নির্বাচিত কলাম
সাফ কথা
ব্রাজিলের ফুটবল বনাম নির্বাচন, ল্যাটিনে বামদের জোয়ার, ফিফা প্রধানের প্রশ্ন
কাজল ঘোষ
২৫ নভেম্বর ২০২২, শুক্রবারফুটবল। একটি ছন্দের নাম। মাতোয়ারা ঘরে-বাইরে। গোল একটি হাওয়া সদৃশ বস্তুকে নিয়ে চলছে সবখানেই উত্তেজনা। অনেক স্থানে উন্মাদনাও। বিশেষত জায়গা বিক্রয় করে সবচেয়ে বড় পতাকা বানানো, নিজের বাড়ির রং বদলে ফেলা, বাড়ি বাড়ি পছন্দের দলের সমর্থনে পতাকা ওড়ানো এ এক ভিন্ন সংস্কৃতি। দুনিয়াজুড়ে ফুটবল নিয়ে মহারণ চললেও দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রিকেট প্রাধান্য। ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ। প্রতিটি দেশই ক্রিকেটে তাদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করে আসছে। তবে ফুটবলে এ দেশগুলো পিছিয়ে থাকলেও ফটবল সংস্কৃতিতে দুনিয়ার অনেক দেশ থেকে এগিয়ে।
এর একটি তালিকাও সে আমাকে জানালো। বুঝতে বাকি রইলো না দূর ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো কীভাবে আমাদের শিশুদের মধ্যে জনপ্রিয়। স্কুলের পাশেই একটি পার্ক রয়েছে যেখানে সে খেলতে যায় সেখানে একই স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী জানতে চাইলো তুমি কোন দল সাপোর্ট করো? আর্জেন্টিনা বলতেই সে ক্রোধ নিয়ে বললো, আমি ব্রাজিল। বুঝতে পারি, তারা মনঃপূত না হওয়ায় এই উষ্মা। এই চিত্র সবখানেই। এই দুটি দলের সমর্থনে খোদ আর্জেন্টাইন ও ব্রাজিলিয়ানরাও অবাক হয়। বিশ্বকাপ শুরুর দিনগুলোতে দুনিয়ার নানা প্রান্তে কেমন রিপোর্ট হচ্ছে ফেভারিট দলগুলো নিয়ে তা সার্চ করে জানা গেল খোদ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের কাগজগুলোতে তাদের দলগুলো নিয়ে খুব বেশি রিপোর্ট হচ্ছে না। অথচ ভিন্ন চিত্র আমাদের এখানে। প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে একাধিক খবর। ছবি ছাপা হচ্ছে বড় বড় করে। আর্জেন্টিনার খেলার আগে একটি জাতীয় দৈনিকতো আলাদা করে বিশেষ পাতা প্রকাশ করেছে। আর এই দুটি দল জিতলেও যেমন বড় ঘটনা তেমনি হারলেও বড় ঘটনা। প্রধান শিরোনামে দুটি দেশই যেন অনিবার্য।
ব্রাজিলের ফুটবল বনাম নির্বাচন
ব্রাজিলের নির্বাচনে জয় পেয়েছেন বামপন্থি লুলা। তার কাছে হেরে গেছে বলসোনারো। বামপন্থি প্রতিদ্বন্দ্বী লুলার কাছে পরাজিত হলেন। লক্ষণীয় হচ্ছে, খুব সামান্য ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বী বলসোনারোকে হারিয়ে ফের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে লুলা দ্য সিলভা। তিনি পেয়েছেন ৫০ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট। অন্যদিকে বলসোনারোর প্রাপ্ত ভোট ৪৯ দশমিক এক শতাংশ। ১৯৮৫ সালের পর এই প্রথম ব্রাজিলের কোনো প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্টের আসন ধরে রাখতে পারলেন না। লুলা এর আগে দেশ শাসন করেছেন। বলসোনারো ক্ষমতায় আসার পর দুর্নীতির অভিযোগে তাকে জেলেও যেতে হয়েছে। বামপন্থি লুলা ভোটের ফল প্রকাশিত হওয়ার পর বলেছেন, এ জয় মানুষের। ব্রাজিলের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য ভোট দিয়েছেন। লুলার কথায়, ওয়ার্কার্স পার্টি কিংবা যে সমস্ত দল প্রচারে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, এই জয় তাদের নয়। এই জয় ব্রাজিলের মানুষের। গণতন্ত্রের লড়াইয়ে এতদিন যারা শামিল ছিলেন। ভোটের মাধ্যমে সেই জয় তারা ছিনিয়ে নিলেন।
এই নির্বাচনে খুব অল্প ব্যবধান দুজনের। হাড্ডাহাড্ডি লড়েই লুলা ক্ষমতায় এসেছেন। ব্রাজিলের ফুটবল নিয়ে মাতামাতি দেশের অলিগলিতে। আমাদের দু নেত্রীও শোনা যায় ক্ষমতার হিসাব নিকাশে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলেও ফুটবলে সমর্থনে পছন্দের দল একটিই। বিষয়টিকে ঘুরিয়ে যদি চিন্তা করি আমাদের এখানে নির্বাচনের ফলাফলে এতটা কাছাকাছি হলে মেনে নেয়ার বিষয়টি কেমন দাঁড়াতো? আমাদের এখানে এখনো পর্যন্ত নির্বাচনী কাঠামো শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব স্বার্থের বলয়ে আটকে আছে একটি শাক্তশালী নির্বাচন কমিশন গঠন। আমাদের এখানে বড় দুটি দলই তাদের হিসাব-নিকাশের বাইরে দেশের আপামর মানুষের জন্য কল্যাণমূলক চিন্তায় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করেনি। এ কারণে কখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে, দরকারে তা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আবার দরকার ফুরোলে বাতিল করা হয়েছে। ফের তা ছাড়া সুষ্ঠুু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে রাজপথে আন্দোলন গড়াচ্ছে।
এই ভাঙাগড়ার খেলা আর কতোদিন চলবে? সংবিধান রচনার অর্ধশতক হয়েছে। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে তাদের ক্ষমতাকে পোক্ত করতে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। এভাবেই এগিয়ে চলেছে দেশ। সত্যিকার আইনের শাসন, নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন, জনগণের গণতন্ত্র এখনো দেশ দেখতে পায়নি। ব্রাজিল ল্যাটিন আমেরিকার দূর দেশ। সে দেশের ফুটবল যেভাবে আমাদের আন্দোলিত করে ঠিক একইভাবে তাদের নির্বাচন কমিশন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করে অল্প ব্যবধানে জয়ী হওয়া দলকে ক্ষমতায় হস্তান্তর করে যে নজির স্থাপন করেছে তা আমাদের রাজনীতিকদের আন্দোলিত করে কি?
