ্তর অপরাধীর পক্ষ হয়ে তাকে অনৈতিক শাস্তির সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলল! বিষয়টি ইতিবাচক পরিণতির দিকে মোড় নিচ্ছে, উপায়হীন হয়ে মন্ত্রী বলছেন ওই টিটিকে তিনি পুরস্কৃৃত করবেন। এখানেই আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলোর স্বার্থকতা পরিস্ফুট হয়। এ কারণেই সংবাদমাধ্যকে বলা হয় রাষ্ট্রের/ সরকারের চুতর্থ অঙ্গ।

আমাদের গ্রামীন বাস্তবতায় ছৈয়দবাড়ি, খাঁ বাড়ি, চৌধুরীবাড়ি, ভূঁইয়া বাড়ি ইত্যাদি শব্দগুলো বহুলপ্রচলিত। ওইসব বাড়ির সদস্যরা সারা পরিবেশ থেকে বাড়ির/বংশের পরিচয়ে নানবিধ সুবিধা আদায় করে, অন্যায় করে যা সনাতন সমাজের বৈশিষ্ট্য এবং যা এই নিবন্ধের শুরুতেই বিবৃত হয়েছে, উল্লেখ্য সময়ের পরিক্রমায় এই সিদ্ধ বাস্তবতাগুলোর প্রভাব কমে আসছে। উপনিবেশকালের বাস্তবতায় দেখা যেতো জমিদারের বৌ, জমিদারের নাতি, জমিদারের আত্মীয় পরিচয়ে সমাজে একটি বিশেষ স্থান অলংকৃত করে থাকতো।

রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর আনীত ভূমিকাটি সেই ফেলে দেয়া সামন্ত শাসনেরই একটি চাক্ষুস নমুনা। এখন স্বাধীনসত্তা হিসেবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যূদয় এর প্রেক্ষাপট বিশ্লেøষণে এটি একটি উদার-আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রশাসনিক আচরণ যদি সামন্ত শাসনের আদলে হয় তবে এতো কষ্টের স্বাধীনতার মূল্য কোথায়? রেলমন্ত্রী এবং তার প্রিয়তমা স্ত্রী আমাদের আধুনিক শাসনপ্রণালীকে এক ঘটনার এক ধাক্কায় সেই পূর্বতন উপনিবেশামল এবং তারও পূর্বের সামন্তশাসনে নিয়ে গেল।

এই বিষয়টিকে একটি গণতান্ত্রিক সমাজের শাসনব্যবস্থায় প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আলোকে উপস্থাপন করার প্রয়াস পাচ্ছি। আমাদের এই বিশ্বসভ্যতা বহু বহু সময় অতিক্রম করে এসেছে। রাষ্ট্র হওয়ার আগের জীবন আর রাষ্ট্র হওয়ার পরের জীবনে বিস্তর তফাৎ। রাষ্ট্র মানে অধিক কল্যাণ। জন লকের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ স্বাধীনভাবে বসবাস করত। কোন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সেখানে ছিল না। মানুষ ছিল সীমাহীন সুখের অধিকারী। মানুষ আরো অধিক কল্যাণ তথাপি আরো অধিক সুখ নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র গঠন করেছে। অপরদিকে, টমাস হবস রাষ্ট্র গঠনে মানবের ভয়াবহ প্রকৃতি বিশ্লেষণ করেছেন। তার মতে, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ হানাহানি কাটাকটি করে মরতো। সেখানে না ছিল সুখ, না ছিল কল্যাণ। এই মানুষকে শাসনের জন্য নিয়ন্ত্রণ জরুরি। এই নিয়ন্ত্রণের জন্যই গঠিত হয়েছে রাষ্ট্র। এটাই হবসের ঐতিহাসিক সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব। রাষ্ট্র সর্বজনীনভাবে সমষ্টির কল্যাণ নিশ্চিত করবে। মূলত রাষ্ট্র গঠন সভ্যতায় যতগুলো ঘটনা ঘটেছে সেসবের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। জীবনের কল্যাণ সাধনই রাষ্ট্রের মৌল উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রের উৎপত্তিতে যত ধরনের মতভেদ আছে সব কয়টির মর্মমূলে রাষ্ট্র উদ্ভবের উদ্দেশ্যকে এই কল্যাণ বোধকেই বেছে নেয়া হয়েছে।

