মত-মতান্তর
ইউক্রেন সঙ্কট ও মার্কিনদের নতুন বিশ্বভাবনা
শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন
(২ বছর আগে) ১৯ এপ্রিল ২০২২, মঙ্গলবার, ৩:২৫ অপরাহ্ন
আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের উঠান। বলা হয় বিশ্বের প্রতি ইঞ্চি মাটির জন্য মার্কিনদের পলিসি রয়েছে। দেশে বিদেশে নানা প্রান্তে সামরিক ঘাঁটি নয় শুধু সফট পাওয়ার ডিপ্লোমেসিতেও তাদের জুড়ি নেই। একাডেমিক, গণমাধ্যম, আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থায় মার্কিনরা বড় ধরনের আধিপত্য ধরে রেখেছে। ট্রুমান, কেনেডি, নিকসন, চার্টার, বুশ মতবাদ সহ নানা তাত্ত্বিক মতবাদ বিভিন্ন সময় মার্কিন মূলক থেকে উৎপাদন করে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে বিশ্বব্যাপী।
মার্কিনরা যখন বিশ্বব্যাপী সোভিয়েত ফোবিয়া ছড়িয়ে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়ল, সারা বিশ্ব তাদের পেছন পেছন গেলো। এরপর ক্লাশ অব সিভিলাইজেশন তত্ত্ব ও ৯/১১ হামলার পর বিশ্বব্যাপী ইসলামফোবিয়া তৈরি করে মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম দেশসমূহে আধিপত্য তৈরি করল, নিয়ে গেল বাকি বিশ্বকেও। সোভিয়েতের পতন ও নিও লিবারেলিজমের জনপ্রিয়তার পর মার্কিনদের আধিপত্য অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে জোরদার হয়।
তবে চলতি শতকের দ্বিতীয় দশকে চীনের ‘বিস্ময় উত্থান’ এবং দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন অক্ষের দেশসমূহের সাথে চীনের সংঘাত, মার্কিনকে চীন নিয়ে উদ্বিগ্ন করে তোলে। ভারত, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলকে নিয়ে চীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা ব্রিকস ও রাশিয়া ও এশিয়ার বেশ কিছু দেশ নিয়ে সামরিক জোট সাংহাই কর্পোরেশন গড়ে তোলা, এবং সর্বশেষ বিশ্বব্যাপী কানেক্টেভিটির কথা বলে ভূমিধস প্রকল্প ‘বিআরই’ নিয়ে আসা মার্কিনকে চীন ঠেকাতে মরিয়া করে তোলে।
তবে চীনকে মোকাবেলায় মার্কিন পলিসি দেখে মনে হয় চীনের উত্থান নিয়ে মার্কিনদের ধারণা ছিল না।
এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও ইউরোপজুড়ে যখন চীনের বিআরই প্রকল্প চলমান তখন মার্কিন কখনো ইন্দো প্যাসিফিক কখনো থ্রিডব্লিউ নানা পলিসি ঘোষণা করলেও চাক্ষুষ কোন অগ্রগতি নেই। অর্থনৈতিক চীনকে মোকাবিলায় সামরিক মার্কিনকে বেশ নার্ভাস দেখা যাচ্ছিলো নানা সময়ে। চীনের উত্থানকে ঠেকাতে মার্কিন বন্ধু হিসাবে নিলো চীনের সীমান্ত শত্রু ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে।
অন্যদিকে জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে মার্কিন মুলুকের যে বিশ্বস্ততার সম্পর্ক সে সম্পর্ক ভারতের সাথে হয়ে উঠেনি। ভারতের সাথে রাশিয়ার উচ্চ পর্যায়ের সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক, ভারত- ইরান সম্পর্ক, কাশ্মীর ইস্যুতে হোয়াইট হাউসের মধ্যপন্থা, আফগান ইস্যুতে কৌশলগত পলিসি নিয়ে দুই দেশের মতবিরোধ সম্পর্কের বিশ্বস্ততার ঘাটতি নির্দেশ করে। চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃত্তি নিয়ে বলা হচ্ছে বিশ্বের চীনকে দরকার, চীনের বিশ্বকে দরকার। নয়াদিল্লি-ওয়াশিংটন সম্পর্ককেও বলা হচ্ছিল নয়াদিল্লির ওয়াশিংটনকে দরকার, ওয়াশিংটনের নয়াদিল্লিকে দরকার।
এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি সামরিক জোট গঠন করল অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যকে নিয়ে। চীনকে ঠেকাতে ভারতকে বাদ দিয়ে কেন নতুন জোট তা নিয়েও গুঞ্জন উঠল। এসবের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো প্যাসিফিক পলিসি নিয়ে আগালেও এই অঞ্চলেই নানা দেশে চীনের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের পলিসিকে স্বস্তিহীনভাবে আগাতে দিচ্ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্র যখন এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলমুখী তখন মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনদের গোলার আঘাতের ক্ষত দগদগে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধরেই নিচ্ছিলো রাশিয়া এখন একটি মৃত বাঘ। শুধু মার্কিন নয়, ইউরোপের দেশগুলোরও ন্যাটো নিয়ে অনাগ্রহ তৈরি হয়েছিল। মার্কিন বলয়ের অনেক দেশ সামরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল রাশিয়ার সাথে। গ্যাস ও তেলের জন্য ইউরোপ এতটাই রাশিয়া নির্ভর হয়ে পড়েছে বিকল্পই খুঁজে পাওয়া দায়। এমন পরিস্থিতিতে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল, দিনেদুপুরে ঘোষণা দিয়ে ইউক্রেন হামলা, পূর্ব ইউরোপের ন্যাটো অন্তর্ভুক্তি নিয়ে রাশিয়ার উচ্চবাচ্য মার্কিন ও ইউরোপকে অপ্রস্তুত করে দিছে।
রাশিয়াকে এই মুহূর্তে যে নিষেধাজ্ঞায় ইউরোপ আমেরিকা মোকাবেলা করতে চাচ্ছে তাও নানাভাবে কার্যকর হচ্ছে না। সৌদি আরব ও আমিরাতের মতো দেশ রাশিয়ার সাথে কৌশলগত সম্পর্ক রাখছে। ভারত কম দামে তেল কিনছে। চীন কূটনৈতিক সাপোর্ট দিচ্ছে। চীনের পক্ষে অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতির ক্ষতি পুষিয়ে দেয়াও সম্ভব। চীন এটা ইরান, তুরস্ক, মিয়ানমার, কম্বোডিয়ায় করে দেখিয়েছে।
ফলে বিশ্বরাজনীতিতে মোড়লিপনায় চীনের সাথে একটা ভাগাভাগিতে আসতে চায় যুক্তরাষ্ট্র, এমনটা আভাস দিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। পত্রিকাটি বলছে রাশিয়ার বিকল্প হিসাবে তেল গ্যাসের উৎস হিসাবে শত্রুদেশ ইরান ও ভেনেজুয়েলার দিকে ঝুঁকছে। বিশ্ব রাজনীতিতে স্থায়ী বন্ধু ও স্থায়ী শত্রু নেই। এখানে স্বার্থের লড়াই চলে। নানা কৌশল ও স্ট্রাডেজি নিয়ে দেশগুলোতে টিকে থাকতে হয়। ফলে চীন, ইরান বা ভেনেজুয়েলার প্রতি মার্কিনের নতুন দৃষ্টি যে একেবারে অকার্যকর হবে তা বলা যাবে না।
চীনের বড় বাজার ইউরোপে। চীন একটি অর্থনৈতিক শক্তি। বৈরী দেশগুলোর সাথেও বিশাল বিশাল বাণিজ্য সে অব্যাহত রেখেছে। ফলে ইউরো-মার্কিন বানিজ্য সম্পর্ক টুল হিসাবে নিয়ে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের মোড়লিপনা ভাগাভাগির বিনিময়ে মার্কিন চীনকে রাশিয়ার ঢাল হওয়া আটকাতে চায়।
ইরান একটি পুরান সভ্যতা হলেও অর্থনীতির বেহাল অবস্থা। ইউক্রেন যুদ্ধের ডামাডোলেই তারা ইরাকের স্বায়ত্বশাসিত কুর্দিস্তানে হামলা করেছে যেখানে মার্কিন কনস্যুলেটও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইরান, ইরাক ও সিরিয়ায় যেকোন সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েল ও সৌদি ভূমি স্পর্শ করছে নির্বিঘ্নে। কুর্দিস্তানে ইরানি হামলাকে ইউক্রেন যুদ্ধের পরিস্থিতিতে ফায়দা তোলার উপায় হিসাবে দেখা হচ্ছে। তারা মার্কিনের ইরানের আশপাশের স্বার্থে আঘাতের ভয় বা তেল বিক্রির বিনিময়ে পরমাণু চুক্তি পুনর্রুজ্জীবিতকরণ ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিতে পারে। এই পরিস্থিতি আবার সৌদি, ইসরায়েল ও আমিরাতকে ভিন্নভাবে ভাবাবে।
কিন্তু ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া প্যাসিফিক ও পূর্ব ইউরোপে একযোগে অসহায় ও অপ্রস্তুত লাগছে। প্রতিটি যুদ্ধের শুরু ও যুদ্ধের শেষ নতুন ভূ-রাজনৈতিক বোঝাপড়া তৈরী করে। ফলে ইউক্রেন ইস্যু বিশ্বব্যাপী চলা ভূ-রাজনৈতিক পটভূমির বদলে বড় একটি নাড়া দিবে। অন্যদিকে ভারত, ইসরায়েল, সৌদি আরব, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের সংকট নিরসনে মার্কিন পলিসির দিকে তাকিয়ে ছিল এতদিন সেখানেও নতুন ভাবনা আসবে। এই দেশগুলো নিজেদের সুরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের স্যাটেলাইটের বাইরে গিয়ে নিজস্ব পলিসি নিতে পারে।
লেখক: স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লি