ল্যাটিনে বামদের গোলাপি জোয়ার
ফুটবলের ছন্দে ইউরোপ আর ল্যাটিন আমেরিকা দুনিয়া মাতাচ্ছে। বলা যায়, একই সুর আর ছন্দ ফুটবলে। অবাক করার বিষয় এই দুটি অঞ্চলের নির্বাচন আর ক্ষমতায় আসা দলগুলোর সমীকরণ। ইউরোপে কট্টর ডানপন্থি আর ল্যাটিন আমেরিকায় বামদের গোলাপি জোয়ার বইছে। ইতালিতে কট্টর ডানপন্থি দল ব্রাদার অব ইতালির নেতা জর্জিয়া মেলানির জয়ের বিপরীতে ব্রাজিলে বামপন্থি লুলা দা সিলভার বিজয়। এ যেন পাল্টা প্রতিক্রিয়া। ইউরোপজুড়ে ডানপন্থিদের পুনরুত্থানের বিপরীতে লাতিন আমেরিকায় উদারমনা বামপন্থিদের বিজয়। গত কয়েক বছরের নির্বাচন আর ক্ষমতার পালা বদলে ইউরোপ আর ল্যাটিন আমেরিকার এমন পরিবর্তন নতুন নতুন সমীকরণের জন্ম দিচ্ছে। এ মুহূর্তে ল্যাটিন আমেরিকার দেশে দেশে বামপন্থিদের জয় জয়কার। মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, পেরু, কলম্বিয়া, ভেনিজেুয়েলা, হুন্ডুরাস, চিলি, কিউবা, নিকারাগুয়া আর অতি সম্প্রতি ব্রাজিল এই তালিকায় যুক্ত হলো। অন্তত এক ডজন দেশ বামদের বেছে নিয়েছে। নিশ্চয়ই ল্যাটিন আমেরিকার বিপ্লবী নায়ক চে বেঁচে থাকলে খুশি হতেন। যেখানে তিনি বিপ্লবের নিশান ওড়াতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন।
ভণ্ডামির অভিযোগ ফিফা প্রেসিডেন্টের
এবারের কাতার বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে নানা শঙ্কা ও বিতর্ক ছিল শুরু থেকেই। সেই বিতর্কে জল ঢেলেছেন ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ানি ইনফান্তিনো। বিশ্বকাপ ফুটবল শুরুর আগের দিন ইনফান্তিনো স্বাগতিক দেশ কাতারের মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সমালোচনাকে ভণ্ডামি বলে অভিযোগ করেছেন। এক ঘণ্টার এক বক্তৃতায় ইনফান্তিনো বলেছেন, নৈতিকতা নিয়ে কাতারকে উপদেশ দেবার আগে ইউরোপের দেশগুলোর উচিত তারা অতীতে যা করেছে তার জন্য ক্ষমা চাওয়া। দোহায় আয়োজিত এই সংবাদ সন্মেলনে ফিফা প্রেসিডেন্ট বলেন, কাতারে ফিফার বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগে দেশটিতে অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু এবং এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতি দেশটির আচরণের বিষয়গুলো নিয়ে যেভাবে সমালোচনার ঝড় উঠেছে, তা আসল টুর্নামেন্টকে ম্লান করে দিয়েছে।
ইনফান্তিনো ইউরোপের দিকে বাক্যবাণ নিক্ষেপ করে বলেন, কাতারে অভিবাসী শ্রমিকদের বিষয় নিয়ে কথা বলার আগে ইউরোপের দেশগুলোর উচিত তাদের অতীত ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো এবং তারা যা করেছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করা। তিনি বলেন, আমিও ইউরোপীয়। আমরা ৩ হাজার বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যা করেছি, নৈতিক শিক্ষা দেয়ার আগে আমাদের উচিত আগামী ৩ হাজার বছর ধরে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করা। ইনফান্তিনো মনে করেন, ইউরোপের একতরফা নৈতিক শিক্ষা মানে হচ্ছে ভণ্ডামি।