কল্যাণ শব্দটির অর্থ একাঙ্কিক নয়- এর রয়েছে বহু আঙ্গিক। সমতা, ন্যায়বিচার সুষম বন্টন, নীতির সর্বজনীনতা, উপযুক্ত ব্যক্তির উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ, শিক্ষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকরণ, জনগণ মনোনীত শাসক ইত্যাদি সবই কল্যাণের অন্তর্ভূক্ত। শিল্পবিপ্লব পরবর্তী গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে আমরা যতোই বুর্জোয়া বলে গালমন্দ দেই, অর্ন্তগতভাবে এর রয়েছে বহু বহু মূল্যবান উপাদান মানবসত্ত্বার মর্যাদা নির্ধারণে। গণতন্ত্র মানে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত শাসক। রাষ্ট্রের ছোটলোক বড়লোক শিক্ষিত অশিক্ষত যে শ্রেণিরই হোক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যাকে রায় দিবে সেই হবে শাসক। এটা একটা মানবতার প্রতিষ্ঠা, একটি জ্ঞানের প্রতিষ্ঠা। গণতন্ত্র একটি ব্যাপক জ্ঞান। সাদা চোখে এই জ্ঞানের ব্যবচ্ছেদ এবং এর গুণের উপলব্দি সম্ভব নাও হতে পারে।

বাংলাদেশ একটি রিপাবলিক (People Republic of Bangladesh) অর্থাৎ, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ‘পতি’ (The President,) প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জনগণের ভোটে মনোনীত হন। সুতরাং, বাংলাদেশ একটি পরিপূর্ণ গণতন্ত্রের দেশ। এই দেশের শাসনে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি (Administrative accountability and transparency)একটি অপরিহার্য উপাদান সুশাসন নিশ্চিতকরণে।

আধুনিক রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় পৃথিবীর সব দেশেই অবিরাম গতিতে লোক প্রশাসনের কর্মকান্ড ব্যপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। এই ক্রমবর্ধমান প্রশাসনিক ক্ষমতার যদি নিয়ন্ত্রণ না থাকে তবে গণতান্ত্রিক সরকার তার প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনে চরমভাবে ব্যর্থ হবে। L. D White বলেছেন - গণতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন এবং ক্ষমতা যতো বেশি নিয়ন্ত্রণও ততো জোরদার করতে হবে।

সুশাসন প্রক্রিয়াকে জোরদার করতে হলে যে বিষযটি একান্ত জরুরি তা হচ্ছে প্রশাসনিক জাবাবদিহি ও স্বচ্ছতা। জবাবদিহির মাধ্যমেই জনগণ সরকারের স্বৈরাতান্ত্রিক মনোবৃত্তিক ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, সুশাসনের জন্য প্রয়োজন প্রশাসনিক জবাবদিহি অর্জন। এইভাবে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা হচ্ছে জবাবদিহিতার মাধ্যমে অর্জিত ফল। সরকারি সিন্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং সেগুলো কিভাবে ও কতটুকু জনগণের কল্যাণে আসবে সে সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা থাকা উন্নত গণতান্ত্রিক সংস্কৃিতর বৈশিষ্ট্য। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি তাই জনগণের ও সরকারের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত।

আধুনিক সংগঠন তাত্ত্বিকদের মতে, যেকোন সংগঠনেরই একটি বাহ্যিক পরিমন্ডল থাকে, যার মধ্য থেকে সংগঠনটি নিয়ত পরিচালিত হয় ও গতিশীল থাকে। সেক্ষেত্রে সংগঠনিটি হচ্ছে উপ-ব্যবস্থা, তার বাহ্যিক পরিবেশ হচ্ছে অতিব্যবস্থা। উপব্যবস্থা তার অতি-ব্যবস্থা থেকে উপাদান সংগ্রহ করে সংগঠনের মধ্যে প্রক্রিয়াজাত করে আবার অতিব্যবস্থায় ফেরত দেয়। উৎপাদিত এই উপাদান পরিবেশ কর্তৃক গ্রহণীয় বা বর্জনীয় হতে পারে। গ্রহণীয় হলে সংগঠন তার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে। আর যদি বর্জনীয় হয় সংগঠন পুনরায় বিবেচনা করবে এবং এর ত্রুটিসমূহ খুঁজে বের করবে। যেমন- বর্তমানের রেলকাণ্ডটির মাধ্যমে রেলদপ্তরের সম্মানীয় মন্ত্রীর প্রশাসনিক আচার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সরকার পারে সেই সেই সংগঠন তাত্ত্বিকদের সূত্র অনুসরণ করে অতি-ব্যবস্থায় বিষয়টিকে ছেড়ে দেয়া। অতি-ব্যবস্থা হতে সমষ্টিই রায় দিবে মন্ত্রী হিসেবে তার পদ আলিঙ্গন করে রাখার অধিকার রয়েছে কী না এবং এরই মাধ্যমে নিশ্চিত হবে বহু বহু কাক্ষিত প্রশাসনিক জবাবদিহি।

লেখক: উন্নয়ন কর্মী, কথাশিল্পী 
[email protected]
 

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

   

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবদলই সরকার সমর্থিত / ভোটের মাঠে নেই সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিরোধীদল

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status